ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এম. আমীর উল ইসলাম

বাংলাদেশের সংবিধানের পটভূমি

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৫ নভেম্বর ২০১৬

বাংলাদেশের সংবিধানের পটভূমি

(গতকালের পর) আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণার লক্ষ্য ও চেতনা সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং তার প্রতিফলিত চেতনায় উদ্দীপ্ত ৭ ও ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং সে ক্ষমতা সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হিসেবে জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার তথা ন্যায়ানুগ সরকার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং সুবিচার নিশ্চিতকরণের জন্য প্রণীত হয়েছে আমাদের সংবিধান। বাংলাদেশের সংবিধানকে এমনভাবে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে যে, এর প্রস্তাবনা ব্যতিরেকে এগারোটি ভাগে এটা বিভক্ত। প্রথম ভাগে প্রজাতন্ত্রের চরিত্রের বিবরণ, ৭ অনুচ্ছেদ প্রজাতন্ত্রের মৌলিক চরিত্রের নির্দেশক এবং ১১ অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ১১ অনুচ্ছেদের একটি বাক্যের মাধ্যমে অনেক প্রশ্নের জবাব মেলে। যেমন, প্রজাতন্ত্র বলতে কি বোঝায়; উত্তর মেলে গণতন্ত্র। এ উত্তরের সঙ্গে ৭ অনুচ্ছেদের একটি গভীর যোগসূত্র রয়েছে। ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে ক্ষমতা প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে।’ প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী, আইন প্রণয়ন এবং বিচারিক এই তিন ধরনের ক্ষমতা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিজস্ব ক্ষমতা নয়। শুধু জনগণের পক্ষে এবং জনগণের কল্যাণে সংবিধানের অধীন আইনানুগভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ ছাড়া অন্য কোন স্বার্থ বা কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার সংবিধান বহির্ভূত বলে বিবেচিত হবে। সংবিধান এবং আইন বহির্ভূত যে কোন কাজ অবৈধ বলে ঘোষিত হবে। এরূপ ঘোষণা প্রদানের সাংবিধানিক দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত। সংবিধান অনুসারে আইন সভার আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সংবিধান বহির্ভূত আইন বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে অবৈধ বলে গণ্য হওয়ার দাবি রাখে। সুবিন্যস্ত ক্ষমতা বিভাজনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল কার্যধারা ও উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয়ভাগে যথাক্রমে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং মৌলিক অধিকারসমূহ বিধৃত হয়েছে। চতুর্থভাগে বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর ওপর সংবিধান অনুসারে ন্যস্ত থাকবে। মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকবে এবং নির্বাহী বিভাগ সংসদের মাধ্যমে জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকবে। পঞ্চমভাগে আইন বিভাগ এবং ষষ্ঠভাগে বিচার বিভাগ নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে স্বাধীন সত্তা বজায় রেখে সংবিধানে সহজাতভাবে নির্মিত ক্ষমতা পৃথকীকরণের নীতি নিশ্চিত করেছে। তাই সুপ্রীমকোর্ট কর্তৃক মাসদার হোসেন মামলার রায়ে ক্ষমতা পৃথকীকরণ, তথা বিচার বিভাগ পৃথক থাকার সাংবিধানিক স্বীকৃতি কার্যকর করা হয়েছে। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের মাধ্যমে এর কার্যকারিতা শুরু হয়েছে বলা যেতে পারে। ৭ম, ৮ম ও ৯ম ভাগে যথাক্রমে নির্বাচন কমিশন গঠন, মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও সরকারী কর্মবিভাগ এবং তার নিয়োগ-পদায়ন, পদোন্নতি, নীতি ও প্রক্রিয়া নির্ধারণের জন্য সরকারী কর্মকমিশন গঠনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপরোক্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের ওপর তদারকি, তথা মনিটরিং করবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন স্বাধীন থাকবে। সরকারী অর্থ, সরকারী হিসাব বা অনুরূপ হিসাব মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক কর্তৃক তদারকি ও পরীক্ষিত হবে। পাশাপাশি সংসদ আইনের মাধ্যমে মহাহিসাব নিয়ন্ত্রককে আরও ক্ষমতা প্রদান করতে পারে। বাংলাদেশের কর্মবিভাগে একটি নিরপেক্ষ সরকারী কর্মকমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণ করা হবে। উপরোক্ত তিনটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে তদারকি ভূমিকা ছাড়াও সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান রয়েছে। ১২ বছর হলো আইন পাস হয়েছে; কিন্তু ন্যায়পাল আজও পর্যন্ত নিয়োগ হয়নি। দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে নবম (ক) বিভাগে জরুরী অবস্থার বিধান সংযোজিত হয়েছে। ১০মভাগ অনুযায়ী সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। একাদশভাগে প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তি তার ওপর নির্বাহী কর্তৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা, চুক্তি ও দলিল, আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ে এবং বাংলাদেশের পক্ষে বা বিপক্ষে মামলা, সাংবিধানিক পদধারীদের পারিশ্রমিক, পদের শপথ, প্রচলিত আইনের হেফাজত, ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী রহিতকরণ ও সংবিধানের ব্যবহৃত কিছু শব্দ, সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা। আমাদের সংবিধান মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। একটি ভাগ প্রজাতন্ত্রের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, প্রতিশ্রুতি ও বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ জনগণের অধিকার, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং অন্যভাগে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও সংসদ কি ভূমিকা রাখবে তার বর্ণনা রয়েছে। স্থানীয় সরকারের কাঠামোতে সর্বস্তরে প্রশাসন জনগণের প্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধানে বলবৎ থাকবে। এগুলো বাস্তবায়ন ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরির মূল নক্সা রচনা করা হয়েছে সংবিধানে। এবং উদ্দেশ্য সাধনে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ও দিকনির্দেশনা বিদ্যমান। আমাদের সংবিধানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে জনগণের সম্পদ ও মালিকানা এবং উৎপাদন ও বণ্টন প্রণালীসমূহ নিয়ন্ত্রণে জনগণের অধিকার এবং কৃষক, শ্রমিক ও জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে শোষণ থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন নিশ্চিত করার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ নিশ্চিত করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও বেকারত্ব থেকে মুক্তি এবং ব্যাধিগ্রস্ত, পঙ্গু, বিধবা, এতিম, বৃদ্ধ ও ভাগ্যাহতদের জন্য রাষ্ট্রের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ রয়েছে। সেইসঙ্গে গ্রামের উন্নয়ন, নগর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ, কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সৃষ্টি, শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল পরিবর্তনের ব্যবস্থা, গণমুখী সার্বজনীন শিক্ষা, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, সময়ের সঙ্গে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করা এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রকৃত দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টি, নিরক্ষতা দূরীকরণ, পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য এবং নৈতিকতার উন্নয়ন, সকলের জন্য সুযোগের সমতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবিচার থেকে মুক্তি, সম্পদের সুষম বণ্টন, কর্মের অধিকার ও কর্মকে কর্তব্যে পরিণত করা, নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, নাগরিক ও সরকারী কর্মচারীদের কর্তব্য বিধান, জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক বস্তু এবং স্থানসমূহের বিকৃতি ও ক্ষতিসাধন রোধ, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার উন্নয়ন সবই আমাদের সংবিধানের প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতি। চলবে...
×