ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গত তিন যুগেও সরকারী নিয়ন্ত্রাধীন আম বাগানের বা গাছের তত্ত্বাবধান নেই

চাঁপাইয়ের পৌর এলাকার আম বাগান নিয়ে চলছে লুটপাট

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ৫ নভেম্বর ২০১৬

চাঁপাইয়ের পৌর এলাকার আম বাগান নিয়ে চলছে লুটপাট

ডি. এম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ প্রায় আড়াই শত সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের আম বাগান বা আম গাছ নিয়ে কয়েক যুগ ধরে চলছে মহা লুটপাট। এসব আম বাগান ও আম গাছের অবস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার মধ্যে বেড়ে উঠেছে। ২৪.৬০ বর্গকিলোমিটারের বা আয়তনের পৌরসভায় আম বাগানের অধিক সংখ্যক অবস্থান ১,২,৩ ও ১৫নং ওয়ার্ডে। ১১নং ওয়ার্ডের মধ্যে বাগানপাড়া নামের একটি মহল্লাও রয়েছে। এখানে এক সময় কিলোমিটার জুড়ে আম বাগান ছিল। মালিক অন্য দেশে চলে যাওয়ার কারণে বিশাল আম বাগানটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর বহিরাগতরা এখানে অবস্থান নিয়ে আম গাছ কেটে বস্তি বানিয়েছে। এক কথায় চলে গেছে অবৈধ দখলদারদের হাতে। একই ভাবে ধ্বংস হয়েছে রেল স্টেশন ও পিটিআই সংলগ্ন বাগান দুটি। এছাড়াও বর্তমানে বিভিন্ন অফিসের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে শতাধিক আম বাগান। এসব বাগানের আম গাছ মৌসুমকালীন ডাকে উঠিয়ে নিলাম না করে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ভোগ দখল করায় সরকার বঞ্চিত হচ্ছে শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকায় সরকার শুধু আম বাগান থেকেই কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব হতে বঞ্চিত হচ্ছে। এই ধরনের আম বাগান পাঁচ উপজেলাতেই থাকলেও তা কেনাবেচা না হয়ে ব্যক্তিগতভাবে ভোগ দখলের একাধিক নজির রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকায় প্রাথমিক সরকারী বিদ্যালয় রয়েছে ৪৩, বেসরকারী ৫, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২৭, দুটি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়াও ৭ কলেজ বেসরকারী ও দুটি সরকারী, পিটিআই ও সরকারী কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয় দুটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। মাদ্রাসা রয়েছে ১৭। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিতে আম বাগান থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে ভোগ দখল করে শিক্ষক ও পরিচালনা পরিষদ। নবাবগঞ্জ সরকারী কলেজ ও হরিমোহন মাধ্যমিক সরকারী বিদ্যালয়ের আম বাগান প্রতিবছর নিলাম ডাক করা হলেও সরকারী মহিলা কলেজের আম বাগান নিলাম ডাক করার কথা শুনা যায় না। এ এছাড়াও প্রায় প্রতিটি বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আম বাগান নিয়ে ভেলকিবাজি করা হয়ে থাকে মৌসুম আসলেই। অর্থাৎ বাগান বিক্রি না করে ফল পেড়ে ভাগ বাটোয়ারার অভিযোগ রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। অনরূপভাবে সরকারী অফিস চত্বরের বাগান নিয়েও নানান অভিযোগ রয়েছে। যদিও কালেক্টরেট আম বাগান, বিজিবি ব্যাটেলিয়ন আম বাগান, কল্যাণপুর উদ্যানতত্ত্ব আম বাগানসহ প্রায় ১০টি আম বাগান নিলাম ডাকে বিক্রি করে অর্জিত রাজস্ব সরকারী খাত ট্রেজারিতে জমা দেয়ার খবর পাওয়া গেলেও অন্য সরকারী দফতরের নিয়ন্ত্রণে থাকা আম বাগানের অর্থ আত্মসাত করার নজির রয়েছে। তবে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিশাল আকারের আম বাগান নিয়ে নানান ধরনের অপ্রীতিকর খবর রয়েছে। যেমন পূর্বের আম গবেষণাগার যা বর্তমানের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র নামের বিশাল আম বাগানের বিশাল অংশের উন্নতজাতের আম গাছ বিক্রি বা নিলাম না করে রেখে দেয়া হয় কৃষি গবেষণা, গাজীপুর বা ঢাকার বড় বড় কৃষি কর্মকর্তাদের রসনাসিক্ত করার জন্য। আম পাকা মৌসুম শুরু হলেই ঝুঁড়িতে পুরে ভেট হিসেবে পাঠানো হয়ে থাকে। অভিযোগ রয়েছে একইভাবে এখানকার কৃষি, মৎস্য, বিদ্যুত, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগসহ প্রায় ২৭ দফতরের কর্মকর্তারা তাদের অফিস সংলগ্ন একাধিক আম গাছ বিক্রি বা নিলাম ডাকে না দিয়ে খাস হিসাবে রেখে তার আম উর্ধতন কর্মকর্তাদের পাঠিয়ে থাকে ভেট হিসেবে তাদের খুশি রাখতে। এই ধরনের আম গাছের সংখ্যা চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার একাধিক অফিসের আম বাগানের সহস্রাধিক গাছ। এই ধরনের ভেট হিসেবে পাঠানো আমের দাম সব অফিস মিলিয়ে কোটি টাকা পেরিয়ে যাবে। তবে এখানে বেসরকারী পর্যায়ে যেমন ভূমিদস্যু বা বালুদস্যু রয়েছে। তেমন সরকারী পর্যায়েও আম গাছ দস্যুও রয়েছে একাধিক। তবে আম গাছ দখলে নেয়ার প্রক্রিয়াটা একটু ভিন্ন ধরনের। নজরকাড়া দৃশ্য রয়েছে ব্যস্ততম একটি অফিস পাড়াতে। এই পাড়াতে বসবাস করে পদস্থ কর্মকর্তারা। তাদের নামে সরকারী বাড়ি বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু সরকারী বিধি বিধান অমান্য করে সরকারী বাড়ির সঙ্গে খোলা জায়গা অধিক পরিমাণে দখল নিয়ে দিব্যি ভূমি দস্যুর খাতায় নাম লিখিয়েছে। সরকারী বরাদ্দ বাড়ি বা বাসা এবং জমি অধিক পরিমাণে দখলের লালসার অন্যতম কারণ আম গাছ দখলে আনা। এইভাবে একাধিক সরকারী বাস ভবনের পরিধি বাড়িয়ে শতাধিক আম গাছ দখলে নিয়ে ভোগ দখল করছে। এইসব আম গাছ ফলকর হিসেবে বিক্রি করে থাকে। সরকারী কর্মকর্তার স্ত্রীরা। আর এসব আম গাছের প্রধান ক্রেতা হচ্ছে যারা সরকারী নিলাম ডাকে বাগান কিনেছে তারাই। বিধায় এই বিশাল আম চত্বরের বহু গাছ এইভাবে সরকারী কর্মকর্তারা সরকারী বাসাবাড়ির পরিধি বা প্রাচীর সম্প্রসারিত করে আম গাছের দখল নিয়েছে। এর বাইরেও বাগান নিলাম ডাকে তোলার সময় কিছু গাছে চিহ্ন দিয়ে রাখে খাস হিসাবে। এগুলো বিক্রির বাইরে। এসব গাছের আম উর্ধতনদের ভেট হিসেবে বাহিরে বা রাজধানীতে পাঠানো হয়। একাধিক সরকারী ডাকবাংলো, সদর হাসপাতাল, টিবি ক্লিনিক, ডায়াবেটিক হাসপাতাল, সরকারী স্থাপনাসহ গোরস্থান পর্যন্ত আম বাগানের বিস্তৃতি। এমনকি ঈদগাহ চত্বরেও আম বাগান রয়েছে। এ ছাড়াও ছোট-বড় সরকারী স্থাপনা বা সরকারী বাসার আঙ্গিনা বা উঠানেও রয়েছে আম গাছ। যার কোন সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও সংখ্যার দিক থেকে অনেক। বেসরকারী প্রতিষ্ঠান (শিক্ষা ছাড়া) প্রায় ক্ষেত্রে বাগান নিলাম ডাকে বিক্রি করে থাকে। পৌর এলাকা জুড়ে আম গাছ দস্যুরা সক্রিয় হলেও বা গাছ ও ফল নিয়ে সরকারী হরিলুট চললেও গত তিনযুগেও সরকারী নিয়ন্ত্রাধীন আম বাগানের বা গাছের তত্ত্বাবধানে কোন সক্রিয় ভূমিকা রাখেনি তারা। যার কারণে গত এক যুগে শহর এলাকার সরকারী আম বাগানের একাধিক গাছ তত্ত্বাবধান না করার কারণে শুকিয়ে মারা গেছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বহু গাছের ডালপালা ভেঙ্গে পড়ে। সে সব ডালপালা ব্যক্তিগতভাবে ভোগ দখল করলেও বিক্রি করে সেই টাকা সরকারী কোষাগারে কোন দিন জমা পড়ে না। এক কথায় তত্ত্বাবধান না করার কারণে জেলার বহু আম বাগান নষ্ট হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি রেলওয়ের বিশাল বাগানের (৯ একর) একটি গাছও আজ অক্ষত নেই। গাছ কেটে সাবাড় করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বস্তি বানিয়ে লিজ দিয়ে খাচ্ছে। অথচও বিশাল এই বাগানটি রক্ষণাবেক্ষণে কোন ভূমিকা পালন করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। একইভাবে এই ধরনের বাগান রয়েছে প্রায় ১৫টি। যার অধিকাংশ এ্যাবানডেন্ট বা শুক্র সম্পত্তি হিসাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এসব বাগানের সিংহভাগ আম গাছ ধ্বংস হয়ে গেছে কিংবা ধ্বংস হওয়ার মুখে পড়েছে। এক কথায় সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রায় কয়েক সহস্র কোটি টাকার আম বাগান শুধুমাত্র সঠিক দেখভাল ও তত্ত্বাবধানের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। তবে সরকারী তত্ত্বাবধানে কোন নতুন বাগান এখন পর্যন্ত একটিও তৈরি হয়নি। সরকার আম গাছকে জাতীয় বৃক্ষ বলে ঘোষণার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এসব বাগান তত্ত্বাবধানে কোন ভূমিকা না রাখলেও নিলাম ডাকে কারচুপিসহ আম মৌসুমে ফল নিয়ে লুটপাটের যে দৃষ্টান্ত রয়েছে তা রুখে দিতে জরুরী বিধিনিষেধ জারি জরুরী হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে জাতীয় বৃক্ষ আম গাছ কাটার ব্যাপারে কঠোরতা সৃষ্টিসহ প্রতি বর্ষা মৌসুমে সাধারণ প্রশাসন কোন আম বাগান নতুন করে তৈরি বা সৃষ্টির বিষয়ে কি ভূমিকা পালন করছে তার জবাবদিহিতা সৃষ্টি করা খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বন বিভাগের হাতে বা বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে ‘আম গাছ সম্প্রসারণ বা বাগান রক্ষা কর্মকর্তা সৃষ্টি’ করা খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এ ধরনের কর্তৃপক্ষ থাকলে আম গাছ কাটার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। এছাড়াও এই কর্তৃপক্ষ আম গাছ সম্প্রসারণ ও তত্ত্বাবধানে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। নতুবা চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্য আম সাম্রাজ্য বা জাতীয় বৃক্ষ ভবিষ্যতে একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। এই খ- চিত্রটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার। সবুজ সামিয়ানার নিচে থাকা পুরো চাঁপাইনবাবগঞ্জের (জেলা) চিত্র আরও ভয়ঙ্কর ও ভয়াবহ। এই ভয়াবহতা থেকে বেরিয়ে আসতে বা আনতে হলে এই মুহূর্তে কঠোরভাবে সরকারী নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। আম বাগানের উপর।
×