ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ এম আর খান

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৬ নভেম্বর ২০১৬

চলে গেলেন জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ এম আর খান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে শিশু চিকিৎসার পথিকৃৎ ও জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ এম আর খান আর নেই। শনিবার বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে নিজের প্রতিষ্ঠিত রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত নানা জটিল রোগে কয়েক মাস ধরে ভুগছিলেন। ওই হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎ?সাধীন ছিলেন। তিনি স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ও একমাত্র মেয়ে দৌলতুন্নেসা ম্যান্ডিসহ অসংখ্য ছাত্র, বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। আজ রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় সেন্ট্রাল হাসপাতালে তাঁর প্রথম জানাজা, বেলা সাড়ে এগারোটায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় জানাজা, মিরপুরের শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন হাসপাতালে সাড়ে বারোটায় তৃতীয় জানাজা, উত্তরা উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বেলা দেড়টায় চতুর্থ এবং যশোরের শিশু হাসপাতালে রাত আটটায় পঞ্চম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। আগামীকাল সোমবার সাতক্ষীরার রসুলপুরের ফুটবল মাঠে সকাল দশটায় শেষ জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে বলে মরহুমের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। ডাঃ এম আর খানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ এবং তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী। সেন্ট্রাল হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ এম এ কাশেম জানান, বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা নিয়ে অধ্যাপক ডাঃ এম আর খান দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। সম্প্রতি দেশে ও দেশের বাইরে তার দুই-তিনটি অস্ত্রোপচার হয়েছিল। প্রয়াত এই চিকিৎসকের মরদেহ সেন্ট্রাল হাসপাতালের মরচুয়ারিতে রাখা হবে বলেও জানান তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাসহ কয়েকজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডাঃ এম আর খানের চিকিৎসা চলছিল। অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ শনিবার সন্ধ্যায় জনকণ্ঠকে জানান, অধ্যাপক ডাঃ এম আর খান শনিবার বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গত কয়েক মাসে দেশে-বিদেশে অধ্যাপক ডাঃ এম আর খানের দেহে তিনবার অপারেশন করা হয়। এর প্রভাব পড়ে তাঁর শরীরে। পাশাপাশি হার্ট, উচ্চ রক্তচাপ ও নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত সমস্যা ছিল। শেষ দিকে তাঁর কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ । ডাঃ এম আর খান বাংলাদেশে শিশু চিকিৎসার পথিকৃৎ। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট সাতক্ষীরার রসুলপুরে। এম আর খান নামে তিনি পরিচিত হলেও তার পুরো নাম মোঃ রফি খান। বাবা আব্দুল বারী খান ও মা জায়েরা খানমের চার ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন মেঝ। ১৯৫৩ সালে এমবিবিএস পাস করেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে। তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিটিএমএ্যান্ডএইচ, এমআরসিপি, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিসিএইচ, ঢাকার পিজি থেকে এফসিপিএস, ইংল্যান্ড থেকে এফআরসিপি ডিগ্রি লাভ করেন। এম আর খান পেনশনের টাকা দিয়ে গড়েন ডাঃ এম আর খান-আনোয়ারা ট্রাস্ট। দুস্থ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, তাদের আর্থিক-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে এ ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি নিরন্তর কাজ করেছেন। তাঁর উদ্যোগে গড়ে উঠেছে জাতীয় পর্যায়ের শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠা করেছেন শিশুস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। গড়ে তুলেছেন সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল, যশোর শিশু হাসপাতাল, সাতক্ষীরা ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, রসুলপুর উচ্চ বিদ্যালয়, উত্তরা উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতাল, নিবেদিতা নার্সিং হোমসহ আরও বহু প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া তিনি দেশ থেকে পোলিও দূর করতে উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছেন, কাজ করেছেন ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠান ‘আধূনিক’-এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে। সাতক্ষীরা সদরের প্রাণনাথ উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় (পিএন স্কুল) থেকে ১৯৪৩ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকে ১৯৪৫ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন। এরপর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে এমবিবিএস পাস করে সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন তিনি। ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি দূর সম্পর্কের আত্মীয় আনোয়ারা বেগম আনুর সঙ্গে এম আর খানের বিয়ে হয়। পরের বছর উচ্চ শিক্ষার জন্য সস্ত্রীক বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। বিদেশে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার কেন্ট ও এডিনবরা গ্রুপ হাসপাতালে সহকারী রেজিস্ট্রার ও রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে আবার দেশে ফিরে পরের বছর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (শিশুস্বাস্থ্য) পদে যোগদান করেন। এম আর খান ১৯৬৯ সালে আবার সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগে যোগ দিয়ে পরের বছর অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে তিনি ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিসিন এ্যান্ড রিসার্চ-আইপিজিএমআরের (বর্তমানে বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক ও ১৯৭৩ সালে এই ইনস্টিটিউটের যুগ্ম-পরিচালকের দায়িত্ব পান। অধ্যাপক ডাঃ এম আর খান ১৯৭৮ সালের নবেম্বরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে অধ্যাপক ও পরিচালকের পদে যোগ দেন। এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাঁর ছিল অনন্য ভূমিকা। ওই বছরই আবার আইপিজিএমআরের শিশু বিভাগের অধ্যাপক হন। ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক ডা. এম আর খান তার সুদীর্ঘ চাকরিজীবন থেকে অবসর নেন। এম আর খান শিশুরোগ চিকিৎসা ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে প্রকাশিত প্রকাশনায় তার জীবনপঞ্জি অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯১ সালে ম্যানিলাভিত্তিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের এ্যাসোসিয়েশন অব পেডিয়াট্রিকস থেকে পদক পান তিনি। ১৯৯২ সালে তিনি শেরে বাংলা জাতীয় স্মৃতি সংসদ স্বর্ণপদক গ্রহণ করেন। তিনি দেশ-বিদেশে উল্লেখযোগ্য মেডিক্যাল কলেজের উচ্চতর ডিগ্রি/সম্মান দেয়ার ক্ষেত্রে পরীক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন। বাংলাদেশে শিশু স্বাস্থ্যের ওপর এফসিপিএস, ডিসিএইচ ও এমসিপিএস পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ধানম-ির ৩ নম্বর সড়কের বাসভবনে নিজ চেম্বারে প্রতিষ্ঠা করেন নিবেদিতা মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট এ্যান্ড রিসার্চ লিমিটেড। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া প্রায় সব সম্পত্তিই দান করেছেন সাতক্ষীরা জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে তার ৩৭টি গবেষণাধর্মী রচনা প্রকাশিত হয়েছে। শিশুরোগ চিকিৎসা সংক্রান্ত সাতটি বই লিখেছেন, যেগুলো দেশে ও বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানতুল্য এই মানুষটির জীবনী স্থান পেয়েছে কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল হু ইজ হু অব ইন্টেলেকচুয়ালে। পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, আন্তর্জাতিক ম্যানিলা এ্যাওয়ার্ডসহ আরও অনেক পুরস্কার। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় অধ্যাপক ও প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এম আর খানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শনিবার এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতি চিরদিন ডাঃ খানের শিশুরোগ চিকিৎসায় অবদানের কথা গভীরভাবে স্মরণ রাখবে। তার মৃত্যুতে জাতি একজন বিখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞকে হারাল। রাষ্ট্রপতি ডাঃ খানের বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান এবং সেই সঙ্গে তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর শোক বার্তায় বলেন, এম আর খান স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ছিলেন একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর মৃত্যুতে জাতি, বিশেষ করে শিশুরোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হলো। প্রধানমন্ত্রী শোক বার্তায় শিশু পরিচর্যার ক্ষেত্রে এবং শিশু রোগ চিকিৎসা শিক্ষায় এম আর খানের অবদান স্মরণ করেন। এইচটি ইমাম ॥ দেশের সেরা শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জাতীয় অধ্যাপক এম আর খানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমাম। ডাঃ খানের মৃত্যুকে তিনি দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণীয় নয়। এইচটি ইমাম, মরহুমের শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করেন, তাঁরা যাতে দ্রুত শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন সেই কামনা করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ॥ শোক বার্তায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ডাঃ এম আর খানের মৃত্যুতে বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হলো। এ দেশের স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়নে তাঁর অবদান জাতি চিরদিন স্মরণ করবে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। জাতীয় অধ্যাপক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ এম আর খানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, ভূমি সচিব মেছবাহ উল আলম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের(বিএমএ) সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মাহমুদ হাসান, মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান ও যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ এম এ আজিজ প্রমুখ।
×