ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তুরিন আফরোজ

এম এ হান্নানের সংসদীয় আসন শূন্য না পূর্ণ?

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ৭ নভেম্বর ২০১৬

এম এ হান্নানের সংসদীয় আসন শূন্য না পূর্ণ?

দশম সংসদে ময়মনসিংহ-৭ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হয়েছেন জাতীয় পার্টির এম এ হান্নান। ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে গত ৩০ অক্টোবর, ২০১৬ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল আইন অনুযায়ী এরই মাধ্যমে এম এ হান্নানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলার ট্রায়ালের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর যুদ্ধাপরাধী মামলার অভিযোগ সম্পৃক্ততার কারণে সাংসদ এম এ হান্নানকে গ্রেফতার করা হয় এবং অদ্যাবধি তিনি এই কারণে কারাগারে আটক আছেন। আইনের চোখে একজন ব্যক্তি যতক্ষণ না পর্যন্ত সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হচ্ছেন যে, তিনি অপরাধ করেছেন, তাকে অপরাধী বলা যাবে না। এই ব্যাপারটি কিন্তু এম এ হান্নানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রসিকিউশন তাকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারবে যে, তিনি অপরাধ করেছেন, তাকে অপরাধী বলা যাবে না। কিন্তু আমার এই লেখার উদ্দেশ্য হলো এই যে, ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর তারিখ হতে এম এ হান্নান জাতীয় সংসদে একাদিক্রমে অনুপস্থিত আছেন। তার ফলে কি তার সংসদীয় আসন শূন্য হয়ে যাবে কিনা? সংবিধান হচ্ছে আমাদের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী সংবিধানের আইনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিল বলে গণ্য হবে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, সংবিধানকে মেনেই সরকার তার সকল কর্মকা- পরিচালনা করে থাকে। সংবিধান হাতে শপথ নিয়েই আমাদের সংসদ সদস্যরা সংসদীয় পদে আসীন হন। এখন সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কখন কি পরিস্থিতিতে একজন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হয়ে যায় অর্থাৎ তিনি তার সংসদীয় পদে আর আসীন থাকতে পারেন না। সংবিধানের ৬৭ (১) (খ) অনুচ্ছেদে বলা আছেÑ ‘কোন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হইবে, যদি সংসদের অনুমতি না লইয়া তিনি একাদিক্রমে নব্বই বৈঠক দিবস অনুপস্থিত থকেন।’ সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে ‘বৈঠক’ শব্দটির অর্থ বলা হয়েছে এভাবে যে, ‘বৈঠক’ (সংসদ প্রসঙ্গে) অর্থ ‘মুলতবি না করিয়া সংসদ যতক্ষণ ধারাবাহিকভাবে বৈঠকরত থাকে, সেই রূপ মেয়াদ।’ এখন প্রশ্ন হলো, একজন সংসদ সদস্য যদি একাদিক্রমে নব্বই বৈঠক-দিবস অনুপস্থিত থাকেন তবে তার জন্য সংসদের অনুমতি কবে নেবেন? অনুপস্থিতির নব্বই বৈঠক-দিবস অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে না পরে? বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ মওদুদ আহমদ বনাম আনোয়ার হোসেন খান (২০০৮) মামলাতে বলেছেন যে, সংসদের অনুমতি নেয়ার ব্যাপারটি একাদিক্রমে নব্বই বৈঠক-দিবস অনুপস্থিতিকাল অতিবাহিত হওয়ার পরই যৌক্তিক হবে। উল্লেখ্য, সংসদের রুলস অব প্রসিডিউরে কিভাবে নব্বই বৈঠক-দিবস গণনা করা হবে সে ব্যাপারে কিছু বলা নেই। তবে ১৯৯৫ সালের ঝঢ়বপরধষ জবভবৎহপব ঘড়.১ ড়ভ ১৯৯৫ অনুযায়ী আপীল বিভাগ বলেছেন, নব্বই বৈঠক-দিবস গণনা করার ক্ষেত্রে সংসদের দুই বৈঠক মধ্যবর্তীকাল এবং একই বৈঠক চলাকালীন সময়ে মূলত বিকাল অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো, যদি অভিযুক্ত আসামি এম এ হান্নান ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে থাকেন এবং অদ্যাবধি কারাগারে আটক থেকে থাকেন, তবে সংসদীয় বৈঠক থেকে একাদিক্রমে নব্বই বৈঠক-দিবস তিনি অনুপস্থিত থাকলে তার সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষিত করা হবে কিনা? আসুন, একটু হিসাব মিলিয়ে নেই। অভিযুক্ত আসামি এম এ হান্নান ২০১৫ সালের ১ অক্টোবরে গ্রেফতার হওয়ার পর দশম সংসদের মোট ৫টি সংসদীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। অষ্টম সংসদীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালের ৮ নবেম্বর থেকে ২৩ নবেম্বর পর্যন্ত এবং এই বৈঠকে মোট বৈঠক-দিবস ছিল ১২টি। নবম সংসদীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং এই বৈঠকে মোট বৈঠক-দিবস ছিল ২৭টি। দশম সংসদীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত এবং এই বৈঠকে মোট বৈঠক-দিবস ছিল ৯টি। একাদশ সংসদীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ১ জুন থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত এবং এই বৈঠকে মোট বৈঠক-দিবস ছিল ৩২টি। দ্বাদশ সংসদীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত এবং এই বৈঠকে মোট বৈঠক দিবস ছিল ১০টি। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, অভিযুক্ত আসামি এম এ হান্নানের গ্রেফতারের পর মোট ৫টি সংসদীয় বৈঠক বসে এবং মোট ৯০টি সংসদীয় বৈঠক-দিবস ইতোমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। এখন যেহেতু অভিযুক্ত আসামি এম এ হান্নান ইতোমধ্যে একাদিক্রমে নব্বই সংসদীয় বৈঠক-দিবসে অনুপস্থিত থেকেছেন এবং বর্তমানের দশম সংসদ তার এই অনুপস্থিতির ব্যাপারে কোন অনুমতি প্রদান করেনি, সেহেতু সংবিধানের ৬৭ (১) (খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার সংসদীয় আসন শূন্য বলেই ধরে নিতে হবে। এই ব্যাপারে মাননীয় স্পীকার এবং সংসদের বিনীত দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। লেখক : আইনের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর
×