ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তদন্ত করছে গোয়েন্দা সংস্থা

হিন্দু বাড়ি, মন্দিরে হামলা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৬ নভেম্বর ২০১৬

হিন্দু বাড়ি, মন্দিরে হামলা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গীবিরোধী অভিযান যখন সফলতার মুখ দেখছে, ঠিক তখনই হঠাৎ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে, মন্দিরে হামলা, ভাংচুর আগুন দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর ঘটনাগুলো ঘটছে কেন তার তদন্ত করছে গোয়েন্দা সংস্থা। জঙ্গীগোষ্ঠীর মতো গুপ্তহত্যার স্টাইলে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু বাড়ি ও মন্দিরে হামলা ও আগুন দিয়ে চলেছে উগ্র মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। এর নেপথ্যে কোন দেশী-বিদেশী অদৃশ্য মহল কলকাঠি নেড়ে জঙ্গীগোষ্ঠীর সঙ্গে মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে গোপন যোগসূত্র তৈরি করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার প্রতিবাদে উগ্র মৌলবাদী ধর্মান্ধরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ না করে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করে। এই ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক প্রহরা অবস্থায় থাকার পর আবারও তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়ার ঘটনাটি যে পরিকল্পিতভাবে দেশের ভেতরে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর নীলনকশা তা আর কারও বুঝতে বাকি নেই। শুধু তাই নয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির, প্রতিমা ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুরের মতো ফরিদপুর, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, সোনাগাজি, বাগেরহাট, নেত্রকোনায়ও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাসিরনগরের ঘটনাটিকে আকস্মিক মনে করা হলেও একের পর এক ঘটনাগুলোকে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশব্যাপী হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, মারধর, বাড়িঘর, ব্যবসাবাণিজ্যালয়ে লুটপাট, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর নীল নকশার মাধ্যমে সংখ্যা লঘুদের ভিটেমাটি ছাড়া করার মাধ্যমে ভোটের রাজনীতি কায়েম করার চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে, যা মাঝে মধ্যেই নানা কায়দায় মাথাচাড় দিয়ে উঠছে। এর ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু পরিবার দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন। এরপর জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোকে উস্কে দেয়া হয়। দেশব্যাপী জঙ্গী গোষ্ঠীর যে ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। তারই ধারাবাহিকতায় নব্য জেএমবির উত্থান ঘটে তা গুপ্তহত্যা, হামলার ঘটনাগুলো সংক্রামক ব্যাধির মতো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সারাদেশে বিদেশী নাগরিক, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মাযাজক, পুরোহিতদের ওপর হামলা চালিয়ে গুপ্তহত্যা ও মন্দির, গির্জায় হামলা চালানো হয়। ২০১৩ সাল থেকে এই ঘটনা অব্যাহত থাকার পর রাজধানীর গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গী হামলার পর সরকারের কঠোর অবস্থান ও নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হস্তে জঙ্গী দমন করে দেশের মধ্যে শান্তি ও স্বস্তির সুবাতাস ফিরিয়ে আনার জন্য তৎপরতা অব্যাহত আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে নাসিরনগরসহ দেশব্যাপী হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে, মন্দিরে, প্রতিমায় হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ঘটানো হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ বছরে ৯ লাখ হিন্দু কমেছে। হিন্দু জনগোষ্ঠী দেশত্যাগ করার ফলে হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পেছনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার প্রেক্ষাপটে যে পরিসংখ্যান রয়েছে তাতে দেখা গেছে, ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশ বিভাগের পর হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার পর হিন্দুর সংখ্যা শতকরা ২২ ভাগে নেমে আসে। পাকিস্তান কায়েম হবার পর সংখ্যালঘুদের উপর নানান ধরনের চাপ ও নির্যাতনের ফলে তখন থেকেই নিরবে অনেকে বাংলাদেশ ছেড়ে গেলে ১৯৬১ সালে মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৮.৫ ভাগে নেমে আসে। পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রশ্নে ১৯৭১ সালে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পর তখন বাংলাদেশের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছিল সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। দেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারি সাক্ষ্য দেয় যে, তখন দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা কমে আসে শতকরা ১৩.৫ ভাগে। ১৯৮১ সালে সেই সংখ্যা নেমে আসে শতকরা ১২.১৩ ভাগে। আর ১৯৯১ সালে সেটি দাঁড়ায় শতকরা ১১.৬২ ভাগে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও নির্বাচনকালীন সময়ে এই হামলা ও সহিংসতা অব্যাহত থাকার কারণে ২০০১ সালে দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র শতকরা ৯.৬ ভাগে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তখনকার আদমশুমারি অনুযায়ী, তখন বাংলাদেশে অন্তত ১ কোটি ১৩ লাখ ৭৯ হাজারের মতো সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ছিল। আর ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় শতকরা ৮ ভাগে নেমে আসে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংখ্যালঘুদের উপর বারবার হামলা ও নির্যাতনের ঘটনায় এই সংখ্যা এখন প্রকৃত হিসেবে কত, সেটি বলা কষ্টকর হলেও, ধারণা করা যায়, এটি শতকরা ৫ ভাগের মধ্যে নেমে এসেছে। ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের শুমারির দেখা যায়, ২০০১ সালের আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৮ লাখ ১৬ হাজার ৫১ জন। ২০১১ সালের শুমারিতে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৯ জনে। বাংলাদেশে যে কোন ধরনের নির্বাচন ও রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ঘটনা ঘটলেই প্রথম শিকার হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অন্যতম হাতিয়ার। রাজনৈতিক দলগুলো হীনস্বার্থ উদ্ধারের জন্য, সংখ্যালঘুদের সহায় সম্পত্তি লুটপাট ও ভোগ-দখল করার জন্য, সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়া করার জন্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক অজুহাতে সংখ্যালঘুদের উপর বিভিন্ন সময়ে নির্মম নির্যাতন, অত্যাচার, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ অনেক মানবতা বিরোধী কাজ করা অব্যাহত আছে। এই ঘটনাগুলো বার বার ঘটার পেছনে রাজনৈতিক অপশক্তিগুলোর ইন্ধন থাকার পাশাপাশি রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার বদলে এক ধরনের রহস্যময় নীরবতা কাজ করছে বলে বরাবরই অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের স্বাধীনতার সময় থেকে যেভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে নানা কায়দায়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গী গোষ্ঠীর বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে সেই জঙ্গীগোষ্ঠীই এখনও আবার নতুন কায়দায় তৎপর হয়। জঙ্গীগোষ্ঠী নতুন কায়দায় বিদেশী নাগরিক, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ও ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা, হামলা করে আসছে। এখন আবার সেই ধারাবাহিকতায় ঠিক একই কায়দায় এখন আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে আক্রমণের ঘটনাগুলো ঘটছে তাও একই সূত্রে গাঁথা কিনা তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে রসরাজ নামে এক হিন্দু যুবক তার ফেসবুকে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় আঘাত হানার অভিযোগে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরও সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে, মন্দিরে, প্রতিমা ভাংচুর আগুন দেয়ার ঘটনাটি নতুন করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চক্রান্ত কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রসরাজ নামের সেই হিন্দু যুবকটিকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে সে কি তার ফেসবুক এ্যাকাউন্টে এক ধর্মাবলম্বীর পবিত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ছবির উপর আরেক ধর্মাবলম্বীর কোন ছবি এঁকেছে (ব্যঙ্গচিত্র), যাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে? এক ধর্মাবলম্বীর ছবির উপর আরেক ধর্মাবলম্বীর ছবি এঁকে (ব্যঙ্গচিত্র) স্ট্যাটাস দেয়ার মতো আইটি পারদর্শিতা আছে কিনা সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাকে। তার ফেসবুক স্টেটাস দেয়ার বিষয়টি সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, যুবটিকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরপরও কেন আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে উগ্র মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী? দায়ী যুবকটি দোষী সাব্যস্ত হলে আইনানুযায়ী তার যথাযথ শাস্তি দেয়ার উদ্যোগ নেয়ার পরও হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর হামলার ঘটনাটি কি তাহলে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর ষড়যন্ত্র? সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য উগ্র মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে উস্কিয়ে দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায় ও তাদের মন্দিরের উপর হামলা চালিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মতো সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর ষড়যন্ত্রের খেলায় মেতে উঠতে কোন অশুভ মহল পর্দার অন্তরাল থেকে কলকাঠি নাড়ছে কিনা তা তদন্ত করে দেখছে গোয়েন্দারা।
×