ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট নেই- যত্রতত্র চলে মলমূত্র ত্যাগ

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৫ নভেম্বর ২০১৬

পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট নেই- যত্রতত্র চলে মলমূত্র ত্যাগ

আরাফাত মুন্না ॥ ঢাকা শহরে প্রায়ই চোখে পড়ে দেয়ালে দেয়ালের সাইন প্লেট ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না, করিলে ৫০ টাকা জরিমানা’। কিন্তু কে শোনে কার কথা? দেখা যাবে ঠিক ওই জায়গায়ই আরও বেশি করে মূত্র (প্রস্রাব) ত্যাগ করছে অনেকে। অনেক জায়গায় ফুটপাথের ওপরেও মূত্র ত্যাগ করে কেউ কেউ। ফলে ওইসব জায়গা দিয়ে সাধারণ মানুষ চলাচলের সময় চরম বিপত্তিতে পড়ে। মূত্রের প্রকট দুর্গন্ধে নাকে রুমাল চেপে হাঁটতে হয় পথচারীদের। কোথাও কোথাও আবার ফুটপাথের ওপরই মলত্যাগ দেখা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, যারা ফুটপাথের ওপর বা রাস্তার পাশে মল-মূত্র ত্যাগ করছে তারা কি ইচ্ছাকৃতভাবে করছে? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই বলছেন, নিতান্ত বাধ্য হয়েই রাস্তার পাশে মল-মূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে। এখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি নেই বলে দাবি তাদের। সরেজমিনে রাজধানীর প্রেসক্লাব, গুলিস্তান, ফকিরাপুল, সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেট, মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর, গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার পাশে মল-মূত্র ত্যাগের চিত্র পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার প্রেসক্লাব থেকে শিক্ষা ভবন যাওয়া পথে কদমফুল চত্বরের পাশের ফুটপাতের ওপর এমন ভাবে মূত্র ত্যাগ করতে দেখা গেছে, যেখান দিয়ে মানুষের চলাচল করাই কষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক ওই যায়গায়ই রয়েছে একটি মোবাইল টয়লেট। তবে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে ওই মোবাইল টয়লেটের দরজায় তালা ঝোলানো দেখা গেছে। এ সময় পথচারী ইকবাল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে প্রস্রাবের এত গন্ধ নাক না ধরলে বমি চলে আসে। এই মোবাইল টয়লেটটা খোলা থাকলে হয়তো কেউ রাস্তায় প্রস্রাব করত না।’ বৃহস্পতিবার ফকিরাপুল কাঁচাবাজারের উল্টো দিকের ফুটপাথের ওপরও মূত্র ত্যাগ করতে দেখা গেছে একজনকে। তার সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, প্রচ- চাপ থাকায় এখানে প্রস্রাব করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। ওই ব্যক্তি বলেন, ‘অনেকক্ষণ যাবৎ প্রস্রাবের চাপ ছিল, আশপাশে কোথাও পাবলিক টয়লেট পাইনি তাই এখানে কাজটা সারতে হলো।’ সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ ও ওয়াটার এইড পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রায় ৮০০ বর্গকিলোমিটারের এ শহরে ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে পাঁচ লাখ ভাসমান, রিকশাচালক ১০ লাখ, অন্যান্য জীবিকার মানুষ ১০ লাখ, নিয়মিত পথচারী ২০ লাখ এবং ঢাকার বাইরে থেকে আসা ১৫ লাখসহ প্রতিদিন মোট প্রায় ৫৫ লাখ মানুষ ঢাকা শহরের রাস্তায় চলাচল করেন। পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা মাত্র ৬৯। অর্থাৎ প্রতি সোয়া দুই লাখ মানুষের জন্য মাত্র একটি পাবলিক টয়লেট আবার চালু থাকা পাবলিক টয়লেটের মধ্যে ৯১ শতাংশই ব্যবহার অনুপযোগী। পাবলিক টয়লেটের সংকটের কারণে মসজিদ, পেট্রোল পাম্প ও শপিংমলে অবস্থিত টয়লেটগুলো না থাকলে মানুষকে পড়তে হতো চরম বিপাকে। রাজধানীর গুলিস্তান থেকে বঙ্গবাজার পর্যন্ত রাস্তায় খোদ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবনের পেছনের ফুটপাথে মূত্র ত্যাগের চিত্র এমন, দেখলে যে কেউ ভাববে বৃষ্টির পানি জমে আছে। তবে কাছে গেলেই প্রকট গন্ধে মনে হবে পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসছে। পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেটের অভাব, বাড়তি খরচ, লাইনে দাঁড়ানোর মতো পর্যাপ্ত সময় হাতে না থাকায় যেখানে সেখানে মূত্র করতে হচ্ছে পথচারীদের। ফুটপাথ ও ফুট ওভারব্রিজে মলত্যাগ করছে অনেক ভাসমান মানুষ। ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। ছড়াচ্ছে রোগ-জীবাণু! পথচারী মানুষদের মধ্যে যারা একটু সচেতন, তারা হয়ত প্রচ- চাপেও রাস্তায় মূত্র ত্যাগ করেন না। ফলে পেটের প্রদাহ থেকে শুরু করে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয় রয়েছে তাদের। চিকিৎসকরা বলছেন, যারা নানা বাস্তবতায় প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে পারেন না, তাদের শরীরে স্থায়ী বা অস্থায়ী নানা ধরনের রোগ, মূত্রথলিতে ব্যথা, ইনফেকশন এবং পরিপাকতন্ত্র ও কিডনিতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রাজধানীর পাবলিক টয়লেটগুলোর অবস্থাও ভাল নয় ॥ রাজধানীর গুলিস্তানের বিআরটিসি বাস কাউন্টারের পাবলিক টয়লেটের উটকো গন্ধে নাজেহাল ব্যবহারকারীরা। ওই টয়লেট ব্যবহারকারীদের কাছ থেকেও টাকা তোলে এক ব্যক্তি। নিউ মার্কেটে (পোস্ট অফিসের কাছে) সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক নির্মিত পাবলিক টয়লেটে নেই মহিলাদের জন্য কোন আলাদা ব্যবস্থা। গুলিস্তানে পুলিশ ফাঁড়ির সামনের সিটি কর্পোরেশনের পাবলিক টয়লেট ও নাট্যমঞ্চের সামনের পাবলিক টয়লেটে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নেই। এ দুটি টয়লেট থেকে মাসভিত্তিক চুক্তির মাধ্যমে দোকানিদের সঙ্গে পানির ব্যবসা করার অভিযোগ রয়েছে। পানি সরবরাহের জন্য নিযুক্ত আছে আলাদা ব্যক্তি, নির্ধারিত আছে পানি মাপার পাত্রও! অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন সেবা নয় বরং ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে পাবলিক টয়লেটগুলো। বেশিরভাগ পাবলিক টয়লেট থেকেই দেয়া হচ্ছে অবৈধ পানি ও বিদ্যুত সংযোগ। নিম্ন মানের সেবা দিয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় কারায় ভোগান্তিতে পড়েছে জনসাধারণ। শাহাবাগের একটি মাত্র পাবলিক টয়লেট দখল করে আছেন ফুল ব্যবসায়ীরা। মহিলা টয়লেটে পুরুষ এ যেন এখানকার চিরাচরিত প্রথা। প্রায়ই পানি থাকে না এখানে। কাঁটাবনের একটি মোবাইল টয়লেটেও পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই দীর্ঘদিন! ওয়াটার এইডের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার ৪৮ শতাংশ পাবলিক টয়লেটে পানি থাকে না। রমনা উদ্যান এলাকায় তিনটি পাবলিক টয়লেট আছে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই তালা ঝুলতে দেখা গেছে এগুলোতে। আজিমপুর মেটারনিটি হাসপাতালের পাশে ও আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডের সঙ্গে দুটি পাবলিক টয়লেট আছে। পর্যাপ্ত পানি সমস্যার কারণে তীব্র দুর্গন্ধে এর পাশ দিয়ে পথচলাও দায়। ভাঙ্গা কমোড, বদনা-বালতি ভাঙ্গা ও অপরিষ্কার। ব্যস্ততম ফার্মগেট এলাকায় হাতের কাছে নেই কোন পাবলিক টয়লেট। রাস্তায় মূত্রত্যাগ ঠেকাতে আরবী লেখা ॥ রাজধানীতে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট না থাকলেও যত্রতত্র মূত্রত্যাগ ঠেকাতে ধর্ম মন্ত্রণালয় অভিনব এক উদ্যোগ নিয়েছিল, যা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। প্রকৃতির ডাকে ‘নিরূপায়’ যারা ‘নিষেধ’ লেখা দেখেও ফুটপাথে দাঁড়িয়ে যান, তাদের নিবৃত্ত করতে ধর্ম মন্ত্রণালয় ব্যবহার করা শুরু করেছিল ‘ধর্মীয় অনুভূতি’। তবে তা এখন আর কাজে আসছে না, যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কয়েকটি যায়গায় ‘বাংলা’ নিষেধে কাজ না হওয়ায় ‘এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ’ বাক্যটি লিখে দেয়া হয়েছিল আরবী হরফে। এ উদ্যোগ নিয়ে দুই মিনিটের একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে ভিডিওশেয়ারিং ওয়েবসাইট ইউটিউবেও প্রকাশ করেছিল ধর্ম মন্ত্রণালয়। অভিনব এ উদ্যোগকে সেই ভিডিওতে বলা হয়েছে ‘এ স্মার্ট সলিউশন টু আ ফাউল প্রবলেম’।
×