ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে রসরাজ বলির পাঁঠা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৭ নভেম্বর ২০১৬

সরকারের ভাবমূর্তি  নষ্ট করতে রসরাজ বলির পাঁঠা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার জন্য মৎস্যজীবী রসরাজ দাসকে বলির পাঁঠা বানিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে পরিকল্পিতভাবে হিন্দু সম্প্রদায় ও তাদের মন্দিরে হামলা করা হয়েছে। সিনিয়র আইনজীবী সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম এ মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় আটক রসরাজ দাসকে আইনী সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি। রসরাজকে আদালতে হাজির করা হলে কোন আইনজীবীকে তার পক্ষে দাঁড়াতে না দেয়ায় তার মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ হয়েছে বলে মনে করে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি। আইনজীবীগণ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে সরকারকে সত্য উদঘাটন করে অপরাধীদের বিচারের জোর দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া আইনজীবীদের পক্ষ থেকে শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হবে বলে জানানো হয়েছে এবং এ ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের এবং গ্রেফতার হওয়া রসরাজ দাসকে আইনী সহায়তা এবং প্রয়োজন হলে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি তাদের পাশে থাকবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও মহিলা পরিষদের প্রতিনিধিরা ঘটনা পরিদর্শন শেষে রবিবার প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন প্রকাশকালে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির রুমে আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। এদিকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু পল্লীতে হামলার ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ সারাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে হাইকোর্টের এ রিট আবেদনে। এর আগে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও মহিলা পরিষদের প্রতিনিধিরা নাসিরনগর পরিদর্শন করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, যেভাবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে তা বানচাল করার জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের চিহ্নিত শত্রু এবং তাদের সহযোগীরা রামুর সাম্প্রদায়িক হামলা থেকে আরম্ভ করে একের পর এক জঙ্গী, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটাচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্র্মূল কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল শেখ হাসান আরিফ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক শাহরিয়ার কবির এবং মহিলা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক রাখি দাসপুরকায়স্থ। রসরাজকে আইনী সহায়তা দেয়া হবে উল্লেখ করে ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, গত ৩ নবেম্বর রসরাজকে আদালতে হাজির করা হলে সেখানেও এক সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার সৃষ্টি হয়। রসরাজের বিরুদ্ধে শতাধিক আইনজীবী দাঁড়ালেও তার পক্ষে কোন আইনজীবীকে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। নির্মূল কমিটির এক আইনজীবী রসরাজের পক্ষে ওকালতনামা নিতে চাইলে তাকেও ওকালতনামা নিতে দেয়া হয়নি। রসরাজকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা না করে ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আইনজীবী নিয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেয়া আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। রসরাজের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, অবিলম্বে রসরাজকে ঢাকায় এনে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা দরকার। কেউ সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ছড়িয়ে এ বিচার যাতে প্রভাবিত করতে না পারে সেজন্য রসরাজের রিমান্ড চ্যালেঞ্জ করে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এ মামলা ঢাকায় স্থানান্তর করা প্রয়োজন। ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, গত ২৯ অক্টোবর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার জেলার নাসিরনগর উপজেলার হরিণাবেড় গ্রামে এক তরুণ মৎস্যজীবী রসরাজ দাস ধর্ম অবমাননামূলক ছবি ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়েছে, এমন এক গুজব ছড়িয়ে স্থানীয় কয়েকটি মৌলবাদী সংগঠন মাইকে প্রচার করে এবং সমাবেশ করে এলাকায় এক ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। ইতিপূর্বে কক্সবাজার রামুতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে যেভাবে জনৈক বৌদ্ধ যুবক উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুক এ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছেলে ফটোশপে পবিত্র কোরান অবমাননার ছবি সেঁটে দিয়ে এলাকায় সাম্প্রদায়িক উন্মদনা ছড়িয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মন্দির ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছিল ঠিক একইভাবে নাসিরনগরে রসরাজ ম-লকে বলির পাঁঠা বানিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গী মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মহাজোট সরকার তথা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এলাকায় হিন্দুদের মন্দির ও বসতবাড়িতে হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করে। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, ৫ নবেম্বর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্র্মূল কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বে সংগঠনের এক প্রতিনিধি দল উপদ্রুত এলাকা সফর করে তাদের অভিজ্ঞতা একই দিন সাংবাদিকদের এবং পরদিন ৬ নবেম্বর সুপ্রীমকোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশনকে জানিয়েছেন। তাদের প্রতিনিধিদলে লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, মানবাধিকার নেতা আরমা দত্ত, কলাম লেখক সৈয়দ মাহবুবুর রশিদসহ নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের সঙ্গে এ্যাডভোকেট রাখী দাশ পুরকায়স্থ ও রেখা চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদেরও একটি প্রতিনিধিদল উপদ্রুত এলাকা সফর করেছেন। এরা আমাদের জানিয়েছেন, অভিযুক্ত রসরাজ দাস ক্লাস ফোর ফাইভ পড়া এক দরিদ্র মৎস্যজীবী যুবক, যার ফটোশপ বা তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। স্থানীয় এমপি ও পশুপালন মন্ত্রী ছায়েদুল হকও ৫ নবেম্বর গণমাধ্যমে বলেছেন রসরাজের মতো গরিব লেখাপড়া না জানা ছেলে এমন কাজ করতে পারে না। দোষীদের শাস্তি চেয়ে রিট ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুপল্লীতে হামলার ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ সারাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে হাইকোর্টের এ রিট আবেদনে। রবিবার সকালে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না এই রিট আবেদন করেন। ভবিষ্যতে এসব ঘটনা রোধে সব ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না এ সংক্রান্ত রুল জারির নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে। এতে স্বরাষ্ট্র সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, পুলিশের আইজিপি, চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাপ্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি), নাসিরনগর থানার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বিবাদী করা হয়েছে।
×