ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সুমাইয়া ইসলাম নিপা

পাথরের শৈল্পিক রূপকার

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৪ নভেম্বর ২০১৬

পাথরের শৈল্পিক রূপকার

পাথরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে এবং দর্শকের চোখে মোহাচ্ছন্ন সংবিষ্ট মায়াবী অর্থাৎ নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টিতে অদ্বিতীয় ছিলেন শিল্পী জিয়ান লরেঞ্জো বার্নিনি। বৈচিত্র্যময় গতিময়তা অতিনাটকীয় অলঙ্করণ ইন্দ্রীয়জনিত অনুভূতি বহুমুখিতা উজ্জ্বল জাঁকজমকপূর্ণ ঐশ্বর্যম-িত ভাব যার গড়নে বারোক রীতির পরিচয়। আর এই রীতির প্রবক্তা এবং প্রাণদাতা শিল্পী হলেন ভাস্কর বার্নিনি। ভাস্কর বা স্থপতি হিসেবেই নয়, চিত্রশিল্পে, মঞ্চ ডিজাইনে এবং নাটক পরিচালনার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সিদ্ধহস্ত ছিলেন এই বহুমুখী ইটালীয়ান শিল্পী। দর্শকের আবেগ অনুভূতিকে মাথায় রেখে সাধু সন্তসহ সকল ফিগারকে মঞ্চে অভিনীত বিভিন্ন জীবন্ত চরিত্রে উপস্থাপন করেছেন। চিত্রকলার সঙ্গে প্রতিযোগিতার মানসিকতা নিয়েই তিনি সৃষ্টি করতেন তাঁর মার্বেল পাথরের জীবন্ত ফিগারগুলো। দর্শক মূর্তিগুলোর সম্মুখীন হলে নিজেরাই প্রশ্নবিদ্ধ হতো যে এগুলো কি সত্যিই নিষ্প্রাণ দেহ নাকি না। ভাস্কর্যে প্রেম, বেদনা, যন্ত্রণা, ক্রোধ, আনন্দ, ভয়, শক্তিমত্তা, গতিময়তার সমন্বয়ে সার্থক হতে পেরেছিলেন দর্শককে ভ্রমের জালে আবিষ্ট করতে পারার মধ্য দিয়ে। এজন্যই কর্মকুশলতায় উৎকর্ষ লাভ ও গতিময় প্রকাশভঙ্গিতেও পূর্ণতার সিলমোহর দেখা যায়। অসীম উচ্চাশা নতুন ও দুর্লভ সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য। বার্নিনি সমসাময়িক সময়ে শ্রেষ্ঠ ভাস্কর যার সমতুল্য মেলা ভার। বিশিষ্ট এক সমালোচক বলেন, ‘শেক্সপিয়ার নাট্য জগতে যা বার্নিনি ভাস্কর্যে তা।’ বার্নিনির নান্দনিকতার নন্দিত রূপ পাওয়া যায় তাঁর ফিগারনির্ভর প্রতিটি কাজে। তাঁর কাজে নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি আনন্দের উচ্ছ্বাসও প্রকাশিত সমোহ প্রতিভায়। তাঁর কাজগুলো বিবেচনায় বলা হয় ভাস্কর্য জগতের অন্যতম স্রষ্টা মাইকেল এঞ্জেলোর সমতুল্য না হলেও তাঁর চেয়ে কোন অংশে কমও নয়। দালান, চার্চ, চ্যাপেল, ফোয়ারা অর্থাৎ তাঁর সাফল্যের পেছনে উৎসাহদাতা ছিল রোমান ক্যাথলিক গীর্জাগুলো। বার্নিনি তাঁর জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সেন্ট পিটার গীর্জার স্থাপত্য ও অলঙ্করণের পেছনে ব্যয় করেন। তাঁর মাথায় কতগুলো বড় কাজ করার ইচ্ছা ছিল প্রথমত সেন্ট পিটার গীর্জা সজ্জিতকরণ এবং দ্বিতীয়ত ছোট ছোট কিছু গীর্জা প্রাসাদ এবং বড় বড় চকে ফোয়ারা নির্মাণ ও নিজের সমাধির জন্য একটা চ্যাপেল নির্মাণ করানো। বার্নিনির প্রথম আশ্চর্যম-িত সৃষ্টি হলো ‘গট আমালথিয়া উইথ দ্য ইনফ্যান্ট জুপিটার এ্যান্ড এ ফন’ যা তিনি মাত্র দশ বছর বয়সে একা হাতে করেন। প্রকা- একটি ছাগল বড় বড় লোমে ভর্তি বসে শিশু জুপিটারের দিকে তাকিয়ে। গলায় বকলেস দিয়ে ঘণ্টা বাঁধা। লোম ও দাঁড়িতে কোমলভাব সৃষ্টির মাধ্যমে জীবন্ত বোধ হয়। শিশু জুপিটার আমালথিয়ার লোমশ পেটে হাত দিয়ে দুধের বাঁটিটি খুঁজছে, নিচে পাত্র রাখা। ছাগলের দৃষ্টি শিশু জুপিটারের দিকে দেখে মনে হয় মা ছাগল তার বাচ্চা ছানার প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছে। আমালথিয়ার পিঠের দিকে ফন শিশু। যার উর্ধাংশ মানুষ ও নিম্নাংশ ছাগলের ন্যায়, পাত্রে দুধ খাচ্ছে। তাঁর আরেকটি চমৎকার কাজ ‘ট্রয় থেকে পলায়ন।’ ইনিয়াস তার বাবা এনকাইচেজ কে জ্বলন্ত ট্রয় থেকে ঘাড়ে বসিয়ে নিয়ে পালাচ্ছেন। বৃদ্ধ ধর্মভীরু নিষ্ঠাবান এনকাইচেজ আবার তার নিজের ডান বুকে ও ছেলের মাথার সাহায্যে একটি পাত্রের মধ্যে তার আরাধ্য দেবদেবীর মূর্তি উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন। ইনিয়াস বাবার উরু ও হাঁটু ঝাপটে ধরে আছেন। প্রায় পড়ি পড়ি ভাব নিয়ে ঘাড়ে বসেও নিজের পড়া নিয়ে মোটেও শঙ্কিত না বরং সকল ভাবনা আরাধ্যের মূর্তি পড়ে নষ্ট না হয় তা নিয়ে। ফিগারে শান্ত, আত্মসমাহিত, উদ্বেগহীন, অবিচলিত আত্মনিবেদিত নবীন-প্রবীণের একাত্ম উপস্থাপন লক্ষণীয়। শ্বেত পাথরের শুভ্রতা, শুচিতা, পবিত্রতা ও নির্মলতার জীবন্ত উদাহরণ ‘এ্যাপোলো ও ডেফনি’ ভাস্কর্যে। গ্রীক পুরানধর্মী কাহিনী সূর্যদেব এ্যাপোলো ড্যাফনির প্রতি আসক্ত হয়ে তাকে অনুধাবন করতে চান, ড্যাফনি ছুটে পালাচ্ছেন। শেষকাল ঠিক যে মুহূর্তে এ্যাপোলো ড্যাফনিকে ধরে ফেলেছে ঐ মুহূর্তেই ড্যাফনি একটি তরুণ গাছে পরিণত হতে আরম্ভ করেছে। ড্যাফনির হাত ডালে এবং আঙ্গুলের অগ্রভাগ থেকে নবীন পাতা রূপান্তরিত হচ্ছে। শরীরের নিচের ভাগ গাছের গুড়ি এবং উরু ও গা আস্তে আস্তে ছালে আবৃত হচ্ছে। সেই অনভ্যস্ত অভূতপূর্ব নতুন ঘটনায় দুটি ফিগারেই অপ্রস্তুত ভাব তাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট। বাতাসে চুলের উড়ে যাওয়া আস্ফালনের নবপল্লব রূপান্তর যেন ক্যামেরাবন্দী করেছে শিল্পী তার ভাস্কর্যে। মার্বেল পাথরকেও মোমের মতো নমনীয় করে তোলে এ উত্তেজনাপূর্ণ আশ্চর্যজনক নাটকীয় পরিবেশ। ‘দ্য রেপ অফ পোর্সাফিন’ ভাস্কর্যে সমস্ত বাস্তব ও পার্থিব ভঙ্গি গতিচঞ্চলতা প্রকাশ পেয়েছে। দেব সুলভ শান্তভঙ্গি অনুপস্থিত। গ্রীক পুরানে আছে পাতালের দেবতা প্লুটো মর্তে এসে পার্সিফোনিকে দেখে তার প্রতি ভালবাসা ও আসক্তিতে পাগল হয়ে বলপূর্বক হরণ করে পাতাল রাজ্যে নিয়ে যাচ্ছেন। একবার পার্সিফোনিকে নিয়ে যেতে পারলে সে আর পাতালপুরী থেকে বেরুতে পারবে না। তাই আতঙ্কে ভয়ে উদ্বেগে উন্মাদের মত প্লুটোর কবল থেকে নিষ্কৃতির লক্ষ্যে তার হাত থেকে মুক্তির জন্য ছটফট করে হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে। মুখের অসাধারণ ভঙ্গি ও পায়ের বুড়ো আঙ্গুলিতেও সে আতঙ্কের ছাপ সুস্পষ্ট। প্লুটো পার্সিফোনির কোমর এবং উরুকে ধরার যে ভঙ্গিমা তার মধ্যেই বাস্তবতার ছাপ কোমল মাংসল জীবন্ত অনুভূতির আবেশ পাওয়া যায়। বার্নিনির উল্লেখযোগ্য আরেকটি সৃষ্টি হল তাঁর ‘এক্সটেসি অব সেন্ট টেরেসা।’ রহস্যময় ফিগার পুরোটাই ধর্মীয় পবিত্রতা শান্ত ভাবপূর্ণতা প্রকাশ করে। ভাস্কর্যের উপর থেকে আলোকসম্পাতের ব্যবস্থা রয়েছে যা স্বর্গীয় আলোর অলৌকিকতার সার্থক প্রতিফলন। পাখাওয়ালা দেবদূত হাতে তীর নিয়ে সেন্ট টেরেসার বুকের কাপড় আলতোভাবে ধরে আছে এবং টেরেসার হাত, পা, খোলা মুখ ও অর্ধনির্লিপ্ত চোখের ভঙ্গি মার্বেল পাথরের ফিগারে আত্মার উপস্থিতি ক্ষণিকের স্বর্গীয় মোহজালে আচ্ছাদনের চাদর মুড়িয়ে দেয় দর্শকের মাঝে। প্রেমের দেবতার শরীর থেকে খসে পড়ছে তাঁর পাতলা কাপড়। আলতো বাতাসে পেখম মেলেছে যেন তাঁর বস্ত্রখানি। তাঁর চোখে মুখে পেলব এক আভা, যেন ভোগ করছেন তিনি এই মুহূর্তটি। তাঁর আধো উন্মিলিত চোখে মুখে স্পষ্টত শীৎকারের আভা। পরনের ভারি পোশাক অবিন্যস্ত, জড়সড় হয়ে রয়েছে। ভাস্কর্যের দুই পাত্র-পাত্রীই কিছুটা শূন্যে উড়ে আছেন। দোনাতেল্লে, মাইকেল এঞ্জেলোসহ অনেকেই ডেভিড ভাস্কর্য নির্মাণ করেছে তবে বার্নিনির ডেভিড এ বিশেষত্ব অন্য ধাঁচের। তাঁর সৃষ্ট ডেভিডে মুখাভিব্যক্তি সবার চেয়ে আলাদা। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে কুঞ্চিত ভ্রু ও কপালের ভাঁজগুলো অত্যন্ত গতিশীল করে ভাস্কর্যটিকে। ভাস্কর বার্নিনির সৃষ্ট সকল কর্মের মাঝেই পূর্ণতা এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ডিটেল পরিলক্ষিত হয়। নমনীয় ভাব থেকে কঠিন চেহারা, তুলো, দড়ি, চুল থেকে পোশাকের বোতামের কারুকার্য পর্যন্ত ফুটিয়ে তুলেছেন পাথরে। ড্রাপারির ডিটেল দর্শককে হতভম্ব করে দেয়। ‘চার নদীর ঝর্ণা’ নামক ভাস্কর্যে বিশালকার চারটি মানবদেহ দেখতে পাই। যে চারটি নদীকে নির্দেশ করে বার্নিনি এই ভাস্কর্য তৈরি করেন সেই চারটি নদী হলো গঙ্গা, লা-প্লাতা, দানিউব ও নীল। আর এই চারটি ফিগার হলো চার নদীর দেবতা। চার রকম তাঁদের আকৃতি, চার রকম তাঁদের দেহাবয়ব, চার রকম তাঁদের মুখম-লের আকৃতি। নানা অঙ্গ-ভঙ্গিতে তাঁরা মুখর। একজন বেশ শান্ত সৌম্য তো আরেকজন এমনভাবে উল্টে আছেন যে এই বুঝি ঘটবে তার সলিল সমাধি। গঙ্গা দেবতা দীর্ঘ এক দাড় নিয়ে বেগ নিশ্চিন্তে আছেন। আরেকজন কাপড় দিয়ে চোখ মুখ ঢেকে দিয়েছেন। আবার আরেকজন ন্যাড়া মাথার, এই বুঝি পড়ে গেল। প্রতিটি দেবতার চোখে মুখে এক মনস্তাত্ত্বিক খেলা চলছে যা বারোক শিল্পকলার এক প্রধান বৈশিষ্ট্য। চারটি ফিগার ছাড়াও রয়েছে এক ক্ষিপ্ত নেকড়ে, আছে নানা জাতের উদ্ভিদ, আছে চার নদীর মোহনায় সটান দাঁড়িয়ে থাকা এক ইজিপ্সিয়ান ওবেলিস্ক। পৃথিবীর শিল্পকলার ইতিহাসের সর্বকালের সেরা একজন ভাস্কর্য শিল্পী হলেন বার্নিনি। মাইকেল এঞ্জেলোর পর যিনি ভাস্কর্য শিল্পকে দিয়েছেন নতুন এক দিশার সন্ধান। যার হাত ধরে বারোক ভাস্কর্য পেয়েছে অমরত্বের স্বাদ।
×