ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাদুঘরে ডাকঘর!

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ৬ নভেম্বর ২০১৬

জাদুঘরে ডাকঘর!

বিলুপ্তপ্রায় বস্তুকে অনিবার্য বিস্মরণের পরিণাম থেকে বাঁচানোর জন্য তার নমুনা জাদুঘরে সংরক্ষণ করে থাকে স্মৃতিপ্রিয় ও সভ্যতামুখী মানুষ। তবে শুধু বস্তু নয়, বাস্তবতাকেও জাদুঘরে পাঠানোর কথা বলা হয় তা যতই বিমূর্ত হোক না কেন যেমন- বলা হয়ে থাকে দারিদ্র্যর ঠাঁই হবে জাদুঘরে। অর্থাৎ আমাদের দিনানুদৈনিক জীবন থেকে আমরা দারিদ্র্যকে হটাব, বাস্তবে তার দৃষ্টান্ত বিলুপ্ত হবে। ডাকঘর শুধু একটি ঘর তো নয়, এ এক বিশাল প্রতিষ্ঠান- সেটিও জাদুঘরের সীমিত কক্ষে নির্বাসিত হবে কিনা- এমন শঙ্কা অনেকের মনেই উঁকি দিতে শুরু করেছে। ডাকঘরের কাজের পরিধি একেবারে সীমিত নয়, তবু চিঠি আদান-প্রদানের জন্যই মূলত ডাকঘরের কদর। সেই কদর অবশ্য ভাটির দিকে বহুকাল হলো। কম্পিউটারে যখনই ইন্টারনেট সংযোগ এলো, মানুষ বৈদ্যুতিক ডাক বা ইলেকট্রনিক মেইল (ই-মেইল) মারফত মুহূর্তের মধ্যে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওই পাড়ে প্রিয়জনের কাছে একান্ত বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হলো। সেই থেকে ডাকঘর আর তেমন সমাদর পায় না। অপাঙ্ক্তেয়-অচ্ছুত হয়ে পড়েছে এককালে মানুষের প্রাণসখা ডাকহরকরারা। ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে/রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য যুগের সেই রানার আছে আজও কিছুটা ভিন্নভাবে। তবে এখন তার ছোটাছুটির ব্যস্ততায় যতি পড়েছে। ডাক পিয়নদের অপেক্ষায় আর পথ চেয়ে থাকে না কেউ। মন ভাঙ্গা আকুলতা নিয়ে আর কেউ বলে না- ‘চিঠি কেন আসে না, আর দেরি সয় না/ভুলেছো কি তুমি আমাকে, ভুলেছো কি নাম-ঠিকানা।’ মোবাইল, এসএমএস, ই-মেইল আর ফেসবুক, ভাইবার, ইমু, হোয়াটসআপ হাতে হাতে। এক নিমিষেই যুক্ত হওয়া যায় লাইভ কথোপকথনে। পত্রসাহিত্য বলে একটা টার্ম রয়েছে। যুগে যুগে মনীষীরা তাদের স্বজন, সতীর্থ ও বন্ধুদের কাছে লিখে গেছেন গভীর সব কথামালা যার সাহিত্যমূল্য অপরিসীম। বহু চিঠি উচ্চ মূল্যে নিলামে বিক্রি হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম বা শরৎচন্দ্র চট্টোপ্যাধায়ের কয়েক হাজার চিঠি সাহিত্যের সম্পদ। আত্মউদ্ঘাটনমূলক বা প্রয়োজন নির্ভর এসব পত্রে তাদের জীবনের অনবদ্য অনুভূতি উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেন। রবিঠাকুর ৫ হাজারের বেশি চিঠি লিখেছেন। যার মধ্যে প্রায় ৪ হাজার সাময়িক পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ৩ শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে তার পত্রে যোগাযোগ হয়েছে। এখন কি কোন লেখক আর পত্র লেখেন বন্ধু সাহিত্যিক কিংবা সম্পাদক বরাবরে? দেশের ডাক বিভাগের যে দশা হয়েছে তা সত্যিই করুণ। পরিসংখ্যান বলছে বিগত পনেরো বছরে চিঠি বিলির সংখ্যা কমে গেছে বিশ কোটি! আর আর্থিক লোকসান? বিগত সাত বছরে তা দাঁড়িয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকায়! ৯ হাজার ৮৮৬টি ডাকঘর প্রায় কর্মহীন, লোকসানের উদাহরণ হয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। ডাকঘরের যদি সত্যি সত্যি হৃদযন্ত্র থাকত তবে কবেই তার ক্রিয়াকলাপ রুদ্ধ হয়ে পড়ত। অবশ্য ডাকঘরের জাদুঘর-যাত্রা রোধ করতে হলে এখনই তৎপর হওয়া চাই। সরকার কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে, সেগুলোয় গতি আনা চাই। চীনের মতো পোস্টাল সার্ভিস আধুনিকায়ন ও ডিজিটালাইজেশন করা আমাদের দেশে কেন সম্ভব হবে না? টাকা লেনদেনের ই-ক্যাশ সেবাসহ অন্যান্য প্রযুক্তিগত ও নেটওয়ার্ক সেবা পাওয়া তাহলে সম্ভবপর হবে।
×