ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রং তুলিতে শিল্পাশ্রম

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৫ নভেম্বর ২০১৬

রং তুলিতে শিল্পাশ্রম

চুয়াল্লিশ বছর ধরে রং-তুলির আঁচড়ে শিশু-কিশোরদের মাঝে চিত্রকলার স্বপ্ন ছড়াচ্ছে প্রাচীনতম আর্ট স্কুল ‘শিল্পাশ্রম ললিতকলা একাডেমি’। বেসরকারী উদ্যোগে প্রথম প্রতিষ্ঠিত রাজশাহীর সবচেয়ে প্রাচীনতম আর্ট স্কুলটির পরিচালক চিত্রশিল্পী কবি আশফাকুল আশেকীন। চিত্রকলার নির্যাস আগ্রহীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতেই ’৭২ সালে তিনি আর্ট স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। রাজশাহী নগরীর মিয়াপাড়াস্থ পাবলিক লাইব্রেরীর পাশে খানসামার চর এলাকায় জলি ভিলার নিচতলার তিনটি কক্ষ নিয়ে শিল্পাশ্রম আর্ট স্কুল। একটি কক্ষে থাকে ছবি আঁকানোর সরঞ্জাম। অন্য দু’টি কক্ষে মাদুর বিছিয়ে শ্রেণীকক্ষ বানানো হয়েছে। কক্ষগুলোর দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে প্রাক্তন-বর্তমান শিক্ষার্থী এবং আশফাকুল আশেকীনের আঁকা কয়েকশ’ চিত্রকর্ম। এসব চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সামাজিক বৈষম্য ও গ্রাম-বাংলার নৈসর্গিক সবুজ প্রকৃতি। স্কুলটির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে কথা হয় আশফাকুল আশেকীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, নগরীর বরেন্দ্র কলেজ সংলগ্ন ‘উদয়ন’ নামের বাসা ভাড়া নিয়ে স্বাধীনতার পরের বছর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শিল্পাশ্রম ললিতকলা একাডেমি। প্রথমদিকে চিত্রকলা ছাড়াও শিল্পের বিভিন্ন শাখায় আগ্রহীদের ব্যবহারিক পাঠ দেয়া হতো। তিনি নিজেও চিত্রকলার শিক্ষক। সেই সময়েও ছবি আঁকায় আগ্রহীর অভাব ছিল না। এমন হয়েছে বাবা-মেয়ে একসঙ্গে এসে ছবি আঁকা শিখেছে। ওখানে পাঁচ বছর থাকার পর জলি ভিলা ভাড়া নেয়া হয়। এখানে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে রং-তুলির পাঠ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে এই স্কুলটিতে ৩০ থেকে ৪০ শিশু-কিশোর ছবি আঁকা শিখছে। তবে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা একশ’ ছাড়িয়ে যায়। তখন দুই কক্ষে শিক্ষার্থীদের জায়গা সংকুলান হয় না। হিজিবিজি (শূন্য থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী), পাঠশালা (তৃতীয় থেকে পঞ্চম), অনুশীলন (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম) ও নিরীক্ষা (নবম থেকে তদুর্ধ)- চারটি ভাগে শিক্ষার্থীদের ভাগ করে ছবি আঁকার পাঠ দেয়া হয়। সপ্তাহের বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার- তিন দিন স্কুল খোলা থাকে। তিনি ছাড়াও আরও দু’জন শিক্ষক রয়েছেন। তাদের একজন তারিক হাসান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর করেছেন। প্রায় দেড় যুগ আগে এক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় কিশোর তারিকের আঁকা ছবি মন কেড়েছিল আশফাকুল আশেকীনের। সেই অনুষ্ঠানে তাকে কাছে ডেকে ছবি আঁকা শিখতে ‘শিল্পাশ্রমে’ আসতে বললে রাজি হয় তারিক। বর্তমানে পড়াশোনা শেষ করে এখানেই তিনি শিশু-কিশোরদের ছবি আঁকা শেখান। অন্যজন হামিদা খাতুন। ১৪ বছর ধরে শিল্পাশ্রমে আছেন তিনি। এই স্কুলে শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন তিনশ’ টাকা। বছরের চার মাস শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব কম থাকে। তাদের বেতনের টাকায় বাসা ভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচ মেটে না। সে সময় শাড়ি, থ্রি-পিস ও বিছানার চাদরে হ্যান্ড প্রিন্টের কাজ করে খরচ চালাতে হয়। আশফাকুল আশেকীন বলেন, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নিয়ে এই স্কুল চালাই না। চিত্রকলার প্রতি ভালোবাসা থেকেই ছবি আঁকা শেখাই। ছবি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষা। ছবিতে আমরা অনেক কিছু বলতে পারি। শিশুদের ছবি আঁকতে বললে তাদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। তাদের মানসজগতে পরিবর্তন আসে, শিল্পের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। আমি তাদের ছবি আঁকতে বাধ্য করি না, আগ্রহী করে তুলি। এতেই তারা ভাল আঁকে। স্কুল-কলেজের ছেলেদের ছবি বিশ্লেষণ করতে দিই। ছবির ভেতরের ভাষা বুঝতে সাহায্য করি। আশফাকুল আশেকীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ডিগ্রী প্রথম ব্যাচের (তৎকালীন বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়) ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৮ সালে পড়াশোনা শেষ করে তিনি রাজশাহীতে আসেন। এর কিছুদিন পর রাজশাহী প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে অঙ্কন শিক্ষক নিযুক্ত হন। পরে পিএন সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে আর্ট শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছেন। ২০০২ সালে অবসর নেয়ার পর নিজের প্রতিষ্ঠিত আর্ট স্কুলে বাচ্চাদের ছবি আঁকা শিখিয়ে তার সময় কাটে। পাশাপাশি তার লেখা তিনটি কবিতার বই বের হয়েছে। বিভিন্ন চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতেও অংশ নিয়েছেন তিনি। ’৬৯-সালে তার ছাত্র এমএ কাইউমের সঙ্গে পাকিস্তান কাউন্সিলে প্রথম চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। শিশু-কিশোরদের আঁকা ছবি নিয়ে প্রকাশিত ‘আমিও’ নামের তিনটি বই সম্পাদনা করেছেন। -মামুন-অর-রশিদ/কায়কোবাদ খান, রাজশাহী থেকে
×