ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বায়োগ্যাস উৎপাদনে বর্জ্য ব্যবহার করা যেতে পারে ॥ বিশেষজ্ঞ অভিমত

ঢাকার নদী দূষণ রোধে দানিয়ুব টেমস মডেল অনুসরণের পরামশ

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৫ নভেম্বর ২০১৬

ঢাকার নদী দূষণ রোধে দানিয়ুব টেমস মডেল অনুসরণের পরামশ

শাহীন রহমান ॥ প্রাকৃতিক বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকার চার নদী দূষণমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বর্জ্য সরাসরি নদীতে না ফেলে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ডাম্পিং করে সূর্যের আলো ও বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে দূষণমুক্ত করতে হবে। পরে সেই বর্জ্য সার হিসেবে ব্যবহার করে শাকসবজি উৎপাদন ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা যাবে। এছাড়াও বর্জ্য নদীতে সরাসরি না ফেলে নদী পাড়েই বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী ভারত এমনকি লন্ডনের টেমস নদী দূষণমুক্ত করার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর সাবেক নির্বাহী পরিচালক তোফায়েল আহমেদ বলেন, পৃথিবীর বহু শহর ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদীর অবস্থাও এক সময় বুড়িগঙ্গার মতো অবস্থা ছিল। দানিয়ুব, টেমস, গঙ্গার ভারতে অংশে ব্যাপক দূষণ ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় গত কয়েক বছরে কলকাতা শহরে অবয়ব বদলে দেয়া হয়েছে। পূর্ব কলকাতার বর্জ্য সূর্যের আলো ও বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন চাহিদা বাড়িয়ে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বর্জ্য শোধন করছে। মাছ চাষ ও সবজি চাষ করছে। যান্ত্রিক উপায়ে বর্জ্য শোধনের বিশাল ব্যয়ভার বহন না করেই প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পরিশোধনের দিকে যাচ্ছে বিভিন্ন সভ্যতা। তিনি বলেন, লন্ডনের টেমস নদীও একসময় দূষিত বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়। তারা টেমস এর বর্জ্যকে শহর থেকে বাইরে নিয়ে একত্রিত করে নর্থ সি’র নরপ্লপ মোহনায় প্রতিস্থাপন করে লন্ডন শহরকে নিরাপদ করেছে। তিনি উল্লেখ করেন হাতিরঝিলের আশপাশের বিশাল অংশের বর্জ্যও রামপুরা খালে প্রতিস্থাপন করে হাতিরঝিলকে দূষণমক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। চার নদী দূষণমুক্তির করার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। আমরা বুড়িগঙ্গাকে এমন অবস্থায় দেখতে চাই যার পানি হচ্ছে স্বচ্ছ, শীতল ও টলটলয়মাণ। যার তীরে হাটা গোসল করা নৌকার প্রতিযোগিতা নৌযানে ভ্রমণ করা যাবে। সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখা যাবে উল্লেখ করেন। দখল দূষণের বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চার নদী মৃত্যু পথযাত্রী হলেও আজ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে সরকারের কোন কার্যকরী উদ্যোগ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা চার নদীতে আজ তিনটি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর থেকে মুক্তির কোন উপায় বের করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে নদী এত পরিমাণ দূষিত যে এর পাড় দিয়ে যাওয়াও এখন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দূর থেকে এর দূষণের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগে। এছাড়া রয়েছে দখল। বার বার উচ্ছেদ অভিযান করেও দখল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। দখল হতে হতে বুড়িগঙ্গা মূলত শীর্ণকায় হয়ে পড়েছে। তারা বলছেন বুড়িগঙ্গার মৃত্যুর আরও একটি বড় কারণ এর প্রবাহ একেবারেই কমে যাওয়া। বিশেষ করে বর্ষার সময়ের কয়েক মাস বাদ দিলে বুড়িগঙ্গা যে প্রবাহ থাকে তা একটি খালে ন্যায়। তখন এর দূষণ আরও প্রকট আকার ধারণ করেন। এ অবস্থায় ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে এর প্রাণ বুড়িগঙ্গাসহ চার নদী বাঁচানো কোন বিকল্প নেই। তাদের মতে পূর্বে বুড়িগঙ্গা বংশি নদীরই সম্প্রসারণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হক। পরে ধলেশ^রী এর শাখা নদী হিসেবে রূপ লাভ করে। বর্তমানে যমুনা নদী থেকে ধলেশ^রী নদীর উৎসমুখ শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে ঢাকার নদীসমূহে পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় এর প্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে দূষণও মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এ কারণে এক সময়ের স্রোতসিনী বুড়িগঙ্গা আজ নিথর আবর্জনার ভাগাড়। অথচ এক সময়ে এই বুড়িগঙ্গায় ঢাকার সৌন্দর্য শতগুণে বৃদ্ধি করেছিল। যেমন টেমসের তীরে লন্ডন শহর সেইনের তীরে প্যারিস, দানিউবের তীরে বুদাপেস্ট, হানের তীরে সিউল, হুগলী গঙ্গার তীরে কলকাতা, বানারসী প্রাচীন শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। ধলেশ^রীর সঙ্গে বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলে প্রায় ৮ কিলোমিটার উত্তরে বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা নগরী অবস্থিত হওয়ায় এক সময়ে বুড়িগঙ্গা ও ঢাকা ছিলও অভিন্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বুড়িগঙ্গা দূষণে ও বর্জ্যে ভরাট হয়ে মরে যাচ্ছে। ১৭৮২ সালে ভারতবর্ষের জেমস রেনেলের মানচিত্রে বুড়িগঙ্গার যে গতিপথ দেখানো হয়েছিল পরবর্তীতেও সময়ও ঐ চিত্রের কোন পরিবর্তন হয়নি। মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকে নৌকা লালবাগ ঘাটে ভিড়ত। নওয়াবগঞ্জ চরের কোন অস্তিত্বই ছিল না তখন। বুড়িগঙ্গা নদীর পুরনো যেখানে চর সৃষ্টি তা এখন শহরের অংশ। সেই জন্য ১৮৪০ সালে টেইলর লিখেছিলেন ক্রমেই বুড়িগঙ্গা পলি জমে অপ্রশস্ত হচ্ছে। গতিপথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ বুড়িগঙ্গার তীরটি মনোহর হওয়ায় এক সময়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা তাদের বাসভবন বুড়িগঙ্গার তীরে বেছে নিয়েছিল। তাই টেইলর ১৮৪০ সালে লিখেছিলেন বর্ষাকালে বুড়িগঙ্গা যখন পানিতে ভরপুর তখন দূর থেকে ঢাকাকে ভেনিস এর মতো মনে হতো। তারা বলেন, দখল, ভরাট ও দূষণে নদীর তলদেশ ও তীর বর্জ্যে ভরাট হয়ে নদীর প্রবাহ কমে এসেছে। বর্তমানে বুড়িগঙ্গাতে হাত দিলে হাতে ঘাঁ হয়। মাছ নাই প্রাণ নাই। কারণ অক্সিজেন শূন্য। পানি থেকে প্রাণ। কিন্তু অক্সিজেন শূন্যতায় তার কোন ক্ষমতা থাকে না। ফলে বুড়িগঙ্গায় আজ জলজ প্রাণীরও কোন অস্তিত্ব নেই। ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না এর পানিকে। পানি আজ এত দূষিত যে ওয়াসার পানি ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে শোধন করা যাচ্ছে না। তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, সাভারের ৪ কিমি দক্ষিণে কলাতিয়া হযরতপুর চর আলগি নিকট ধলেশ^রী নদী থেকে বুড়িগঙ্গা ওয়াসপুরে কামরাঙ্গীর চরের নিকট তুরাগ নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। গাজীপুর উত্তর বনভূমি থেকে শালদা ও লবণদাহ দুটি নদী তুরাগের সঙ্গে কোনাবাড়ীর উজানের কালিয়াকৈরের ভাটিতে মিলিত হয়েছে। তিনি বলেন বুড়িগঙ্গার ধলেশ^রীর উৎস পলি ভরাটের মাধ্যমে বন্ধ হয়ে বর্তমানে সংযোগ বিচ্ছিন্ন। শুধু বর্ষা ও বন্যার সময়ে কিছু প্রবাহ লাভ করে। এর বাইরে বেশিরভাগ সময়ে নদীকে খালের মতো মনে হয়। এ অবস্থায় ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করতে হলে দেশের সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক, গুণী প-িত ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। সব ধরনের দখল দূষণ বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিতে হবে এখনই। ধলেশ^রী থেকে লালবাগ লোহারপুল পর্যন্ত সম্পূর্ণ আদি বুড়িগঙ্গা পুনরুদ্ধার করতে হবে। দখলদার ও দখলে সহায়তা প্রদানকারী সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহ্বান জানান তারা। তারা বলছেন এখনও অব্যাহত দখলদারদের কবলেই রয়েছে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা। দখলরোধে নেই কোন কার্যকরী ব্যবস্থা। বারবার জনসম্মুখে দখলের চিত্র তুলে ধরার পরও কোন একটি বড় দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ইতোমধ্যে ভুল সীমানা পিলার সংশোধন না করে ওয়াকওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকার চারপাশে বহু জায়গায় নদী স্থায়ীভাবে তার সীমানা হারানোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দখলদাররা বৈধতা পেয়েছে। অধিকাংশ উচ্ছেদ অভিযানে থাকে না কোন সমন্বিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। ফলে দখলমুক্ত করণের নামে ভাঙ্গা ভবন কিংবা ভরাটকৃত মাটি ও বালু আবারও নদীতে ফেলে দিয়ে বরং নদীর বেশি ক্ষতি করা হয়েছে। এ অবস্থায় নদী রক্ষা করা না হলে ভবিষ্যতে ঢাকা মহানগরে বসবাসকারী জনসাধারণের ওপর বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
×