ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জলি রহমান

অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ রেমিটেন্স

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ৬ নভেম্বর ২০১৬

অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ রেমিটেন্স

বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে অতি ক্ষুদ্র একটি দেশ হলেও তার অর্থনীতির গতিপ্রবাহ দিন দিন বিশ্বকে হতবাক করছে।বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কয়টি ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে তার একটি রেমিটেন্স বা প্রবাস আয়। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের উপর ভর করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ এখন ২৯ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। প্রবাসে কর্মরত নাগরিকদের স্বদেশে প্রেরিত অর্থকে রেমিটেন্স বলে। তাদের অর্জিত অর্থের একটা অংশ ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠায়। এই অর্থ কেবল তাদের পরিবারের প্রয়োজনই মেটায় না, তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে এবং নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের অর্থনৈতিক গতিশীলতার ক্ষেত্রে রেমিটেন্স গুরুত্বপূর্ণ নিউক্লিয়াস হিসাবে কাজ করে। রেমিটেন্স আমাদের মোট অভ্যন্তরীণ আয় বা জিডিপির ৩০ ভাগ। জাতীয় অর্থনীতির তাই অন্যতম চালিকাশক্তি এই রেমিটেন্স। রেমিটেন্সের উপর ভর করেই এখন আমরা পদ্মা সেতুসহ অনেক বড় বড় প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করার সাহস পাচ্ছি বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের জন্য আমাদের কনফিডেন্স বেড়েছে। এখন পদ্মা সেতুসহ অনেক বড় বড় প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করার সাহস পাচ্ছি। আমারা এতদিন সহজ শর্তে ছোট ছোট ঋণ নিতাম। এখন আমরা বড় ঋণ নেয়ার সাহস অর্জন করেছি। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন। এ সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। প্রবাসীদের যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। গত চার বছর ধরে গড়ে ১৪ দশিমক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০০৮ সালের ৮৯৮ কোািট ডলার থেকে তা ২০১২ সালে ১ হাজার ৪১৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০১৩ সালে রেমিটেন্স অর্জনে বেশ ভাল অগ্রগতি হয়েছে। এ পর্যন্ত ১১ দশিমক ২ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। বিগত বছরটিতে প্রায় ১৩০০ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ কম। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম চারমাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিটেন্স এসেছে ৪২৫ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের এই চার মাসে রেমিটেন্স এসেছিল ৫০৩ কোটি ডলার। বর্তমানে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আবারো সর্বোচ্চ রেমিটেন্স অর্জন করতে পারবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের করা প্রবাস আয়ের বিনিয়োগ জরিপে দেখা যায়, রেমিটেন্স আসে এমন পরিবারগুলোর মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫৭ শতাংশ পরিবার প্রবাস আয় থেকে কোন অর্থ বিনিয়োগ করেন না। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে রেমিটেন্স এসেছে ১৫.৮ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা (১ ডলার= ৮০ টাকা ধরে)। এর ৫৭ শতাংশ হিসেবে ৭২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে শুধুমাত্র ভোগ ব্যয়ে। যা চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বা এডিপির তিন চতুর্থাংশের বেশি। অন্যদিকে, বাকি ৪৩ শতাংশ পরিবারও যে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে এমনটি নয়। তাদের বিনিয়োগের প্রায় পুরোটাই, ৭৪.৭৮ শতাংশ ব্যয় হয় দালানকোঠা নির্মাণ, ফ্ল্যাট বা জমি কেনায়। অর্থাৎ বিনিয়োগ করা পরিবারগুলো যে অর্থ ব্যয় করছে তাতে অর্থনীতিতে টাকার আনাগোনা বাড়লেও মানুষের কাজের সুযোগ বা কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। আমাদের গ্রামগুলোতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। প্রতিটি গ্রামেই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। হয়ত সব জায়গায় রাস্তাঘাট ভাল নয়। তবে যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন গ্রামে আর ঝুঁপরি ঘর দেখা যায় না। প্রতিটি ঘরই এখন সিআই সিটে নির্মাণ করা হচ্ছে। আর এর পেছনে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি এক বৈঠকে প্রবাসীরা দেশের যে কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিতসহ বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরা হয়েছিল এগুলো হলো- দ্বৈত নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা, ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ইস্যু করা, সিলেট বিমানবন্দরে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ লাউঞ্জ খোলা, বিমানবন্দরে সবধরনের হয়রানি বন্ধ করা এবং বিদেশে মারা যাওয়া বাংলাদেশীদের মরদেহ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় দেশে ফেরত আনা প্রভৃতি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে প্রবাসীদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি প্রদান এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে অধিক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাতে প্রবাসীদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ৩১ প্রবাসী বাংলাদেশীকে রেমিটেন্স এ্যাওয়াার্ড প্রদান করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাজধানীর বাংলা একাডেমিতে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিটেন্স এ্যাওয়ার্ড-২০১৫’ এ এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির বলেন, হুন্ডি বা অন্যান্য পন্থায় টাকা পাঠালে তা দেশের ক্ষতি। এটি কালো টাকা। এগুলো জঙ্গী, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও খারাপ কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই প্রবাসীদের হুন্ডির মাধ্যমে টাকা না পাঠিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। কর্মসংস্থান তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। এক্ষেত্রে সরকারকে দেখতে হবে প্রবাস আয় গ্রহণ করা ৫৭ শতাংশ পরিবার কেন বিনিয়োগ করে না। হতে পারে এসব পরিবার ঋণগ্রস্ত, হতে পারে এদের শিক্ষার হার কম, কোথায় কিভাবে কি ধরনের বিনিয়োগ করতে হবে তা তারা বুঝতে পারছেন না। অন্যদিকে বিনিয়োগ করা পরিবারগুলো কেন উৎপাদনশীল খাতে (যেসব খাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়) বিনিয়োগ করছে না সেটিও খুঁজে বের করা উচিত। বাংলাদেশ পণ্য রফতানিতে গত দেড় দশক ধরে গড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এই ভাল অবস্থাও বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারেনি। রফতানি আয় দিয়ে গড়ে ৬৫ শতাংশ আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হয়েছে। এমন অবস্থা হলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ধস নেমে আসত। বরং রেমিটেন্স প্রাপ্তিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি মিটিয়েও প্রতিবছর উদ্বৃত্তের পরিমাণ বাড়ছে। শ্রমবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের মতে, কাজের প্রয়োজনে বাংলাদেশের যেকোন লোক বিদেশে যাচ্ছেন এবং অর্থ পাঠাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই অদক্ষ শ্রমিক। এসব বিদেশগামী শ্রমিককে যথাযথ প্রশিক্ষনের মাধ্যমে দক্ষ করে তারপর বিদেশ পাঠানো হলে তাদের আয় অনেক বেড়ে যাবে। ফলে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়বে। প্রতিবেশী ভারত বিশ্বের প্রধান রেমিটেন্স আয়কারী দেশ। এরপরই রয়েছে চীন। রেমিটেন্স আয়ে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মতো প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা ও নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। যেহেতু বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ কম তাই কর্মসংস্থান বাড়াতে বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। এক্ষেত্রে প্রবাসীদের জন্য বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। এতে করে কর্মসংস্থান যেমন তৈরি হবে তেমনি প্রবাসীরা তাদের পাঠানো অর্থও উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে অনেক বেশি লাভবান হতে পারবে। অথচ বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো কোন উদ্যোগ নেই। যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে চাইছে তাতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।
×