ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গভীর নিম্নচাপটি লঘুচাপে পরিণত, চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৭ নভেম্বর ২০১৬

গভীর নিম্নচাপটি লঘুচাপে পরিণত, চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি লঘুচাপে পরিণত হয়ে চট্টগ্রামের সীতাকু- উপজেলা ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এটি বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমন্বয়ে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এর প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে। রবিবার আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ বিশেষ বুলেটিনে এ তথ্য জানানো হয়। নিম্নচাপটি রবিবার সকাল ছয়টার দিকে সীতাকু- উপজেলার কাছ দিয়ে চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করে। নিম্নচাপের প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভারি বৃষ্টি, দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রবন্দর সমূহকে তিন নম্বর স্থানীয় সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় কয়েকটি জেলার প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমনসহ বিভিন্ন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর বরগুনার আমতলি ও পটুয়াখালীর কলাপড়া এলাকায় মাছ ধরার ট্রলার ডুবিতে ৮৮ জেলে নিখোঁজ রয়েছে। সোমবার থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে শুরু করবে। শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রমরত নিম্নচাপটি সামান্য উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর ও দুর্বল হয়ে রবিবার সন্ধ্যায় সীতাকু- ও তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় সুস্পষ্ট লঘুচাপ আকারে অবস্থান করছিল। এটি বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমন্বয়ে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। সোমবার চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে এসব এলাকার কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি বর্ষণ হতে পারে। সূত্রটি আরও জানায়, নিম্নচাপের প্রভাবে রবিবার ঢাকায় ১৫ মিলিমিটার, ফরিদপুরে ২ মিমি, মাদারীপুরে ২২ মিমি, গোপালগঞ্জে ৩০ মিমি, ময়মনসিংহে ১ মিমি, নেত্রকোনায় ২ মিমি, চট্টগ্রামে ৪০ মিমি, সন্দ্বীপে ১৩৫ মিমি, সীতাকু-ে ৪৪ মিমি, রাঙ্গামাটিতে ১৪৯ মিমি, কুমিল্লায় ১১৭ মিমি, চাঁদপুরে ৮৪ মিমি, মাইজদীকোর্টে ৭৭ মিমি, ফেনীতে ৮২ মিমি, হাতিয়ায় ১৩৫ মিমি, কক্সবাজারে ১০ মিমি, কুতুবদিয়ায় ৫৫ মিমি, টেকনাফে ১৫ মিমি, সিলেটে ৬৯ মিমি, শ্রীমঙ্গলে ১৩৬ মিমি, খুলনায় ২৯ মিমি, মংলায় ১১ মিমি, সাতক্ষীরায় ৪ মিমি, বরিশালে ৩৯ মিমি, পটুয়াখালীতে ১৫ মিমি, খেপুপাড়ায় ১৬ মিমি ও ভোলায় ৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি দুর্বল হয়ে উপকূল অতিক্রম করায় আতঙ্ক কেটেছে। তবে রবিবার সারাদিনই চট্টগ্রামে ছিল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এবং মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। বৃষ্টির কারণে জনজীবনে ছন্দপতন ঘটে। পিছিয়ে যায় এদিনের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা। সোমবার মেঘ কেটে গিয়ে রোদের দেখা মিলতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। এদিকে, নিম্নচাপ কেটে গেলেও দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোর জন্য ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সঙ্কেত বহাল রাখা হয়েছে। বন্দর সূত্রে জানা যায়, রবিবার সকাল থেকে জেটিতে পণ্য ওঠানামা শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ চৌধুরী জানান, রবিবার সকাল ৬টার দিকে নিম্নচাপটি চট্টগ্রামের সীতাকু- দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করে। দুপুর নাগাদ পুরোপুরি অতিক্রমের পর বিপদ কেটে গেছে। তবে এর প্রভাবে কয়েকদিন ধরে চলতে থাকা বৃষ্টি রবিবার রাতেও অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস ছিল। সোমবার আকাশ পরিষ্কার হয়ে রোদ দেখা দিতে পারে। তিনি জানান, রবিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ৭৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এদিকে, নিম্নচাপের প্রভাবে অব্যাহত বৃষ্টিতে চট্টগ্রামে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেশি না হলেও দিনভর ছিল টিপ টিপ বৃষ্টি। এতে করে সড়কে যানবাহন চলাচল ছিল কম। অফিস যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। একান্ত প্রয়োজন না হলে সাধারণ মানুষ রাস্তায় বেরোয়নি। ফলে সড়কগুলো ছিল অনেকটাই ফাঁকা। নিম্নচাপের কারণে পিছিয়ে দেয়া হয় চট্টগ্রামসহ তিন শিক্ষাবোর্ড ও মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা। এদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উপস্থিতির হার ছিল খুবই কম। অনেক স্কুলেই ক্লাস হয়নি। নিম্নচাপের কারণে আবহাওয়া দফতরের সতর্কতা থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরে শনিবার পণ্য ওঠানামা ও বহির্নোঙ্গরে পণ্য লাইটারিং বন্ধ থাকলেও রবিবার সকাল থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে যায়। যথারীতি কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে বন্দর জেটিতে। বহির্নোঙ্গর অভিমুখেও ছুটতে থাকে লাইটার জাহাজগুলো। তবে সাগরে ঢেউ ও বাতাস থাকায় লাইটারিংয়ে স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের সদস্য (এডমিন এ্যান্ড প্লানিং) জাফর আলম জানান, নিম্নচাপে ঝড়ো হাওয়ার আশঙ্কা থাকায় শনিবারও জেটিতে জাহাজ ভেড়ার অনুমতি ছিল না। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় রবিবার সকাল ৮টা থেকে পণ্য ওঠানামা শুরু হয়। ভিড়তে থাকে বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষমাণ কন্টেনার জাহাজগুলো। ফলে বিকেল নাগাদ বন্দর পরিস্থিতি প্রায় পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যায়। নিজস্ব সংবাদদাতা, আমতলী (বরগুনা) থেকে জানান, গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকায় তালতলী সোকিনার এফবি মায়ের দোয়া নামের একটি মাছধরা ট্রলার ও ১৩ জেলে নিখোঁজ রয়েছে। রবিবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত ট্রলার ও জেলেদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। গত বুধবার রাতে উপজেলার তালতলী সোকিনা ঘাট থেকে মাছ ধরা ট্রলারটি ১৩ জেলে ও মালামাল নিয়ে গভীর সমুদ্রে চলে যায়। ঘূর্ণিঝড় নাডার খবরে তীরে আসতে শুরু করলেও তীরে আসতে পারেনি। গত তিন দিন ধরে ট্রলার ও জেলেদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নিখোঁজ জেলেরা হলোÑ আবদুল হাই মাঝি (৫০), ইউসুফ মাল (৪০), জামাল (৩৬), ইউসুফ হাওলাদার (৪৫), খালেক (৪৪), মুনসুর (৪৫), ইউসুফ শরীফ (৫০), জিয়াউল হক (২৮), ফারুক আকন (৩৭), সুলতান (৪৮) ও খোকন গাজী (৪১)। নিখোঁজ জেলেদের পরিবারের লোকজন উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। উপজেলার তালতলী ও নিদ্রার চর গ্রামে তাদের বাড়ি। এদিকে, নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূলীয় আমতলী-তালতলী উপজেলায় বিরামহীন বর্ষণ ও দমকা হাওয়াতে আমন ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার আমনের ক্ষেতের ধান মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। আমতলী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর দুই উপজেলায় আমনে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ১৯ হাজার হেক্টর আমন ধান ও ২শ’ হেক্টর সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) থেকে জানান, নিম্নচাপের প্রভাবে কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে মহিপুরের একটি মাছধরা ট্রলার ডুবির ঘটনা ছাড়াও পাঁচটি মাছধরা ট্রলারসহ ৬৫ জেলে নিখোঁজ রয়েছে। মহিপুর-আলীপুর এলাকার নিখোঁজ ট্রলার মালিক ও ইলিশের একাধিক আড়ত মালিক রবিবার বিকেলে এ খবর নিশ্চিত করেছেন। ডুবে যাওয়া ট্রলারের মালিক লতাচাপলীর খাজুরা এলাকার হাজী আব্দুল কাদের মাঝি জানান, তার এফবি শুকতারা-০২ ডুবে যাওয়ায় ওই ট্রলারের জেলেদের উদ্ধার করতে গিয়ে এফবি ভাই ভাই ট্রলার ডুবে তিন জেলে নিখোঁজ রয়েছে। এছাড়া আলীপুরের ইউসুফ কোম্পানির ১৮ জেলেসহ এফবি তামান্না, মহিপুরের জয় দেব বাবুর ২০ জেলেসহ এফবি মা-বাবা, মোঃ তোতা মিয়া হাওলাদারের ১৪ জেলেসহ এফবি তোতা এবং একই এলাকার ১০ জেলেসহ নাম বিহীন দুটি মাছধরা ট্রলার নিখোঁজ রয়েছে। এসব ট্রলারের মোট ৬৫ জেলের খোঁজ মেলেনি। স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল থেকে জানান, নিম্নচাপের প্রভাব কেটে যাওয়ায় রবিবার বেলা ১১টা থেকে বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটের লঞ্চ চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএয়ের নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগ কর্তৃপক্ষ। বরিশাল নদী বন্দরের নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপ-পরিচালক আজমল হোসেন মিঠু সরদার জানান, আবহাওয়া অফিস থেকে বরিশাল নদী বন্দর এক নম্বর সতর্ক সঙ্কেত জারি করা হয়। এরপর বেলা ১১টার পর থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বরিশাল আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক প্রণব কুমার রায় জানান, নিম্নচাপটি রবিবার সকাল ছয়টায় চট্টগ্রামের সীতাকু-ে উপকূল এলাকায় বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এজন্য বরিশাল অঞ্চলে আরও দুইদিন আবহাওয়া গুমোট থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। নিজস্ব সংবাদদাতা, লক্ষ্মীপুর থেকে জানান, লক্ষ্মীপুরে তিনদিনের টানা বর্ষণে জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাঝারি ধরনের টানা বর্ষণে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বাঞ্চানগর, জেবি রোড, শাখাঁরীপাড়া, মিয়া আবু তাহের সড়ক, সমাসেরাবাদ ও মাস্টারকলোনিসহ কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বেড়েছে জনদুর্ভোগ। বিশেষ করে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পড়ছেন বিপাকে। বৃহস্পতিবার মধ্য রাত থেকে রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলার ৫ উপজেলায় গুঁড়ি গুঁড়ি এবং মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হচ্ছে। এতে থেমে ধমকা বাতাসও বয়ে যাচ্ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতরের উপ-পরিচালক জানান কৃষিবিদ গোলাম মোস্তফা জানান, এ পর্যন্ত জেলায় সাত শ’ হেক্টরের শীতকালীন শাকসবজির ব্যাপাক ক্ষতি হয়েছে। ১১শ’ দু শ’ হেক্টরের উঠতি আমনের ক্ষতি হয়েছে। তবে বেসরকারী হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে।
×