ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি খুঁজতে গিয়ে দুই কন্যা হলেন আবেগাপ্লুত

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৬ নভেম্বর ২০১৬

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি খুঁজতে গিয়ে দুই কন্যা হলেন আবেগাপ্লুত

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ জেলখানায় বসে পরিবারের সদস্যদের কাছে নিজের হাতে লেখা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কয়েকটি চিঠি পড়তে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তাঁরই দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাবার বন্দী জীবনে থাকার কক্ষ ও ব্যবহৃত তৈজসপত্র দেখার সময় তাঁদের চেহারায় বিষাদের ছাপ ফুঠে ওঠে। কখনী গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, কখনী মাঝারি বৃষ্টির মধ্যেই ঢাকার পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনের সময় পুরো স্মৃতি মনে করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার চোখে-মুখে বেদনার নীল রং ছিল স্পষ্ট। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই শনিবার বিকেলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা ও ভাগ্নে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। কারাগারে প্রবেশ করেই প্রধানমন্ত্রী প্রদর্শনীর জন্য রাখা ১৪৫টি দুর্লভ আলোকচিত্র দেখার পর সোজা যান বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে। প্রথমেই সেখানে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। এরপর জাতির পিতা বাঙালী জাতির স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘসময় যে কক্ষটিতে বন্দী থেকেছেন তা ঘুরে ঘুরে দেখেন। বিশেষ করে কারাবন্দী থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লাগানো কামিনী ও সফেদার গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তাঁর দুই কন্যা আবেগে জড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত চৌকি, টেবিল, চেয়ার, খাবার পাত্র, ভাঙ্গা চায়ের কাপ, সিলভারের কেটলিসহ তৈজসপত্র দেখতে গিয়ে আবেগে জড়িয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এসব জিনিসপত্র স্পর্শ করে তাঁর পিতার স্পর্শ নেয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় দু’বোনের চোখেই ছিল অশ্রুতে ভেজা। বৃষ্টির মধ্যে এই আবেগাক্রান্ত পুরনো স্মৃতি মনে হয় যেন আকাশটাও কাঁদছে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার চেহারায় বিষাদের চাপ আর সব হারানোর বেদনা যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। এরপর জাতির পিতার অজু করার স্থান ও রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত ঘরটিও ঘুরে ঘুরে দেখেন তাঁরা। বঙ্গবন্ধু কারা স্মৃতি জাদুঘর থেকে বেরিয়ে প্রধানমন্ত্রী পুরাতন কারাগারের নক্সা দেখেন। এ সময় একজন কারা কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে নক্সার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। এখান থেকে প্রধানমন্ত্রী যান জাতীয় চার নেতা কারা স্মৃতি জাদুঘর ‘মৃত্যুঞ্জয়ী সেলে’। সেখানে প্রবেশের মুখেই রয়েছে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর লাশ হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত যে জায়গাটিতে মরদেহ রাখা হয়েছিল সান বাঁধানো সেই স্মৃতি চিহ্ন। জাতীয় চার নেতা কারা স্মৃতি জাদুঘরে প্রবেশের আগে সামনে সারিবদ্ধভাবে নির্মিত চার জাতীয় নেতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মৃত্যুঞ্জয়ী সেলের প্রথম কক্ষ, যে কক্ষে ৩ নবেম্বর কালরাতে ঘাতকরা জাতীয় চার নেতাকে একসঙ্গে জড়ো করে অত্যন্ত নিষ্ঠুর পৈশাচিক কায়দায় গুলি ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল, সেই কক্ষের সামনে এসে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। সারিবদ্ধভাবে তিনটি কক্ষে জাতীয় চার নেতারা যেখানে থাকতেন, সেসব ঘরে প্রবেশ করে তাঁদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রও ঘুরে ঘুরে দেখেন তাঁরা। কক্ষটিতে প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী দুর্লভ কিছু আলোকচিত্র নিয়ে তৈরি করা গ্যালারি পরিদর্শন করেন। এখানে ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর কারাবরণের সময় থেকে নানা সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রায় ১৪৫টি দুর্লভ আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে। দেশ গঠনের নানা কার্যক্রম, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সফর, বঙ্গবন্ধুর টানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাংলাদেশে ছুটে আসাসহ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাসহ পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নানা সময়ের স্মৃতিকাতর ছবিগুলোও ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে খুঁটে খুঁটে দেখেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া কারাগারে প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশের মাত্র চার-পাঁচ হাত দূরেই বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত চশমা ও তামাকের পাইপের প্রতীকী স্থাপত্য নির্দশনও প্রত্যক্ষ করেন তাঁরা। কারাগার পরিদর্শন শেষে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানার চেহারায় বেদনার চাপ ছিল স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী কারা পরিদর্শনের সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেনÑ শেখ রেহানার পুত্র রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্থানীয় সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম, সাবেক এমপি ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সাবেক কূটনীতিক এ কে আবদুল মোমেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাত, সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন প্রমুখ। উল্লেখ্য, ১৭৮৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে নির্মিত হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। প্রথমে এটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নামে পরিচিত ছিল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ইংরেজ, পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নানা ঘটনার সাক্ষী। চলতি বছরের জুলাই মাসে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুরে স্থানান্তর করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। দেশের প্রাচীনতম এবং এক সময়ের সর্ববৃহৎ কারাগার পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এখন শুধুই ইতিহাস। ২২৮ বছর পর পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সাধারণ জনগণের প্রদর্শনের জন্য ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ জেল ও জার্নি নামের সংগঠন।
×