ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

নৈরাজ্য না স্যাবোটাজ

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৫ নভেম্বর ২০১৬

নৈরাজ্য না স্যাবোটাজ

‘তোমরা সন্ত্রাস ও দুর্যোগ সৃষ্টি করো না’ -আল-কোরান। যারা পবিত্র ইসলামের নামে সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিপর্যায়ে সন্ত্রাস বা দুর্যোগ সৃষ্টি করে তারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রদত্ত ইসলামের পবিত্র দলিল ‘আল-কোরানের’ উপরের আয়াতটি পড়েছেন বা জেনেছেন কিনা জানি না। না জেনে থাকলে অনুরোধ করব জেনে নিন, সমাজকে সন্ত্রাস ও দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষায় এগিয়ে আসুন। একজন মুসলমান হিসেবে আমি মনে করি এটি আমাদের সকলের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। আয়াতটি আমাদের সকলের প্রতি নির্দেশ। আল্লাহর নির্দেশ না মানলে আমি, আপনি, আমরা আদৌ মুসলমান বলে দাবি করতে পারি কিনা, সেটি ভাববার সময় এখন। গত ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় দেশী-বিদেশী ২০ জনকে হত্যা ও ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে হামলা পূর্বাপর পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়- আড়াই বছর, ৪ বছর, ৫ বছর, ৬ বছর বয়সী শিশু থেকে শুরু করে কিশোরী, তরুণী এবং এমনকি বেশি বয়সের নারীদের ধর্ষণ; মানুষকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখা; পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা; গুপ্তহত্যা; মোবাইল স্ট্যাটাস ভিত্তি করে (সত্য না মিথ্যে জানা নেই) হিন্দু সম্প্রদায়সহ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও, সম্পদ লুটপাট, তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা; কিংবা কক্সবাজারের রামু থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর বৌদ্ধ ও হিন্দুদের বাড়িঘর-মন্দির ভাঙচুরÑ এ সবই তো সমাজে সন্ত্রাস-দুর্যোগ সৃষ্টি করছে। এ জন্য যাদের গ্রেফতার ও চিহ্নিত করা হচ্ছে তারা সবাই দেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান। তাহলে ধরে নিতে হবে কেউই আল্লাহ পাকের কোরানের আয়াত জানেন না বা মানছেন না। কী বীভৎস? আড়াই কিংবা ৪/৫/৯/১০ বছরের একটি বাচ্চা সেক্স রেপ কোনটাই বোঝে না, সে কেবল দেখে বা অনুভব করে কতগুলো মানুষরূপী হায়েনা তাকে কষ্ট দিচ্ছে। কী বীভৎস? কখনও কখনও দেখা যাচ্ছে ৪০/৫০ বছর বয়সী লোকও ওই ৪/৫ বছর বয়সী শিশুদের রেপ করছে? এ কি ভাবা যায়? এটা কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের কাজ হতে পারে না। আমরা জানি যে কোন জবরদস্তি শারীরিক সম্পর্কই রেপ। তার ওপর আবার শিশু? এ কি ভাবা যায়? কেন এমন হচ্ছে? ॥ এক ॥ অপরাজনীতি। যেদিন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে মূলধারা থেকে বিচ্যুত করে অপ এবং বিকৃত ধারায় টেনে নেয়ার চেষ্টা হয়েছে সেদিন থেকে। অর্থাৎ জাতির পিতাকে হত্যার পর মার্শাল ল’ দিয়ে বাংলাদেশকে পেছনে ঠেলে দেয়া হয়েছে, মূলত সেদিন থেকে সমাজে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ এবং দুর্যোগ নেমে আসে। বাংলাদেশের মানুষ মদ, গাঁজার নাম জানতÑ হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল এসবের নাম জানত না। আজ সেসব ড্রাগ বা মাদকদ্রব্য ঘরে ঘরে। ডাক্তার, মনোচিকিৎসক বা মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ড্রাগ বা হেরোইন-ইয়াবা এতই মারাত্মক যে, ভুল করে বা বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে বা ফান করে একবার সেবন করলে তা আর ছাড়তে পারে না। এগুলোর দামও শুনেছি মদ-গাঁজার চেয়ে অনেক বেশি। ছোট এক চিমটি হেরোইন বা একটা ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম নাকি ৪-৫শ’ টাকা এবং একজন ড্রাগ এ্যাডিক্টকে দিনে দশ পুরিয়া হেরোইন বা ১০টি ইয়াবা ট্যাবলেট খেতে হয়। এ টাকা যোগাড় করতে এ্যাডিক্ট ছেলে বাবা-মাকে মারে, হাইজ্যাক করে। অর্থাৎ যে কোন খারাপ কাজ করতে তারা দ্বিধা বা সঙ্কোচ বোধ করে না। ভদ্রঘরের সন্তানেরও না। কারণ ওই জীবননাশী মাদক হেরোইন-ইয়াবা একজনকে মানসিকভাবে বিকৃত করে দেয়। এই যেমন প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হলে তরুণীদের চাপাতি দিয়ে কোপানোর কারণও মাদক। অবশ্য এ সমস্যা কেবল বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়, এটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়ায় মাদকবিরোধী অভিযানকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে মাদকের রিটেলারদের ধরা হয়, মূল মাদক চোরাচালানি বা গডফাদারদের ধরা হয় না। তারা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। কক্সবাজারের একজন এমপির ৩ বছরের কারাদ- হয়েছে সম্প্রতি। সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তার বিরুদ্ধে এ সাজা ঘোষণা করেছে আদালত। সেই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই এমপি সম্পর্কে ওপেন সিক্রেট হলো সে ‘মাদক চোরাচালানের’ সঙ্গে জড়িত, বিশেষ করে ‘ইয়াবা’। যেহেতু এ ব্যাপারে কোন বিচারের কথা শুনিনি, তাহলে ধরে নিতে হবে ওই সবই গুজব বা রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের বাজে এবং ফালতু কথাবার্তা(?) তাই কি? ॥ দুই ॥ ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে একটি ফেসবুকে ইসলামের অবমাননা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে বৌদ্ধ বস্তিতে যেভাবে হামলা হয়েছিল, দু’দিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলা ও তাদের মন্দির-বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ভাংচুরের মতো তা-বও একই ধরনের সন্ত্রাস এবং নাশকতা। নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাস ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে ইসলামের অবমাননা করেÑ এ কথা ছড়িয়ে পড়লে রসরাজ দাসকে পুলিশ আটক করে এবং আদালতে প্রেরণ করে কারাগারে পাঠায়। তারপরও একটি ইসলামী সংগঠন সেখানে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়। এর সমর্থনে মাইকিংও করা হয়। মাইকিংয়ের মাধ্যমে অনেক ‘উস্কানিমূলক’ সেøাগানও দেয়া হয় বলে পত্রপত্রিকায় এসেছে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হলোÑ স্থানীয় প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ ওই সমাবেশে অংশ নেন। তারপরও এমন একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল। দৈনিক প্রথম আলো ভিডিও ফুটেজ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে যে রিপোর্ট করেছে তাতে বলা হয়েছেÑ ‘নাসিরনগর উপজেলা সদর ইউনিয়নের লোকজন হামলা চালালে তাদের চেনা যেত। বরং আশপাশের গ্রাম ইউনিয়ন থেকে সমাবেশে যোগ দিতে আসা লোকজনের একটি অংশ সমাবেশে যোগ না দিয়ে এবং একটি অংশ সমাবেশ থেকে গিয়ে ওই হামলা চালায়। অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ ওই সমাবেশে যাওয়ায় হামলাকারীরা উৎসাহিত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে পুলিশের গাফিলতি ছিল। তাহলে ধরে নিতে হবে হামলাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং স্যাবোটাজ! ইতিহাস বলে এবং বেশি দিনের কথাও নয়, এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই সন্তান মাওলানা ফজলুল হক আমিনী (মৃত) সেøাগান দিয়েছিলেনÑ ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম স্থানীয় এসপি মিজানুর রহমানের রি-এ্যাকশন ছেপেছে যেÑ ‘এ হামলার জন্য জামায়াত-শিবির দায়ী...সুযোগসন্ধানী মহল সরকারকে বিব্রত করতে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’ এখানে একটা ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার। এখনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারী-বেসরকারী চাকরিতে জামায়াত-শিবিরের ঢুকে পড়া বন্ধ হয়নি, অব্যাহত আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-এমপিদের অনেকে অর্থের বিনিময়ে অথবা রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির ভ্রান্তমোহে এসব অপকর্ম করে চলেছে। এসব বন্ধ না হলে সমাজ থেকে সন্ত্রাস, মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না। ॥ তিন ॥ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে যেমন প্রথমে গুপ্তহত্যা, তারপর দেশব্যাপী রাস্তা-গাছ কেটে যাতায়াত বাধাগ্রস্ত করা, পেট্রোলবোমা মেরে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে বাস ও ট্রেনযাত্রী বা পথচারী হত্যার দুঃখজনক ঘটনাবলীর চিত্র এখনও চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। ২০১৬ সালে শুরু হয়েছে শিশু-কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আগেই বলেছিÑ কতখানি বিকৃত, কতখানি বর্বর হলে আড়াই বছরে বয়সী থেকে ৪-৫ বছরের শিশু এমনকি বয়স্ক নারী, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগিনী পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। যে শিশুটি এখনও কথা বলতেই শিখেনি ভালভাবে কিংবা সে যে কন্যাশিশু এবং বড় হলে নারী হবে, এখনও সেই বোধই জন্মায়নিÑ তাকেও ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে। এখানে দুটি ধর্ষণের ঘটনা উল্লেখ করছিÑ প্রথমত, দৈনিক সংবাদের একটি খবরে বলা হয়েছেÑ ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্যরা এক মানসিক রোগীকে রাতভর ধর্ষণ করেছে। গণধর্ষণ। ক্যাম্পের ছয় আনসারকে ‘সাময়িক বরখাস্ত’ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মিনহাজ নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপর ৫ জন পলাতক। গত ২৯ অক্টোবর ধর্ষিতা মানসিক রোগী তরুণী হাসপাতালে ভর্তি হয়। তার কাউন্সিলিং ও ফরেনসিক পরীক্ষায় ধরা পড়েছে তার সঙ্গে একাধিক ব্যক্তির যৌন সম্পর্কের ব্যাপার। মেয়েটি কখনও সুস্থ থাকে আবার কখনও মানসিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ডাক্তার তরুণীর বরাত দিয়ে জানান, গত ২৭ অক্টোবর রাতে কয়েকজন আনসার সদস্য তাকে ৫০০ টাকা দিয়ে বহির্বিভাগের তৃতীয় তলায় ক্যান্সার ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে ৬ জন তাকে ধর্ষণ করে। দ্বিতীয়ত, রেপের ঘটনাটি ঘটেছে রংপুর শহরের নর্দান নার্সিং ইনস্টিটিউটে। এখানে দুই শিক্ষার্থী গণধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় আলমগীর কবির নামে এক ধর্ষককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। জানা যায়, দুই নার্সিং শিক্ষার্থী রংপুর শহরের ধাপ এলাকায় সর্দারপাড়ায় অবস্থিত মিরাজ ছাত্রাবাসে তাদের দুই সহপাঠী নিমাই ও আলমগীরের কাছে লেকচার শীট চাইলে তাদের ছাত্রাবাসের সামনে যেতে বলে। রাত সাড়ে ৯টায় তারা দুইজন ওই ছাত্রাবাসের সামনে গেলে ধর্ষকরা তাদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে না থেকে ছাত্রাবাসে যেতে বলে। এ ঘটনায় ধর্ষিতা তরুণীদ্বয় নিজেরাই থানায় মামলা করে। তারা প্রথমে প্রিন্সিপালকে জানালেও তিনি কোন ব্যবস্থা নেননি। ধর্ষক আলমগীর কবির পুলিশকে জানিয়েছে, ওই সরদারপাড়ায় শাকিল, পলাশ, শাহ আলম ও মানিক ওই দুই তরুণীকে দুই কক্ষে নিয়ে রাতভর ধর্ষণ করেছে। এ রকম বর্বরোচিত ঘটনা এ বছর হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। কিন্তু একটা ব্যাপার অবাক করে, এ ধরনের ঘটনায় ধর্ষক ধরা পড়লেও মামলাটি বছরের পর বছর ফাইলচাপা পড়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কোন বিচার হয়নি। ধর্ষক বুক ফুলিয়ে সমাজে বিচরণ করে, মামলা তুলে নেয়ার জন্য ধর্ষিতা বা তার পরিবারকে চাপ দেয়। মামলা না তুললে ওই পরিবারের অন্য কাউকে ধর্ষণের শিকার বানায়। এই বর্বরতা কি চলতে থাকবে? ঢাকা : ৪ নবেম্বর ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×