ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুর্শিদাবাদ-মালদহ সীমান্তের কাছাকাছি বহু অস্ত্র তৈরির কারখানা ॥ আনা নেয়া করে জঙ্গীরা

চাঁপাই সীমান্তপথে ভারত থেকে আসে অস্ত্রের চোরাচালান

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৭ নভেম্বর ২০১৬

চাঁপাই সীমান্তপথে ভারত থেকে আসে অস্ত্রের চোরাচালান

ডি. এম. তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ॥ ভারত থেকে অস্ত্র আনা কোন ভাবেই রোখা যাচ্ছে না। সীমান্ত পথে প্রচুর অস্ত্র দেশে ঢুকছে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী কর্মকা-ে। এমনকি শুলশান ও শোলাকিয়াসহ ঢাকার একাধিক জঙ্গী হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র এসেছে সীমান্ত পথে। আসছে চাঁপাই সীমান্তের একাধিক পয়েন্ট হয়ে। প্রশাসনে এ নিয়ে তোলপাড় পড়ে গেছে। অস্ত্র সরবরাহকারী চার জঙ্গী সম্প্রতি ঢাকায় আটক হয়েছে। এরা শিবগঞ্জের সীমান্ত পথে বিশাল একটি অস্ত্র ও বিস্ফোরকের চালান নিয়ে আসে। তার মধ্যে থেকে ৭৮৭ ডেটোনেটর, গ্রেনেড তৈরির মূল উপকরণসহ নাইন এমএম পিস্তল ও একটি ম্যাগজিন নিয়ে ঢাকায় পৌঁছে। এরা ঢাকাগামী একটি কোচযোগে যাবার পথে রাজশাহী ও নাটোর থেকে জঙ্গীদের একটি বড় ইউনিট (২০ থেকে ২৫ জন) একই বাসে ঢাকা যায়। একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে নানান অভিযানে বর্তমানে ঢাকায় বড় জঙ্গী আটক/নিহত হওয়ার পর জেএমবি অনেকটাই বেকায়দায় পড়ে। তাই জঙ্গীদের একটি বৈঠকে যোগদানের জন্য এসব জঙ্গীরা ঢাকা গেছে। ধরাপড়া জঙ্গীদের বয়ানে বেরিয়ে এসেছে ইতোপূর্বেও তারা ঢাকায় একাধিক গোপন বৈঠক করেছে। খবরে আরও জানা গেছে একই গাড়িতে শিবগঞ্জের বাড়িতে ছুটি ভোগের পর একদল যুবক কর্মস্থলে যাচ্ছিল। এদের সকলেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য। এদের সংখ্যাও বেশ কয়েকজন। জঙ্গীদের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক রয়েছে কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে অস্ত্র বহনকারী জঙ্গীরা গত বুধবার রাতে দূরপাল্লার বাসে চড়ে রাজধানীর দারুস সালামে নেমে অপেক্ষা করছিল। এরা পুলিশ দেখে দৌড়ে পালিয়ে যাবার সময় মাত্র চারজন দুটি ব্যাগসহ ধরা পড়ে। অন্যরা পালিয়ে যায়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে, এদের মাধ্যমে চাঁপাই সীমান্ত থেকে ছোট মিলন ওরফে তারা, গুলশান হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড তৈরির কাঁচামাল ও অস্ত্র সরবরাহ করে। তারাই তামিম চৌধুরী ও মারজানের কাছে এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক পৌঁছে দেয়। অস্ত্র বহনকারী নব্য জিএমবির মিজান, তাহের, সেলিম ও তৌফিক ঢাকাতে আটক হবার পর পুলিশের কাছে অনেক নতুন নতুন তথ্য দিলেও তাদের নিয়ে আসা চালানের ব্যাপারে মুখ খোলেনি। বিশাল চালানের অংশ বিশেষ আটকের পর এখন পর্যন্ত পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি বাকি অস্ত্র, বিস্ফোরক, গোলাবারুদ চাঁপাইয়ের কোথায় রয়েছে বা রেখেছে। অপর একটি খবরে জানা গেণ্ডে গত তিনমাস ধরে যে সব চালান এসেছে তার সিংহভাগ ঢাকা পৌঁছেছে। জঙ্গীরা রাজধানীতে বড় ধরনের একটি অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতির আংশ হিসেবে এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক মওজুদ করছে বলে জানা গেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর অধীন গোয়েন্দা সংস্থা এসব গোপন সংবাদ সংগ্রহে অনেকটাই ব্যর্থ হলেও তারা মাঝে মধ্যে বিচ্ছিন্ন ভাবে অস্ত্র, মাদক সামগ্রী কিংবা জাল টাকা উদ্ধার করছে। পাশাপাশি জেলখানা সংলগ্ন একটি গোয়েন্দা সংস্থার (অফিস) প্রধান ও অন্য সদস্যরা এখন পর্যন্ত অস্ত্রের কোন চালান বা কোন জঙ্গীকে ধরতে পারেনি। সংস্থাটি তাদের কর্তব্যের বাইরে প্রভাব প্রতিপত্তি দেখিয়ে নানান ধরনের কাজ হুমকি ধমকি দিয়ে বেড়ালেও প্রকৃতপক্ষে কোন বড় চোরাকারবারি ও জঙ্গীকে চিহ্নিত করতে পারেনি। এখানে জঙ্গীদের প্রধান অর্থ যোগানদাতা একাধিক চোরাকারবারি রয়েছে। সম্প্রতি বটতলা হাট সংলগ্ন একটি বাড়ি থেকে অস্ত্রের বিশাল চালান আটকের পর বহু জাঁদরেল চোরাকারবারি সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করছে অথবা আত্মগোপনে রয়েছে। এখানে জঙ্গীদের দ্বিতীয় অর্থ যোগানদাতাদের মধ্যে রয়েছে একাধিক সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট ও রফতানিকারক। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শহর সংলগ্ন দেশের অন্যতম বৃহত্তর পশুর হাট বটতলা সংলগ্ন একটি বাড়ি থেকে খুবই উন্নতমানের ২২ পিস্তল, ১৩৬ রাউন্ড গুলি ও ৪৫ ম্যাগজিন উদ্ধার করে পুলিশ। ২৪ অক্টোবর সোমবার দুপুরের দিকে অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ। বাসাটি এক সামরিক কর্মকর্তার। সামরিক কর্মকর্তার বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল বাইরের কয়েক ব্যক্তি। উদ্দেশ্য ছাগলের খামার বানানো। একই সঙ্গে খামারের মালিক জেলার বিভিন্ন হাট ও বাড়ি থেকে ছাগল বকরি কিনে ঢাকা-চট্টগ্রামে ট্রাকযোগে পাঠাত। ট্রাকে ছাগল পাঠানোর আড়ালে থাকত অস্ত্রের চালান। যদিও পুলিশ অস্ত্র উদ্ধারের দিন বাড়ির তালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকেছিল। অস্ত্র উদ্ধার হলেও অস্ত্র ব্যবসায়ী বা মালিকদের কাউকে এখনও পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। অস্ত্র উদ্ধারের পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ির মালিক সার্জেন্ট শাহিনের সৎ মা রোকেয়া বেগম ও চাচাত ভাই শাকিল আহম্মেদকে আটক করে পুলিশ। পুলিশের ভাষ্যমতে দেড় বছর আগে কিছু বহিরাগত লোক ভাড়া নিয়ে ছাগল পালন ও ছাগল বকরি ব্যবসার আড়ালে অস্ত্র ব্যবসা করছিল। পুলিশ একই এলাকার সাইফুল ইসলাম নামের এক যুবককে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার মাধ্যমেই বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। সাইফুল ইসলাম এখন পুলিশের পলাতক তালিকায় রয়েছে। পুলিশের ধারণা সাইফুল ধরা পড়লে অনেক রহস্যের জট খুলে যাবে। কারণ গত দেড় বছর ধরে এই গ্রুপটি অস্ত্রের ব্যবসা করে আসছে। ধারণা করা হচ্ছে এই দেড় বছরে তারা সহস্রাধিক অস্ত্রের চালান রাজধানীতে পাঠিয়েছে। এমনকি গুলশান, শোলাকিয়াসহ ঢাকার একাধিক জঙ্গী হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র এই গ্রুপটির মাধ্যমে জঙ্গীদের হাতে পৌঁছে থাকতে পারে। তবে চাঁপাই পুলিশ সুপার টিএম মোজাহিদুল ইসলামের অভিমত, উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলা খারাপ চক্রের হাতে গিয়ে উঠত। যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা করছে তারাই এসব অস্ত্রের প্রধান খদ্দের। পুলিশ সুপার জানান, অস্ত্রের মালিকদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পেরেছেন তারা। ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পেরিয়ে যাবার পরেও কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। উল্লেখ্য, যে বাসা থেকে রেকর্ড অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে সেই বাড়ির অপর পারে, রাস্তার ধারের একটি বিশাল বাড়িতে এই শতাব্দী শুরুর প্রথম দিকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় বোমা বিস্ফোরণে তিন জন ঘটনাস্থলেই ও একজন হাসপাতালে নেবার পর মারা যায়। তাদের শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। পাকা বাড়ির বিশাল অংশ বিধ্বস্ত হয়। এক কথায় বিশাল এই বাড়ির মধ্যে বোমা তৈরির কারখানা ছিল। নিহতদের অধিকাংশ ছিল সীমান্তবর্তী চরাঞ্চলের লোক। এখানে তৈরি বোমা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো। ঘটনার পর মামলা হলেও কেউ গ্রেফতারও হয়নি। এই চাঞ্চল্যকর মামলাটি প্রভাবশালীদের তদবির ও চেষ্টায় ধামাচাপা পড়ে যায়। প্রশাসনের কাছে এখন এর কোন হদিস নেই। কাকতালীয়ভাবে বোমা বিস্ফোরণ ঘটনার প্রায় সোয়া যুগ পরে একই স্থানের কাছাকাছি রাস্তার অপর পারের একটি বাড়ি থেকে উদ্ধার হলো বিপুল অস্ত্রের চালান। উল্লেখ্য চাঁপাই শহর থেকে বটতলামুখী সড়কের বহুতলা মসজিদের কাছাকাছি রাস্তার দুই পাড়ে দুটি বাড়ির অবস্থান। বোমা বিস্ফোরিত বাড়ির মালিককে এখন আব্দুল কয়লা বা বোমা আব্দুল না বললে কেউ চিনতে পারবে না। বটতলাহাট সংলগ্ন একাধিক মহল্লা রয়েছে এই এলাকায়। এসব মহল্লার একটি বিরাট অংশ নানান অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত। এদের আবার শহরের একাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এরা এসব দলের ক্যাডার বা সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত। তবে এসব সন্ত্রাসী বা চোরাকারবারিদের প্রধান পছন্দের তালিকায় রয়েছে ক্ষমতাসীন দল। এরা দল বদল করতেও পটু। চাঁপাই জেলা শহরেরও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অতীতে কিংবা বর্তমানে যে কোন প্রয়োজনে এদের ব্যবহার করে আসছে। এদের মুখ্য ভূমিকা বা পেশা ভারত কানেকশন। এরা নানান ধরনের চোরাকারবারি কর্মকা-ে নিজেদের নিয়োজিত রাখে। বর্তমানে এরা মাদক ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নানান কর্মকা- করে থাকে। তবে মূল পেশা অস্ত্র ও মাদকের চোরাচালান ও নারী ও শিশু পাচার। এরা প্রশাসনের একটি অংশের সঙ্গেও গভীর ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখে। আর এসব কারণে এরা সীমান্ত পারাপারে খুবই দক্ষ। এদের দ্বিতীয় বাড়ি হচ্ছে ভারতের মালদহ বা মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন অঞ্চলে। কাকতালীয়ভাবে এদের যোগাযোগ রয়েছে সন্ত্রাসের জনপদ শিবগঞ্জ ও ভোলাহাটের সঙ্গে। গত কয়েক বছরে জামায়াত ও বিএনপির নানান ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত থাকায় এরা স্বাভাবিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকা-ের তালিকায় এসে পড়েছে। যে কোন ধরনের নাশকতার কর্মকা-ে দক্ষ হবার কারণে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এড়িয়ে সুবিধাজনক নিরাপদ স্থান হিসাবে বেছে নিয়েছে ভারতের মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলা। তাই মাসের সিংহভাগ সময় তরা এসব এলাকায় অবস্থান করলেও প্রয়োজনে সীমান্ত পেরিয়ে খুবই কম সময়ের জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করে। শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত বা চরাঞ্চলের ইউনিয়নের সংখ্যা প্রায় আটটির অধিক। এসব ইউপির অধিকাংশ যুবক ও মধ্যম বয়সের লোকজন অবস্থান করে ভারতে। বর্তমানে এরা জঙ্গীগোষ্ঠীর ঠিকানাতে অবস্থান করে। ভারতে অবস্থান করে নানান ধরনের অবৈধ ও বেআইনী কর্মকা- করে থাকে। বিনিময়ে পেয়ে থাকে চাহিদার তুলনায় অধিক অর্থ। যার মধ্যে কিছু নিজের কাছে রেখে মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে ঢুকে পরিবারের ভরণ পোষণে অর্জিত অর্থের সিংহভাগ দিয়ে যায়। বর্তমানে এই গোষ্ঠীটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে বেশ কটি জঙ্গী গোষ্ঠী। এদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে পাঠানো হয়ে থাকে নানান ধরনের অস্ত্র। এদের মাধ্যমেই গুলশান, শোলাকিয়াসহ একাধিক অভিযানে ব্যবহৃত অস্ত্র ও সর্বশেষ চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর সংলগ্ন বটতলা হাটের উদ্ধার করা ২২ পিস্তল পাঠানো হয়েছে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা। বটতলা হাটের অস্ত্র আটকের দিন মনাকষা সীমান্ত থেকে একটি পিস্তলসহ একজন অস্ত্র ব্যবসায়ীকে আটক করে বিজিবি। পরের দিন শিবগঞ্জের শিবপুর ছোটবিলা এলাকা থেকে র‌্যাব একটি বিদেশী পিস্তলসহ ৪টি ম্যাগজিন, চার পিস গুলির সঙ্গে তিনজনকে আটক করে। এরা হচ্ছে মোবারকপুর ইউপির কলাবাড়ী পুরাতল ব্রিজ সংলগ্ন মঙ্গনুল হকের ছেলে আসাদুল হক আসাদ, কানসাট কলাবাড়ীর আশরাফ রেজার ছেলে হেলিম রেজা ও কানসাট কাচারীবাড়ির মুসলিম আলীর ছেলে সাগর ইসলাম। এরা দীর্ঘদিন অস্ত্রের ব্যবসা করে আসছে বলে স্বীকার করেছে। পরের দিন এক অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে র‌্যাব ৭ লাখ রুপী (ভারতীয়) জাল নোট উদ্ধার করে। তার নাম সুমন আলী। লাহারপুর গ্রাম থেকে তাকে আটক করা হয়। চাঁপাইয়ের শিবগঞ্জ এলাকায় অস্ত্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে যাবে। অপরাধ জগতের সদস্যদের কাছ থেকে একের পর এক অস্ত্র, গুলি, মাদক দ্রব্য নতুবা ভারতীয় জাল নোট উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে অস্ত্র পাচার রুখতে বিএসএফ পদ্মা ও মহানন্দাতে অঘোষিতভাবে এখনই ভ্রাম্যমাণ যান্ত্রিক নৌকায় টহল জোরদার করেছে। কারণ চাঁপাই ও রাজশাহী মিলিয়ে পদ্মায় ৩৫ কিলোমিটার ও ভোলাহাটের কাছে মহানন্দায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে নদী পথের মধ্যবর্তী এলাকায় সীমান্ত রয়েছে। যদিও ভারতীয় এলাকায় বিএসএফ সীমান্ত চৌকি বৃদ্ধিসহ পাহারায় নিয়োজিত জনশক্তি কয়েকগুণ বাড়িয়েছে তার পরেও অস্ত্র আসছে। শিবগঞ্জ সীমান্তের মনাকষা, বিনোদপুর, সোনামসজিদ, কামালপুর ও ভোলাহাটের চামুসাসহ পোল্লাডাঙ্গা এলাকায় একাধিক ব্যক্তি ও চোরাকারবারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশের জঙ্গীদের আগ্রহেই বিহারের মুঙ্গের থেকে প্রায় শতাধিক দক্ষ অভিজ্ঞ কারিগরকে আনা হয়েছে মুর্শিদাবাদ ও মালদহের সীমান্ত এলাকায়। যেমন মালদহের কাছাকাছি ফারাক্কা থেকে শুরু করে আইহো পর্যন্ত ৩০টির অধিক অস্ত্র কারখানায় তৈরি হচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট থেকে ইংলিশ বাজার ও মালদহের আইহো কয়েক মিনিটের পথ। বিশেষ করে ভোলাহাট থেকে আইহো বাজার দেখা যায়। এই আইহো এখন ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের বড় ঘাঁটি। এদের তৈরি অস্ত্রের বড় বড় চালান কয়েক মিনিটের মধ্যে ভোলাহাটে পৌঁছলে এখানকার এজেন্টরা তা পৌঁছে থাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। ভোলাহাট জালাল উদ্দীনের আম বাগান দিয়ে হেঁটে কয়েক মিনিটের মধ্যে ভারতে যাওয়া যায়। আবার একইভাবে ভোলাহাটের রেশম বীজাগারের সামনে থানার ঘাট হয়ে মহানন্দা পার হলেই ভারতে পৌঁছা যায়। প্রতিদিন এই পথে শত শত লোক উভয় দেশে যাতায়াত করে থাকে। এদের অধিকাংশ মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী বলে নিশ্চিত করেছে এলাকার জনসাধারণ। এছাড়াও মালদহের গৌড়, খাজুরিয়া, কালিয়াচক, নিমতিতা, ওরঙ্গাবাদ সূতি ও মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জ, মুরারই, পাইকর, নলহাটি, মির্জাপুর, নবগ্রাম, ইসলামপুর, শেরপুর, খরগ্রাম, গোকন, দমতলা, হরিহরপাড়া, আমতলা, বেলডাঙ্গা এলাকায় অসংখ্য অস্ত্র কারখানা করা হয়েছে। এসব এলাকায় অস্ত্র কারখানা তৈরি হবার অনেক আগে থেকেই মাদক তৈরি ও পাইকারি বিক্রির দোকান রয়েছে। ক্রেতাদের সকলেই বাংলাদেশী। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা অঞ্চলে যে সব অস্ত্র কারখানা রয়েছে তা পদ্মা পেরিয়ে সরাসরি গোদাগাড়ী, চারঘাট, পবা ও রাজশাহী অঞ্চেেল প্রবেশ করছে। বিশেষ করে গোদাগাড়ীর খুবই কাছাকাছি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার অবস্থান। নাচোল বেশ নির্জন বরেন্দ্র এলাকা জঙ্গীদের দখলে রয়েছে। এইসব গ্রাম ও মহল্লায় বসবাসকারী অধিকাংশ পরিবার এসেছে ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে। তাদের আত্মীয় স্বজন এখনও মুর্শিদাবাদে রয়েছে। তাই নাচোল বরেন্দ্র অঞ্চলের অপরাধীরা অধিকাংশ সময় যে কোন ধরনের অপরাধ করে মুর্শিদাবাদে গিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে থাকে। এমনকি লালগোলা অঞ্চল হয়ে যে সব অস্ত্র, বিস্ফোরক বা মাদকদ্রব্য গোদাগাড়ী হয়ে আসে তাদের প্রধান আস্তানা ও গুদাম রয়েছে নাচোল অঞ্চলে। এমনকি যে সব জঙ্গীগোষ্ঠী বাংলাদেশে একই রুট দিয়ে প্রবেশ করে, তারা তাদের নিকট আত্মীয় নাচোলে অবস্থানকারীদের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়ে পরবর্তীতে গন্তব্য ঠিক করে। অপর জঙ্গী আস্তানা ভোলাহাটের মুশরীভূজা এলাকা। পুরো এলাকা জুড়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের বড় বড় আস্তানা রয়েছে। এখানেই বেড়ে উঠেছিল নব্য জেএমবি সারোয়ার। এই জঙ্গী আশুলিয়ার একটি আস্তানায় অভিযানের সময় নিহত হন। পাঁচতলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয়। ওই সময়ে তার নাম বলা হয়েছিল আব্দুর রহমান। তার সাংগঠনিক নাম ছিল শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। তার বাবা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও এলাকার সঙ্গে সাংগঠনিক যোগাযোগ ছিল। সে বহুবার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গেছে। উল্লেখ্য, ভোলাহাটের এই মুশরীভূজা গ্রামে এক সময়ে অস্ত্রধারীরা গণআদালত বসিয়ে বিরোধী পক্ষের বিচার করে সাজা দিত। এর আগেও মুশরীভূজা গ্রাম থেকে একাধিক ব্যক্তি জঙ্গীসম্পৃক্ততার দায়ে গ্রেফতার হয়েছে। অনেকের ধারণা সারোয়ারের নেতৃত্বে পরিকল্পনা মাফিক সাম্প্রতিক হামলাগুলো চালিয়েছিল জঙ্গীরা। এই সারোয়ারের নির্দেশেই ২২টি হামলা হয়েছিল। সেই মুশরীভূজাতে এখন পর্যন্ত গোয়েন্দা বিভাগ তেমন কোন অভিযান পরিচালনা করতে পারেনি। অনেকের ধারণা সারোয়ার জাহান মারা যাবার পর তার অনুসারীদের একটি বড় অংশ ভারতে পালিয়ে গেছে। তবে যে অংশটি এখানে রয়েছে তারা কিন্তু বসে নেই। সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সমান তালে। এদিকে ভারতের তদন্ত সংস্থা মুর্শিদাবাদ ও মালদহ অঞ্চলে জঙ্গীদের তৎপরতা ও বিহারের মুঙ্গের থেকে আসা কারিগররা যে স্টাইলে অস্ত্র তৈরি করছে তা খুবই আধুনিক। বিশেষ করে যে কোন বিদেশী অস্ত্রের আদলে হুবহু তারা অস্ত্র তৈরি করে ঠেলে দিচ্ছে বাংলাদেশে। পশ্চিমবঙ্গে একাধিক জঙ্গী গ্রেফতারের পর রিমান্ডে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এদের অস্ত্র তৈরি ও নিত্য নতুন ভারি অস্ত্র আনার ব্যাপারেও নেপাল সম্পৃক্ততা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া জঙ্গীদের নিয়ে নেপাল সফরের একাধিক নজির রয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। তবে ভারত থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্রের বড় বড় চালান নিয়ে আনার ব্যাপারে তারা একাধিক বৈধ স্থলবন্দর ব্যবহার করে। বিশেষ করে সোনামসজিদ, রহনপুর রেল বন্দর ও হিলি স্থলবন্দর ব্যবহার করে থাকে। রেলপথে গমের বস্তা ও পাথরের মধ্য দিয়ে এসব অস্ত্র সরাসরি গন্তব্যে পৌঁছে যায়। আর স্থলবন্দরের ব্যাপারে একশ্রেণীর ভারতীয় রফতানিকারককে হাত করে বৈধ পণ্যের আড়ালে অস্ত্রের চালান বাংলাদেশে আসছে। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা পশ্চিম বাংলার মালদহ ও মুর্শিদাবাদ এলাকার ওপর নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি বিএসএফ জলে স্থলে অঘোষিত পাহারা বা টহল বাড়ানোয় অধিকাংশ জঙ্গীঘাঁটি সরিয়ে দিনাজপুর ও কুষ্টিয়া, যশোর সীমান্তে সরে যাবার কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি বিহারের মুঙ্গের থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোক এনে অস্ত্র কারখানা চালু করেছিল সেগুলোও একই স্টাইলে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষ করে এনআইএ জরুরী ভিত্তিতে অভিযান দিয়ে একাধিক আস্তানা থেকে একাধিক জঙ্গীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা খুবই উদ্বেগজনক বলে দিল্লীর কাছে রিপোর্ট দিয়েছে। বাংলাদেশের সরকার ও আইন প্রয়োগকারীদের তৎপরতায় এখানকার বড় মাপের শতাধিক জঙ্গী পালিয়ে ভারতে অবস্থান করছে। সেই সঙ্গে দিনের পর দিন সাংগঠনিক তৎপরতা দিয়ে বিদেশের মাটিতে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গীরা সিদ্ধান্তে যে ছক এঁটেছে তা আরও ভয়াবহ। পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের কিছু এলাকাকে বেছে নিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করেছে। এসব এলাকায় তারা গোপনে দীক্ষা দিলেও এই মুহূর্তে কোন ধরনের বাহ্যিক তৎপরতা বা এ্যাকশানে যাবে না তারা এমন সিদ্ধান্ত নতুনভাবে নিয়েছে। তারা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া যুবকদের দলে টানার চেষ্টা করছে। তাদের ভিশনের অন্যতম টার্গেট হচ্ছে বাংলাদেশের সামনের জাতীয় নির্বাচন। যখনই হোক না কেন সেই লক্ষ্যে তারা সদস্য সংগ্রহ করে নানা ধরনের নাশকতামূলক ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করে তুলছে। নির্বাচনের আগে এদের বাংলাদেশে ঢোকাবে। সে জন্য ইতোপূর্বে তাদের কর্মকা- নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যেসব এলাকা একেবারে চিহ্নিত হয়ে পড়েছে সেই এলাকা ছেড়ে ঘাঁটি গাড়ছে ভিন্ন জেলাতে। ইতোমধ্যে তারা ভারতীয় জঙ্গী গোষ্ঠী, এমনকি বিছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। ইতোমধ্যেই এখানকার পালিয়ে যাওয়া জঙ্গী গোষ্ঠীর নেতারা উচ্চ পর্যায়ের টিম গঠন করে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ সফর করেছে। উদ্দেশ্য নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলা। ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশী জঙ্গীগোষ্ঠী বড় ধরনের সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেছে। এই মুহূর্তে তারা বড় ধরনের কোন হামলা বা অপারেশন না করে নীরবে অবস্থান করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার দৃষ্টি ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করছে। তবে এসব জঙ্গীগোষ্ঠীর নেতারা ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশ সফরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। উদ্দেশ্য অর্থ ও অস্ত্র সহযোগিতা সংগ্রহ করা। একই সঙ্গে তাদের ওপর সদয় থাকা।
×