ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টুটুল মাহফুজ ও আকিল জামান ইনু

দ্য সেলআউট দাস প্রথার নতুন বয়ান

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ৪ নভেম্বর ২০১৬

দ্য সেলআউট দাস প্রথার নতুন বয়ান

বনবন। একজন আফ্রিকান-আমেরিকান যুবকের কথা বলছি। যার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা আমেরিকার লজ এ্যাঞ্জেলসের ক্যালিফোর্নিয়া শহরে। যিনি ক্যালিফোর্নিয়ার মানচিত্র থেকে সরকারীভাবে মুছে ফেলা একটি ছোট শহরকে তুলে আনার চেষ্টা করে। এজন্য বনবন সেখানে নতুন করে দাসপ্রথা ও স্থানীয় হাইস্কুলে বর্ণ বৈষম্য চালু করে। এই কাজের জন্য দেশটির সুপ্রিমকোর্টে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় বনবনকে। আধুনিক আমেরিকাতে নতুন করে দাস ব্যবস্থাই ‘দ্য সেলআউট’ বইটির উপজীব্য। আর আমেরিকার বর্ণবাদী রাজনীতিকে বিদ্রুপ করে লেখা এই ‘দ্য সেলআউট’ বইটির জন্য পল বিটি এবার ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছেন। বিদ্রুপাত্মক এই বইটির জন্য বিচার করা পল বিটিকে মার্ক টোয়াইন ও জোনাথন সুইফটের কাতারে স্থান দিয়েছেন। ‘দ্য সেলআউট’ পল বিটির চতুর্থ উপন্যাস, যা গত বছর প্রকাশিত হয়। এর মধ্যদিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোন লেখক প্রথমবারের মতো সম্মানজনক এ পুরস্কার পেলেন। পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে তিনি ৫০ হাজার পাউন্ড পাবেন। ২০১৬ সালের ম্যান বুকার বিচারক প্যানেলের পাঁচজনই একমত হয়েছেন ‘দ্য সেলআউট’ উপন্যাসটিকে বর্ণবাদী পরিচয় ও অবিচারের সমস্যাসঙ্কুল বাস্তবতা নিয়ে লেখা একটি অন্যতম সেরা স্যাটায়ার উপন্যাসের উদাহরণ বলা যায়। বিচারক প্যানেলের প্রধান আমান্ডা ফোরম্যান বলেন, ‘এই বই সামাজিক ট্যাবুর অন্ধগলি উন্মোচন করতে পেরেছে। তিনি আরও বলেন, ‘অত্যন্ত রসিকতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সমকালীন সমাজের গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছেন পল বিটি যা সুইফট বা টোয়েনের পর আর দেখা যায়নি। এটি সত্যিই আমাদের সময়ের একটি উপন্যাস।’ বইটি লেখাকালীন বিটির কাজ নিয়ে একটি টিভি শোতে প্রশ্ন করেছিলেন কলসন হোয়াইট হেড নামের একজন মার্কিন উপন্যাসিক। প্রশ্নটি ছিল এ রকম যে, মি. বিটি আপনি এখন কি নিয়ে কাজ করছেন। এর উত্তরে সেদিন বিটি বলেছিলেন, আমি হয়ত নিজের জন্য আর একটি ব্যর্থতার ক্ষেত্র তৈরি করছি। মঙ্গলবার লন্ডনের ঐতিহাসিক গিল্ড হল ভবনে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে বিটির হাতে এ পুরস্কার তুলে দেয়া হয়। প্রিন্স চার্লসের স্ত্রী ক্যামেলিয়ার (ডাচেস অব কর্নওয়াল) কাছ থেকে পুরস্কারটি নেন পল বিটি। পুরস্কার নেয়ার জন্য যখন মঞ্চে ওঠেন তখন তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। পুরস্কার গ্রহণের পর অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে পল বিটি বলেন, ‘এই বইটি লেখা আমার জন্য অনেক কঠিন ছিল। এটি লিখতে অনেক কষ্ট হয়েছে। আমি জানি, এটা পড়াও বেশ কঠিন।’ বিচারকরা বলেছেন, উপন্যাসটিতে লস এ্যাঞ্জেলেসের বাসিন্দাদের ‘একটি দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত মজার’ প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বইটি প্রকাশের পূর্বে সর্বমোট ১৮ জন প্রকাশক প্রকাশে অসম্মতি জানায়। এবং শেষ পর্যন্ত একটি ছোট প্রকাশনী সংস্থা বইটি প্রকাশে সম্মত হয়। সংস্থাটির নাম ওয়ান-ওয়াল্ড। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি একটি দম্পতি পরিচালনা করেন। তাদের প্রকাশিত বইয়ের এটি দ্বিতীয় ম্যান বুকার বিজয়। তাদের বুকার জয়ী প্রথম বইটি ছিল মারলন জেমসের ‘দ্য হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিং।’ বইটির প্রকাশ পূর্ব পরিস্থিতি বর্ণনা করতে যেয়ে পল বিটি বলেন, ‘যে বিষয়টি তাকে সবচেয়ে বেশি আহত করেছে তা হল, বইটি ভাল কিন্তু তারা তা প্রকাশে অক্ষম। তার ভাষায় তারা কি বোঝাতে চেয়েছেন তিন বোঝেননি। ১৯৬২ সালে লস এ্যাঞ্জেলেসে জন্ম নেয়া পল বিটি বর্তমানে নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনে বসবাস করছেন। তিনি ব্রুকলিন কলেজ থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিং ও বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে মনোবিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। বর্তমানে তিনি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন। তিনি তাদের সামনে বোস্টনে অধ্যায়নকালীন অভিঙ্গতার কথা বর্ণনা করেন। তিনি ছাত্রদের সামনে একটি চিত্র আঁকেন। চিত্রটি এই যে, ‘তুমি তোমার কাছে নিজের বলা কথাগুলো শুনতে শেখ। যা তুমি ভাবছো তা নয়। বরং তোমার অন্তরাত্মা যা বলছে।’ শ্রেণীকক্ষে তিনি ছাত্রদের অন্য কাউকে নিয়ে কথা বলা পছন্দ করেন না। বরং তিনি বলেন, তুমি নিজেকে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে তুলনা কিছুই অর্জন করতে পারবা না। বরং স্বতন্ত্র হতে চেষ্টা কর। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য হোয়াইট বয় শাফল’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘টাফ’ ২০০০ সালে ও তৃতীয় উপন্যাস ‘স্নামবারল্যান্ড’ প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। সাত বছর পর ‘দ্য সেলআউট’ প্রকাশিত হয়। ম্যান বুকার পাওয়ার আগে ‘দ্য সেলআউট’ জয় করেছে ২০১৫ সালের ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক্স এ্যাওয়ার্ড এবং ঠাঁই মিলেছে নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের জরিপে ২০১৫-এর সেরা বইয়ের তালিকায়। বিটি জাপানী আর রাশিয়ান সাহিত্য ভালবাসেন। তার মা ভালবাসতেন এশিয়ান সাহিত্য। আর এখান থেকেই বিটির এশিয়ান সাহিত্যের প্রতি ভাললাগার শুরু। তার কাব্যিক শব্দ গঠন নিজের কাছেই আত্মজিজ্ঞাসার ক্ষেত্র তৈরি করে। বিটি উপন্যাসের প্রথাগত ধারণায় বিশ্বাস করেন না। তার বিশ্বাস কাগজের ওপর নিজের মতো করে যে কোন কিছু লেখার অধিকার আছে। তাই তার রচনায় কবিতা এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবেই। তার ভাষায় সেগুলো তার নিজের কাছ থেকেই চুরি করা। বিটি কার্ট ভোনেগার্ট এবং কেনজি মিজোগুচির শিল্পকর্ম পছন্দ করেন। তার ভাষায়, তিনি এ রকম ক্রিয়েটিভ শিল্পকর্ম দেখে বজ্রাহত হতে পছন্দ করেন। তিনি কিছু পছন্দ করেন বলে প্রভাবিত হন না বরং যে কোন শিল্প তার অভ্যন্তরে অনুরণের সৃষ্টি করে তা দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি বেপরোয়া মানুষ পছন্দ করেন। তার মা তাকে প্রায়ই ব্যঙ্গ করতেন এমন সব ছবি ভালবাসার দায়ে যা আপাতদৃষ্টিতে কোন অর্থ নেই। যেমন, তলোয়ারবিহীন তরবারি যুদ্ধের ছবি। তার লেখালেখি নিয়ে বিটি বলেন, তিনি সাধারণত ভোরে লিখতে পছন্দ করেন। কখনও বা রাত্রিতেও। তিনি প্রতিদিনই কিছু না কিছু লেখেন। লিখতে লিখতে শব্দধারা থেমে গেলে তিনি হাঁটতে যান অথবা শপিংয়ে যান। মাথায় আধা ডজন ধারণা নিয়ে তিনি খুঁজে ফেরেন তার প্রয়োজনীয় গল্পটি। সব সময় যে তিনি তার প্রয়োজনীয় গল্পটি খুঁজে পেতে সফল হন, তাও নয়। লেখালেখিতে স্থবিরা নেমে এলে তিনি গানও শুনতে পছন্দ করেন। গানগুলোর সংখ্যাও কিন্তু খুব বেশি নয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি তার পছন্দের অল্প কটি গানই শুনে আসছেন। কিন্তু তার ধারণা এটি তার ব্যক্তিগত বিষয়। এবং তিনি চান না, কেউ তার গান পছন্দের রুচি নিয়ে হাসুক। তবে কিছু গান উল্লেখিত হয়েছে তার ‘দ্য সেলআউট’ উপন্যাসে। বিটি তার একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে যেয়ে বিট কবি গ্রেগরি কোর্সের সঙ্গে একটি কর্মশালার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। যেখানে কোর্স তাকে বলেছিলেন, আপনার আন্তর্জাতিকতা কোথায়? তিনি উত্তরে কেবল শ্বেতাঙ্গ ঘরনার কবি কোসদের আন্তর্জাতিকতা নিয়ে মুখের ওপর হেসেছেন। বিটি স্থবিরতার মধ্যে গতি দেখতে পান। আর অপেক্ষায় থাকেন নীরবতার মধ্যেও শব্দ শোনার। তিনি বিশ্বাস করেন, যে কোন রচনার পেছনে গবেষণার বিশেষ ভূমিকা থাকে। তিনি অনবরত গবেষণা করে যাচ্ছেন। হতে পারে সেটি কেবল একটি শব্দের খোঁজে অথবা কখনও তার চেয়ে বেশি কিছু। ২০১৬ সালের ম্যান বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্য যে বইগুলো ছিল সেগুলো হচ্ছে যুক্তরাজ্যের ডেবোরা লেভির ‘হট মিল্ক’, যুক্তরাজ্যের গ্রায়েমি মাকরে বার্নেটের ‘হিজ ব্লাডি প্রজেক্ট’, মার্কিন লেখক ওটেসা মোশফেগের ‘ইলেন’, কানাডার ডেভিড সাজলের ‘অল দ্যাট ম্যান ইজ’ ও কানাডার ম্যাডেলিন থেইনের ‘ডু নট সে উই হ্যাভ নাথিং’। গত বছর জ্যামাইকান লেখক মারলন জেমস তাঁর ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিং’ উপন্যাসটির জন্য ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছিলেন। জ্যামাইকার প্রথম লেখক হিসেবে তিনি এ পুরস্কার জয় করেছিলেন। আর ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার লেখক রিচার্ড ফ্ল্যানাগান তাঁর ‘দ্য ন্যারো রোড টু দ্য ডিপ নর্থ’ উপন্যাসের জন্য ম্যান বুকার পেয়েছিলেন।
×