ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আস্তর ক্যানভাসে মনের ভাব

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ৫ নভেম্বর ২০১৬

আস্তর ক্যানভাসে মনের ভাব

সংস্কৃতি অঙ্গনের অন্যতম মাধ্যম চারুকলা। প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ভূপেন হাজারিকার কালজয়ী গান ‘চিত্রলেখা চিত্র তুমি আঁক না, দু-একটি রেখা নিয়ে সযতনে হাতে বক্ষে আঁক বিশাল হৃদয়, লক্ষজনে পাবে আশ্রয়, তুলিকা তুলে নাও না।’ তেমনি মনের ভাব যখন রঙ তুলিতে শিল্পীর চিত্রপটে ফুটে ওঠে, তখন ছবিও কথা বলে। শিল্পী তার নিপুণ হাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে যখন ছবি আঁকে, তখন সে ছবি হয়ে ওঠে জীবন ও প্রকৃতির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। শিল্পী জন্ম দেয় শিল্পের, কিন্তু শিল্প কখনও শিল্পীর জন্ম দেয় না। তাই শিল্পী মৃত্যুঞ্জয়ী আর তার নির্মিত শিল্পকর্ম কালের সাক্ষী হয়ে অনন্তকাল বিরাজমান লোক সংস্কৃতির গৌরবান্বিত নিদর্শন। এ কারণেই যুগে যুগে শিল্পীর আঁকা ছবির আবেদন চিরন্তন। ছবি এঁকে বিশ্বখ্যাত হয়েছেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল এ্যাঞ্জেলো, ভ্যানগগ, পাবলো পিকাসো, রাফায়েল, গঁগা, হেনরী মুর, জয়নুল আবেদীন, এস.এম. সুলতান, পটুয়া কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক রফিকুন্নবী (রনবী), অধ্যাপক মর্তুজা বশীর, অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কাজী আনোয়ার হোসেন (জাতির পিতার নৌকা আনোয়ার), ভাস্কর রাসা, শামীম সিকদারের মতো প্রথিতযশা ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী। পৃথিবীর সকল দেশে চিত্রাঙ্কনের কদর অভাবনীয়। চিত্রাঙ্কন বা ছবি আঁকার জন্য দেশে সরকারী ও বেসরকারী চারুকলা ইনস্টিটিউশন রয়েছে বেশকিছু। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা উচ্চতর ডিগ্রীও অর্জন করছে। তারা প্রশংসা অর্জন করছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে এ ধরণের কোন প্রতিষ্ঠান নেই। এখানে চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে শিশুর মনোবিকাশের কোন সুযোগ নেই বললেই চলে। ছোটবেলা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলে এ বিষয়ে শিশুরা মনোনিবেশ করতে পারে না। এ কারণে ছবি আঁকার প্রতি অধিকাংশ শিশুর অনীহা। বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ছবি আঁকা বা চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। কিন্তু প্রতিযোগীরা কোথায় ছবি আঁকা শিখবে বা শিখেছে তার কোন হিসেব নেই তাদের কাছে। এ ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে নেই কোন উদ্যোক্তা- নেই পৃষ্ঠপোষকতা। যা থেকে পিছিয়ে নেই মাদারীপুর অঞ্চল। তবে দীর্ঘদিন পরে হলেও এ বিষয়ে একটু আশার আলো জ্বালিয়েছেন নিভৃতচারী-প্রচারবিমুখ ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী আতিকুর রহমান আতিক। সঙ্গীত শিল্পী মা রোকেয়া ছিলেন বুটিক শিল্পের নিপুণ কারিগর। ১৯৬৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শিবচর উপজেলার ভান্ডারীকান্দি গ্রামে মাতুলালয়ে আতিকের জন্ম। ছোট বেলায় মায়ের শৈল্পিক নৈপুণ্যের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। ১৯৮২ সালে এসএসসি, ১৯৮৪ সালে এইচএসসি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে বিএ অনার্স ও এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। শিক্ষাজীবনে তিনি দেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মুনসুর-উল-করিম, মর্তুজা বশীর, সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ, অলক রায়ের সান্নিধ্যে এসে শৈশবের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে একধাপ এগিয়ে যান। ১৯৯৯ সালে মাদারীপুর ‘বঙ্গবন্ধু ল কলেজে’ জাতির পিতার ম্যুরাল শিল্পকর্মটি করেন। এটিই জেলার প্রথম ম্যুরাল। এর পূর্বে মাদারীপুরে এ ধরণের কোন শিল্পকর্ম ছিল না। পর্যায়ক্রমে বঙ্গবন্ধু চত্বরে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, সংগ্রামী মুজিব ম্যুরাল, সাংবাদিক গৌতম দাসের ম্যুরাল, শিবচরের দত্তপাড়ায় জনতার মুজিব (ভাস্কর্য), তরুণ নজরুল, যৌবনে রবীন্দ্রনাথ, মুক্তিযোদ্ধা বাবু চৌধুরীর ম্যুরাল তাঁর শিল্পকর্মের অসাধারণ সৃষ্টি। আতিক ভাস্কর্য শিল্পী হলেও মূলত তিনি চিত্রশিল্পী। জলরং, তেলরঙে ছবি এঁকে তিনি প্রচুর প্রশংসা পেয়েছেন। শিক্ষা জীবনে তিনি অনুভব করেছিলেন মাদারীপুরে চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে শিশুর মনোবিকাশের প্রতিষ্ঠান গড়ার। ইতোপূর্বে এ উদ্যোগ কেউ নেয়নি। তাঁর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০২ সালে ‘লাইনিং আর্ট একাডেমি’ নামে ছবি আঁকার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ‘চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে শিশুর মনোবিকাশের প্রতিষ্ঠান’ সেøাগানকে ভিত্তি করেই এ প্রতিষ্ঠানের জন্ম। পরবর্তীতে ‘লাইনিং’ এর বাংলা ‘আস্তর’ নামকরণ করা হয়। শিশুদের ছবি আঁকা শেখানোর কারণে ‘আস্তর’ এর নাম এখন মানুষের মুখে মুখে। এটিই জেলার প্রথম ও একমাত্র চিত্রাঙ্কন স্কুল। Ñসুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×