ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

অর্জন বিনষ্টের সাম্প্রদায়িকতা

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ৭ নভেম্বর ২০১৬

অর্জন বিনষ্টের সাম্প্রদায়িকতা

ধারাবাহিকভাবে হিন্দু নির্যাতন, মূর্তি ভাঙ্গা, লুটপাট আর নারী নির্যাতন কি সাম্প্রদায়িকতা? আমি আসলে এক ধরনের ধন্দে পড়ে গেছি। প্রায়ই দেখি এখানে-ওখানে আকছার ঘটে চলেছে এসব। এখন শুরু হয়েছে ধর্ম অবমাননার নামে কুৎসা রটানো। এ জাতীয় অপপ্রচার যে কত ভয়াবহ হতে পারে রামুর নির্বাক বুদ্ধই তার বড় উদাহরণ। প্রতিবেশী ভারত, অতীতের দেশভাগ, পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে হিন্দুরা আগে থেকেই টার্গেট। কিন্তু বৌদ্ধদের বেলায় তেমন ছিল না। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমরা যখন দিনভর পালিয়ে বেড়াতাম আশ্রয়ের জন্য এ পাড়ায় ও পাড়ায়, দৌড়াদৌড়ি করতাম, দেখতাম কোন কোন এলাকায় উর্দু ইংরেজীতে লেখা ছিল ‘ইহা একটি চাইনিজ বৌদ্ধপাড়া।’ সেই তারাও আজ জামায়াতী বা ধর্মান্ধদের কাছে রেহাই পায় না। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে আমরা যতই ডিজিটাল অসাম্প্রদায়িক বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে চিৎকার করি না কেন আসলে খোলনলচে পাল্টে যাওয়ার খুব বেশি দেরি নেই আর। শুরু হয়েছে ধর্ম বাঁচানোর নামে এক আজগুবি খেলা। বিশ্বায়নের এই যুগে খোলা দুনিয়ায় মিডিয়া মানুষের হাতের মুঠোয়। ইচ্ছে করলেই যে কোন কিছু করা যায়। কত ধরনের অপশন। কত ধরনের বুজরকি। এর ছবি ওর কাঁধে লাগিয়ে, ওর মাথা এর মুখে লাগিয়ে কত মানুষকে যে অপমান করা হয়। কত ধরনের অপপ্রচার আর ফটোশপ। এমনও দেখি বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতা সেলিব্রেটিও বাদ যান না। কোন্টা সত্য কোন্টা মিথ্যা বোঝা যেমন কষ্টের, তেমনি আসল-নকল নির্ণয় করাও কঠিন। এমন সময়ে বাংলাদেশের মতো লেখাপড়া না জানা পিছিয়ে পড়া সমাজে মানুষকে মিথ্যা তথ্য ও ভুয়া খবর দিয়ে উত্তেজিত করে তোলা কোন ঘটনাই না। সেটার এমন ইস্তেমাল আগে দেখিনি কোনদিন। ভাবখানা এই ইসলাম এত ঠুনকো এক বিশ্বাস যে, যে কেউ কিছু বললেই তার গোড়ায় টান পড়বে। যে ধর্ম শুরু থেকে কঠিন দুশমনদের মোকাবেলা করে কোরাইশদের হিংসা ও আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে জগত জয় করেছিল, তার সবকিছু কি আসলে এসব মূর্খের ওপর নির্ভরশীল? খেয়াল করবেন প্রচার ও অপপ্রচার কত সাংঘাতিক! ধরে নিলাম কোন এক হিন্দু বা অমুসলিম গায়ে লাগার মতো কিছু বলেছে। সেটা তো তার বা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। শাস্তি তাদের প্রাপ্য। তাদের শাস্তি দেবে আইন। সরকার দেখবে কিভাবে তা করা যায়। আইন নিজের হাতে নেয়া এই মানুষগুলো তার ধার ধারে না। ধার ধারে না আরও একটা জিনিসের। তারা ওই মানুষগুলো শাস্তি দিতে চায় কিনা সেটাও প্রশ্নবোধক। তাদের ধরতে পারুক বা না পারুক এরা ঠিকই ঝাঁপিয়ে পড়ে হিন্দু কমিউনিটির ওপর। একজন বা একাধিক ব্যক্তির দায় কেন একটি গোষ্ঠী নিতে যাবে? কেন নিরীহ সাধারণ হিন্দু ও তাদের দেব-দেবী হবেন আক্রোশের নির্মম শিকার? দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে বলে যারা গলা ফাটাচ্ছেন তাদের কাছে প্রশ্ন করি, উন্নত দেশে বা অগ্রসর সমাজে কি এমনটা সম্ভব? এভাবে কি প্রতিশোধ নেয়া আইনসিদ্ধ, না নৈতিক? সরকার জানে না এমন কি আছে বা এমন কি থাকে একটি দেশে? ক’দিন পরপর দেশের নানা জায়গায় হিন্দুদের ওপর এভাবে আক্রমণ চালানো এখন নিয়মিত হয়ে পড়েছে। প্রায়ই দেখি দেব-দেবীর ভাঙ্গা মূর্তি গড়াচ্ছে মাটিতে। অসহায়ের মতো বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে কোন দেবী বা দেবতার মুখ। কি প্রমাণ করতে চায় এরা? যে মূর্তির প্রতিরোধ করার শক্তি নেই? নাকি এদের টার্গেট হিন্দুদের জমিজমা? অনেকে সেটা মনে করলেও আমার তা মনে হয় না। কত আর জমিজমা তাদের? আর জমিজমা দখলের জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার দরকার নেই আদৌ। দু’ এক রাত ভয় দেখালেই তারা পানির দামে জমি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেবে। কারও ঘরে সোমত্ত মেয়ে বা জওয়ান বউ থাকলে তো কথাই নেই। রাজনীতির চেহারাটা দেখুন। যতদিন বিএনপি-জামায়াত জোট গদিতে ছিল আমরা তাদের দোষারোপ করতাম। তাদের নিয়ম ছিল জমি দিতে হবে। ভোটে জিতুক বা হারুক মার খেতে হবে। মেয়েটাকে দিয়ে চলে যেতে হবে। আওয়ামী লীগের আমলে তার একটু রদবদল হয়েছে মাত্র। ভোট তো দিতেই হবে। জমিও দিতে হবে। মস্তান বা নেতার নিরাপত্তায় সীমান্ত পার করিয়ে দেয়াও হবে। সেই নেতা বা মস্তান এও বলে রাখবেন তার শরীর ঠিক না থাকলে তিনি যখন কলকাতা বা প্রতিবেশী দেশে যাবেন তখন তার দেখভাল করতে হবে। না হলে দেশে ফেলে যাওয়া আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ ভাল থাকবে না। এই পরম্পরা চলছে, চলবে। হিন্দী সিনেমার মতো এক ডন যায় তো আরেক ডন আসে। ভাগ্য বদলায় না। এদিক থেকে ওলামা লীগই বরং ঠিক। তাদের মন ও মুখ এক। অন্যদিকে সুশীল নামের কথিত উদার যারা তারাই হিপোক্রেট। সরকারী-বেসরকারী বিরোধী দলে যারা আছেন তারা এবং সুশীলদের কারও সংখ্যালঘু নিয়ে ভাবার সময় নেই। ভাবখানা এই, এসব সব দেশে হয়, হতে থাকবে। যার পোষাবে না সে না থাকলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একাই শুধু ব্যতিক্রম। তিনি জানেন এভাবে চললে দল দূুর্বল হবে। ভারসাম্য নষ্ট হবে রাজনীতির। ভোটের বাক্সে যে ব্যবধান সেটা কমানোর জন্য বিএনপি-জামায়াত এই চাল চালছে অনেকদিন থেকে। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের অনেকে পা দিয়েছেন সেই ফাঁদে। এটা আরেক ধরনের চক্রান্ত হোক আর যাই হোক এ খেলা এখন চলছে। দেশের অসহায় দুর্বল ভীতিপ্রবণ হিন্দু বা সংখ্যালঘুদের নিয়ে এ আরেক খেলা। আজ এখানে কাল ওখানে, দেশের নানা প্রান্তে নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের তাড়ানোর কাজটি চলছে অজান্তে। এতে কার লাভ, কার লোকসান সবাই জানে। তবু আওয়ামী লীগের হুঁশ ফেরে না। কে না জানে এখন দেশে সক্রিয় কোন রাজনৈতিক দল নেই। নেই বিরোধী দলও। সবকিছু একতরফা। যদি তাই সত্য হয় কারা এসব করে, কাদের গু-াবাহিনী বা কাদের লেলিয়ে দেয়া উত্তেজিত জনতার নামে একদল লোক এগুলো করে তারা জানে না? এত গোয়েন্দা, এত বাহিনী, এত ক্যাডার, তারপরও কেন কোন প্রতিকার হয় না? কি আশ্চর্য, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিও এখন আপোসকামী। লোক দেখানো আহা-উহু ছাড়া তার যেন কিছু করার নেই আর। হিন্দুদের গিনিপিগ বানানোর পরিণাম কি হয় বা হতে পারে তার একটা উদাহরণ দেব প্রয়াত কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের একটি ভাষণ থেকে। সে আয়োজনে তার সঙ্গে আমারও কথা বলার সুযোগ মিলেছিল। তিনি তখন বয়োবৃদ্ধ। বারবার মাইক্রোফোন থেকে সরে যাচ্ছিলেন। ধরে এনে দাঁড় করাতে হচ্ছিল মাইক্রোফোনের সামনে। শওকত ওসমান বলছিলেন তার যৌবনে তিনি একদিন ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন দলে দলে লোক দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। তার পরিচিত দাদা কাকাবাবু জ্যাঠামশাই মাসীমা কাকীমারা পালাচ্ছেন ভয়ে। রাতের আঁধারে তাদের এই চলে যাওয়া তাঁকে ব্যথিত করলেও তিনি ছিলেন নিরুপায়। বারবার অজ্ঞাতের উদ্দেশে প্রশ্ন রাখছিলেন এর কি কোন প্রতিকার বা জবাব নেই? সেই তিনিই বললেন কিভাবে সময় এর জবাব দিয়েছিল তাকে। কয়েক বছর পর তিনি দেখলেন আবারও দলে দলে লোক পালাচ্ছে প্রাণ ভয়ে। এবার যারা যাচ্ছিল তারা কেউ সংখ্যালঘু না। সংখ্যাগুরু মানুষরাও পালাচ্ছে সেই একই গন্তব্যে। পাকিস্তানীদের ভয়ে। সময় ও নিয়তি কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। লোভ ও হিংসার হাত বড় নির্মম। তার থাবা এক সময় ঘরের ওপর চড়াও হয়। বাংলাদেশে মাইক্রোস্কোপিক হিন্দু বা অন্যদের তাড়ানোর পর কে কার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বা কারা কাদের ওপর চড়াও হয় সেটা আমাদের অজানা কিছু না। সেদিকেই কি চলছে বাংলাদেশ? একটা দেশে একটি বিশেষ ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের ওপর লাগাতার আক্রোশের কারণে কি হয় পাকিস্তান তার বড় প্রমাণ। সেটা না হওয়ার জন্য লাখো মানুষের আত্মদানে ইজ্জতের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া দেশ আমাদের। এ দেশে কিছু অসভ্য মানুষের কারণে সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে এটাই কি আমাদের চাওয়া? দেশ ও সরকারের দায়িত্ব মানুষের ভাল করা। তাদের নিরাপত্তা বিধান করা। আজ এই ডিজিটাল দুনিয়ায় যদি সেটা করা না যায় বাংলাদেশ কি তার মূল চরিত্র নিয়ে সামনে যেতে পারবে?
×