ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

পঁচাত্তরের ৩ ও ৭ নবেম্বরের অভিশাপ

প্রকাশিত: ০৪:১১, ৬ নভেম্বর ২০১৬

পঁচাত্তরের ৩ ও ৭ নবেম্বরের অভিশাপ

আজ ৬ নবেম্বর। আগামীকাল ৭ নবেম্বর, পঁচাত্তরের এই দিনে তথাকথিত বিপ্লবের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানীকরণের পথ পাকাপোক্ত হয়। দুইদিন আগে পেরিয়ে গেল তিন নবেম্বর। এদিন ১৫ আগস্টের হত্যাকারীরা বঙ্গভবনে বসে হুকুম দিয়ে বিশ্বে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হিসেবে পরিচিত জেলের ভেতরে পোশাক পরিহিত কয়েকজন সামরিক সদস্য হত্যা করে বাঙালী জাতির চার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। আজ এত বছর পরেও জাতির ওপর আরোপিত এই অভিশাপ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। অভিশাপের বোঝা জাতির মাথা থেকে নামাতে হলে সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার দিকে যেমন তাকাতে হবে, তেমনি সেই অশুভ শক্তির সুবিধাভোগী, প্রতিনিধি ও প্রতিভূ, যারা এখনও রাষ্ট্র ও রাজনীতির বুকের ওপর পাথর চাপা হয়ে আছে তাদের সঠিকভাবে চিনতে হবে এবং সব জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। শুরুতেই তিন নবেম্বরের ঘটনার ওপর একটু আলোকপাত করি। ’In the middle of confusion, the telephone rang. When I picked it up, I heard a man say- I am DIG Prison. I would like to talk to HonÕble President.’ ইংরেজী এই উদ্ধৃতিটি বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ও পলাতক খুনী মেজর আবদুর রশিদের। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান সাংবাদিক মাসকারেনহ্যাসের লিখিত- ‘বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থের ৯২ পৃষ্ঠায় এভাবেই উদ্ধৃতিটির উল্লেখ আছে। ১৯৭৫ সালের ২ নবেম্বর দিবাগত রাতের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে গুলি ও বেয়নেট চালিয়ে হত্যা করা হয়। একাত্তরে এই চার নেতার নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। তাদের একমাত্র অপরাধ ছিল তারা বঙ্গবন্ধু ও বাঙালী দর্শন এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জায়গা থেকে এক কদমও নড়তে চাননি। দোষ ছিল তারা ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের সঙ্গে আপোস করতে চাননি। অকল্পনীয় ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলার মাটি এবং মানুষের ভেতর থেকে সংগৃহীত আকাক্সক্ষা ও চেতনাকে সম্বল করে বঙ্গবন্ধু যে রাষ্ট্রীয় দর্শন এবং আদর্শকে প্রস্ফুটিত করেছিলেন, সেগুলোকে হৃদয় দিয়ে ধারণ করেছিলেন এই চার জাতীয় নেতা। ৬ দফার সংগ্রাম, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন- সর্বত্রই চার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক সহচর ও সহযোগী। বঙ্গবন্ধুকে তারা যতটা চিনেছিলেন, অন্য আর কেউ ততটা চিনতে পেরেছিলেন কিনা সন্দেহ। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এরাই পারতেন বাংলাদেশকে সঠিক পথে ধরে রাখতে, যে পথ রচিত হয়েছিল একাত্তরের ৩০ লাখ মানুষের রক্তের মূল্যে এবং ২৪ বছর ধরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ফসল হিসেবে। এই চার নেতা বেঁচে থাকলে একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত, মুসলিম লীগ ও চৈনিকপন্থীদের এমন ভয়াবহ উত্থান হতে পারত না। যুদ্ধাপরাধী নিজামী-মুজাহিদরা মন্ত্রী হয়ে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজের পতাকা গাড়িতে উড়িয়ে তার অবমাননা করতে পারত না। দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পর রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহও তার অন্তর্দ্বন্দ্বের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এই অমোঘ সত্যটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক উঠতি নেতা সেদিন না বুঝলেও একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকরা ঠিকই বুঝেছিল। পঁচাত্তরের ২ নবেম্বর রাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে মাসকারেনহ্যাস তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী খুনী মোসলেম উদ্দিন ও তার দল ওই রাতে জেলখানায় প্রবেশ করলে বঙ্গভবন থেকে ১৫ আগস্টের খুনী মেজরদের একজন মেজর রশিদ টেলিফোনে ডিআইজি প্রিজনকে নির্দেশ দেন, মোসলেম উদ্দিনকে যেন কোনরকম বাধা না দেয়া হয়। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এমন নজিরবিহীন ভয়ঙ্কর নির্দেশ শুনে ডিআইজি প্রিজন হতভম্ব হয়ে সরাসরি বঙ্গভবনে টেলিফোন করেন প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাককে। খোন্দকার মুশতাকের কাছ থেকে একই রকম হুকুম শুনে ডিআইজি অসহায় হয়ে সব কিছু নিয়তির ওপর ছেড়ে দেন। এভাবেই ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের মাটিকে অভিশপ্ত এবং কলঙ্কিত করা হলো দ্বিতীয়বারের মতো মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানে। জেল হত্যাকা-ের পর ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে। এ বিষয়ের ওপর প্রচুর লেখালেখি এবং বিশ্লেষণ হয়েছে। বিচারও হয়েছে বলা যায়। ৭ নবেম্বরের পর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের ওপর পা রেখে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু পঁচাত্তরের অভিশপ্ত ঘটনাবলীর পরিণতি থেকে আমরা এখনও বের হতে পারিনি। আবার অভিশপ্ত ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া রাজনীতি ও এর সুবিধাভোগীরা দ্বিধাহীনভাবে লাজ-লজ্জাহীন হয়ে এখনও অভিশপ্তের টুপি মাথায় দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ভাবখানা এমন, যেন বলতে চায়- যা করেছি ঠিক করেছি, আমাদের ঠেকায় কে? এই বাস্তবতার মধ্য দিয়েও বাংলাদেশ এগোচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম আশাবাদী হচ্ছে। তবে শঙ্কা কিছুতেই কাটছে না। তাই নবেম্বর এলেই ৩ ও ৭ নবেম্বরের ঘটনা মনে পড়লে মনে হয় ১৫ আগস্ট থেকে শুরু করে এসবই একই সূত্রে গাঁথা এবং এর বেনিফিশিয়ারি রাজনীতি ও তার প্রতিভূরা এখনও সেই উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টায় রত। ৭ নবেম্বরের তথাকথিত বিপ্লবের পরে আমরা কি দেখলাম? দেখলাম মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের ওপর পা দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান অল্পদিনের মধ্যেই বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন। রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনাবাহিনী প্রধান এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান একের ভেতরে চার। মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাহাত্তরের সংবিধান থেকে সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, দর্শন, অনুভূতি এবং চেতনা উন্মেষকারী সকল শব্দ, বাক্য ও ধারা-উপধারা বাতিল করে দিলেন। সেখানে এমন কিছু শব্দ ও বাক্যের সংযোজন করলেন, যাতে আগামী প্রজন্মের মানুষ বুঝতে না পারে এ দেশে একদিন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধে আমাদের বিরুদ্ধে হানাদার বা আক্রমণকারী বাহিনী হিসেবে ছিল পাকিস্তান। জিয়াউর রহমান কর্তৃক সামরিক অধ্যাদেশের ফলে যে সংবিধান পাওয়া গেল তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জন্মের সব জায়গা নেই হয়ে গেল, মুক্তিযুদ্ধের দর্শনে অনুপ্রাণিত হওয়ার উৎসস্থল বলতে আর কিছুই থাকল না। ফল যা হওয়ার তা-ই হলো। মুক্তিযুদ্ধ ও তার নায়ক-মহানায়ক, যারা হতে পারতেন জাতির রোল মডেল, তারা নতুন প্রজন্মের সামনে থেকে হারিয়ে গেলেন। গর্ব করার মতো সবকিছু থাকার পরেও আমরা এতিম জাতিতে পরিণত হলাম। ধর্মান্ধতা, কূপম-ূকতা, অন্ধ বিশ্বাস, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, যা থেকে মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধ করলাম তা আবার প্রবল শক্তি নিয়ে ফিরে এলো। জাতীয় মানসকাঠামো তৈরিতে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা প্রধান অনুঘটক হিসেবে আবির্ভূত হলো। এর ফলে পাকিস্তানের সময় পূর্ব বাংলা, সাধারণ মানুষের ভেতর তখন কতটা ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা ছিল, তার থেকে অনেক বেশি ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা ফিরে এলো বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে। পঁচাত্তরের পর দুই সামরিক শাসক ও তাদের প্রতিভূ জামায়াত-বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে ওই একই নীতি অনুসরণ করেছে বিধায় বাংলাদেশের জন্য আজ সবচেয়ে বড় অভিশাপ উগ্র ধর্মান্ধতা, যার হাত ধরে জঙ্গীবাদের উৎপত্তি ঘটেছে। জঙ্গীবাদের রাজনৈতিক গডফাদার জামায়াত রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয় জিয়াউর রহমান কর্তৃক বাহাত্তরের সংবিধানের ৩৮ ও ১২ অনুচ্ছেদ বাতিলের মধ্য দিয়ে। জামায়াতের প্রয়াত আমির গোলাম আযম স্বাধীনতার আগ মুহূর্তে পালিয়ে যায়। পাকিস্তান ও লন্ডনে বসে সে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন শুরু করে। ৩ ও ৭ নবেম্বরের অভিশাপ হলো- এহেন গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন বাতিল না করে ১৯৭৮ সালে জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশে ফেরত আসার সুযোগ পায়। এর থেকে আরও বড় অভিশাপ হলো- ৩০ লাখ শহীদের রক্ত মাটি থেকে শুকাবার আগে এভাবে গোলাম আযম ফিরে এলো; কিন্তু তখনকার জিয়াউর রহমানের সরকার বলতে পারল না যে, বাংলাদেশে প্রবেশের আগে আনুষ্ঠানিকভাবে গোলাম আযমকে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন বাতিল করতে হবে। আজকে ২০১৬ সালে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে বিএনপির অবস্থান ও ভূমিকা, বিচার প্রসঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির দিকে তাকালে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন বাতিল না করে গোলাম আযম কেন ও কিভাবে এবং কি কারণে বাংলাদেশে প্রবেশ করার সুযোগ পেল তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অভিশাপের চরম বহির্প্রকাশ ও তার স্বরূপ আমরা দেখতে পাই ২০০১-২০০৬ মেয়াদে, যখন জামায়াতের দুজন মশহুর যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে বিএনপি মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিল। ২০১৩ সালে এসে ট্রাইব্যুনাল থেকে মাওলানা সাঈদীর মামলার রায় বেরোনের পর জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দেয় এবং শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে। জাতির ওপর এত বড় অভিশাপের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তারা আজও ৭ নবেম্বরে তথাকথিত বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন করে উল্লাসের সঙ্গে, ঘটা করে। ৪১ বছর পরে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও তারা সেই পঁচাত্তরের জায়গায় বসে আছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে তারা কোথায় নিতে চয় সেটি বাংলাদেশের মানুষকে বুঝতে হবে। ৭ নবেম্বরে যা ঘটেছে তাকে কি বিপ্লব বলা যায়? বিপ্লবের মূল উপাদান হলো তার শীর্ষ নেতার সুনির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা সৃষ্টি এবং সারাদেশের জনমানুষের তাতে অংশগ্রহণ। এর কোনটাই ৭ নবেম্বরে ছিল না। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কিছু উচ্ছৃঙ্খল সৈনিক সেনা ট্রাকে করে শহরে এসে ষড়যন্ত্রকারীদের জড়ো করা কিছু বেসামরিক লোক নিয়ে কয়েকটি সেøাগান দিলেই কি তাকে বিপ্লব বলা যায়? বিপ্লবের নেতার নাম কি, তার ট্র্যাক রেকর্ড এবং ক্রেডেনশিয়াল কি? এই তথাকথিত বিপ্লবের ফলে জনগণের মৌলিক কোন উপকার হয়েছে কি? আর সংহতি! কার সঙ্গে কার সংহতি হলো? এটা তো এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, ৭ নবেম্বরের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় এলেন তাদের সঙ্গে সংহতি হলো একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত, রাজাকার, আলবদরদের। যার ফলে ৭ নবেম্বরের জের ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন রাজাকার শিরোমণি শাহ আজিজুর রহমান এবং মন্ত্রী হলেন যুদ্ধাপরাধী জয়পুরহাটের আবদুল আলিম। পঁচাত্তরের অভিশাপ থেকে রাষ্ট্র এখনও মুক্ত হতে পারেনি বলেই ২০১৬ সালে এসে সাড়া জাগানিয়া সাফল্য ও মর্যাদা অর্জন করার পরেও মানুষ শঙ্কামুক্ত হতে পারছে না। লেখক : ভূ-রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×