ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ৬ নভেম্বর ২০১৬

ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট

‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ ছাগল বাংলাদেশে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নতুন আশার নাম। এই জাতের ছাগল কালো এবং দেখতে বেশ বড়সর হওয়ায় এই ছাগলকে ‘বাংলার কালো বাঘ’ বলে থাকে। ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট বা বাংলার কালো ছাগল। বৈজ্ঞানিক নাম ঈধঢ়ৎধ ধবমধমৎঁং যরৎপঁং. বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাগলের উন্নত জাতগুলোর মধ্যে ব্ল্যাক বেঙ্গল, বারবারি, বিটাল, বোয়ের, যমুনা পাড়ি, কিকু, স্প্যানিশ, সাহেলিয়ান ইত্যাদি প্রধান। আশার খবর হলো, বাংলাদেশ এ জাতের ছাগলের জিনগত বৈশিষ্ট্য এবং ডিএনএ পরীক্ষা করে প্রায় দশ বছর গবেষণা করেছে। ২০০৭ সালে প্রায় দশ বছর গবেষণার পর জাতিসংঘের আণবিক শক্তিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বিশ্বের ১০০টি জাতের ছাগলের ওপরে তাদের প্রতিবেদনে ব্ল্যাক বেঙ্গলকে অন্যতম সেরা জাত হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ এবং মাংস উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম বাংলাদেশ -এ খবরটি যে কাউকে আশাবাদী করবে। বিশ্ববাজারে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া কুষ্টিয়া গ্রেড হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এটিও একটি আশাজাগানিয়া খবর। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যে, দেশে কমবেশি আড়াই কোটি ছাগল আছে, যার পচানব্বই শতাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল। দেশের প্রায় এক কোটি লোক ছাগল পালনের সঙ্গে যুক্ত যা একক কোন প্রাণী পালনের রেকর্ড। বলা হয়ে থাকে ছাগলের দুধ হলো অনেক রোগের মহৌষধ। বিশ্বসেরা বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল বাংলাদেশের নিজস্ব জাতের এই ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল হয়েছে বিশ্বসেরা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএও এবং আন্তর্জাতিক আণবিক গবেষণা কেন্দ্রের (আইএইএ) সর্বশেষ মূল্যায়ন অনুযায়ী, এই ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রাণিবিদ্যাবিষয়ক স্বীকৃত জার্নালগুলোতে ব্ল্যাক বেঙ্গল নিয়ে শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই গবেষণার মাঝ পর্যায়ে ২০০৭ সালের ২০ মার্চ জাতিসংঘের সংবাদ সংস্থা ইউএন নিউজ-এ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। কিন্তু এখানেই রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রাণিসম্পদ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বসতি।’ সে বছরই আইএইএর ওয়েবসাইটে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে বিশ্বসেরা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ব্ল্যাক বেঙ্গল পালনে দিনবদল ছাগল পালন বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। দেশের প্রায় সব জেলাতেই কমবেশি ছাগল পালিত হয়। তবে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলায় ব্ল্যাক বেঙ্গল পালনের সাফল্যে উজ্জীবিত হচ্ছেন আশপাশের অন্যান্য এলাকার জনগণ। ব্ল্যাক বেঙ্গল গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিয়ে এ জাতের ছাগল প্রতিপালনের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও অন্যতম আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। ব্যবসার জন্য ছাগল পুষতে হলে ব্ল্যাক বেঙ্গল সবচেয়ে লাভজন। এই জাতের ছাগলের মাংসের চাহিদা ব্যাপক। উন্নত পদ্ধতিতে ব্ল্যাক বেঙ্গল পালন করে অনেক খামারি সুখের মুখ দেখেছেন। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন প্রযুক্তির দিক থেকেও বাংলাদেশ বেশ সফলতা দেখিয়েছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় ২০০৮ সালে মাথায় ছাগল পালনের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং ছাগলের মৃত্যুহার কমানোর জন্য ‘লিফট’ নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বেসরকারী সংস্থা ওয়েব ফাউন্ডেশন সফলতা পেয়েছে। ব্ল্যাক বেঙ্গল পালনের উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলো হচ্ছে- খোরাক তুলনামূলকভাবে কম লাগে, পালনের জন্য অল্প জায়গা হলেই চলে, মূলধনও মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে থাকে, রোগবালাই কম। সঠিক পরিচর্যা, চিকিৎসা ও লালন-পালনে প্রশিক্ষিত হলে কোন খামারিই ব্ল্যাক বেঙ্গলের খামার করে লোকসানের কবলে পড়েন না। ব্ল্যাক বেঙ্গল থেকে পাওয়া যায় উন্নত মানের চামড়া, যা পৃথিবীর যে কোন জাতের ছাগলের চামড়া থেকে গুণগত মানসম্পন্ন। খাসির মাংস খেতে খুবই সুস্বাদু। ছাগলের লোম থেকে তৈরি হয় উন্নত মানের পশম। ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের এ ছাগল খুবই রোগ প্রতিরোধী এবং সহজে রোগবালাই হয় না, আর হলেও এর চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত সহজ। তাই এখন আর শুধু চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর ইত্যাদি জায়গায় নয় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে গ্রামে গ্রামে মানুষ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের খামার গড়ে তুলেছেন। প্রায় সবার মুখেই এখন হাসির ঝিলিক। উটকে যেমন বলা হয়ে থাকে মরুভূমির জাহাজ তেমনি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে বলা হয়ে থাকে ‘গরিবের গাভী।’ ভূমিকা রাখবে অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ছাগলের ভা-ার। প্রতিবছর এদেশ এ জাতীয় ছাগল থেকে প্রায় সোয়া লাখ টন মাংস পেয়ে থাকে। যা মোট মাংসের প্রায় ২৫ শতাংশ। এই প্রজাতির ছাগল যেমন দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে তেমনি দ্রুত বড় হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যানিমেল ব্রিডিং এ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেন ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল নিয়ে ২০ বছর ধরে গবেষণা করছেন। তাঁর মতে, ‘তুলনা করে দেখা গেছে, অন্যান্য জাতের ছাগলের চেয়ে এর মাংসের স্বাদ ভাল। এ কারণে বিশ্ববাজারে এর চাহিদা বেশি। এর চামড়া এত উন্নতমানের যে বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলোর চামড়াজাত পণ্য তৈরিতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া ব্যবহৃত হয়।’ ব্ল্যাক বেঙ্গলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। শুধু বাংলাদেশ নয় অনেক দেশেই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের খামার অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অন্যান্য দেশের মানুষ যেমন- ভারত, ইরান, সৌদি আরবের অনেক কৃষক জমি চাষ করার পাশাপাশি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের খামার করে অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট সফলতা পেয়েছেন। জানা গেছে, উন্নত দেশের খামারিরা প্রায় আড়াই হাজার ব্ল্যাক বেঙ্গলের একটি খামার থেকে মাসে কম হলেও ১০ থেকে ১২ হাজার ডলার আয় করতে পারেন। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় সাত-সাড়ে সাত লাখ টাকা। আফ্রিকার মাসাই ছাগল, ভারতের যমুনাপাড়ি ছাগল এবং চীনা জাতের ছাগলের মাংস ও দুধের পরিমাণ ব্ল্যাক বেঙ্গলের চেয়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি। তবে ওই তিন জাতের ছাগলের ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ বাচ্চা জন্মের পরই মারা যায়। অপরদিকে ব্ল্যাক বেঙ্গলের বাচ্চার মৃত্যুর হার ৫ থেকে ১০ শতাংশ আর বংশ বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। তাই বিজ্ঞানীরা সামগ্রিক উৎপাদনশীলতার বিচারে এটিকে সেরা জাত হিসেবে নির্বাচন করেছেন। কোন একটি খামারে কাজ শুরু থেকে তৃতীয় বছরেই ছাগল বিক্রিযোগ্য হয়। এসব কারণে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন রীতিমতো একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। খামারি, সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও গবেষকদের মতে- বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি সঠিক সেবা প্রদানের সুযোগ যেমন ঋণ সুবিধা, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা, যথাযথ প্রশিক্ষণ, বাজার সৃষ্টি ইত্যাদিতে এগিয়ে আসে তবে কোন খামারি লোকসানের কবলে পড়বে না। ব্ল্যাক বেঙ্গল পালনে সরকার যদি যথাযথ মনোযোগ ও গুরুত্ব দেয় তবে দেশের সকল জেলার প্রতিটি গ্রামের মানুষ অতি লাভজনক এই খামার গড়ে তুলতে আরও উৎসাহী হবে। এর ফলে খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতি পূরণ হবে। উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা, শ্রমের যথাযথ ব্যবহার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পুষ্টিমান বজায় রাখা, উপযুক্ত বাজার সৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে ব্ল্যাক বেঙ্গল পালন খুলে দিতে পারে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।
×