ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

কবি মোহাম্মদ রফিকের আমার জীবনানন্দ

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৪ নভেম্বর ২০১৬

কবি মোহাম্মদ রফিকের আমার জীবনানন্দ

কবি মোহাম্মদ রফিকের ‘আমার জীবনানন্দ’ বইটি প্রকাশ পায় ২০১৬-এর অক্টোবর মাসে কবির ৭৪তম জন্মবার্ষিকীতে। কবিতার অঙ্গনে অনুক্ষণ বিচরণ করা কবি মোহাম্মদ রফিকের প্রবন্ধ-সাহিত্যও এক অসাধারণ নির্মাণশৈলে পাঠক সমাজকে মুগ্ধ করে। শব্দচয়নের নান্দনিকতা, গভীরতা এবং ব্যাপ্তি কবির নিজস্ব শৈল্পিক শৌর্য। বিষয়বস্তুতে আছে এক অনাবিল অনুভব, অনুভূতি যা কবিকে সব সময়ই আরেক কবির প্রতি নিমগ্ন হওয়ার প্রেরণা তৈরি করে। গোটা গ্রন্থটিতে একবার চোখ বুলালে বুঝতে কষ্ট হয় না জীবনানন্দের প্রতি গ্রন্থকারের ভালবাসা, নিবেদন এবং জানা-বোঝার এক অকৃত্রিম আগ্রহ এবং উদ্দীপনা। জীবনানন্দকে পাঠক সমাজের কাছে তুলে ধরার যে বোধ কবিকে তাড়িত করে তা তাঁরই কথা থেকে উদ্ধৃত করছি- ‘প্রকৃত কবি সত্তাটি যথারীতি ধরা পড়ে কোন এক বিষম অনুভবের কেন্দ্রবিন্দুতে, কিংবা ওই অনুভব তাড়িত উৎপ্রেক্ষার পরিম-লে। কবি জীবনানন্দ দাশে প্রবাহিত মূল অনুভবের মাত্রাও প্রগাঢ়ত্ব চিনে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এই গ্রন্থে সংবলিত বিভিন্ন আকার-প্রকারের রচনায়।’ জীবনানন্দকে চেনা, জানার এই ক্ষেত্র উন্মোচন করতে গিয়ে সমকালীন সমাজ, শ্রেণী, সংস্কৃতি, শাসন-অপশাসন এবং বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক আগ্রাসন এবং যুদ্ধের উন্মত্ততাকে একেবারে মূল থেকে চিহ্নিত করতে হয়েছে। কবির জন্ম ১৮৯৯ সালে। গড়ে ওঠা, তৈরি হওয়া, সৃষ্টিশীল জগৎ নির্মাণ করা সবই রবীন্দ্র বলয়ের মধ্যেই। তাই রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ বারে বারে এলেও স্বাতন্ত্রিক এক বৈশিষ্ট্যে জীবনানন্দ দাশের নিজস্বতা ও নানামাত্রিকে লেখককে অভিভূত করে। তিরিশের দশকের কবিদের মধ্যে যে ব্যতিক্রমী আধুনিকতার জোয়ার তৈরি হয়, জীবনানন্দও ছিলেন সেই নতুন স্রোতের একজন সচেতন নাবিক। গ্রন্থের রূপকার মনে করেন, এই আধুনিকতা শুরু হয় মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে, রবীন্দ্রনাথে তার স্থিত হয়। পরবর্তীতে তিরিশের দশকের নতুন কবিরা যে ভিন্নধারার আধুনিকতার উত্তরণ ঘটান সেখানে জীবনানন্দ দাশ একেবারে সময়ের নির্ণায়ক। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ’ এবং ১৯২৯ সালে জীবনানন্দের ‘বোধ’ কবিতাকে তুলে ধরে পুরো কবিতায় বিশ্বকবির অদম্য অস্থিরতার সঙ্গে জীবনানন্দের ধীরগতিতে স্থিরভাবে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ গ্রন্থকারকে দুই ভিন্ন আবহের সঙ্গে পরিচয় করায়। লেখকের উক্তি স্মরণ না করলে বিষয়টি বোঝা আসলেই দুঃসাধ্য। ‘বেরিয়ে পড়ার অপ্রতিরোধ্য অস্থিরতা এবং অতৃপ্তি গদ্যের শাসনও যেন মানবার নয়, সুতরাং ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতটিও যেন নিজেকে নিজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়ার বাসনায় চতুর্দিকে উছলে পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক।’ কিংবা ‘ধীরে অতি ধীরে, তবে সুনির্দিষ্টভাবে কবি তাঁর আপন কণ্ঠস্বর যে আয়ত্তে নিয়ে আসছেন সে খবর টের পেতে যে কোন সচেতন পাঠকের আর ততটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ার কথা নয়। বইটিতে জীবনানন্দের জন্মশতবার্ষিকীতে কবিকে উৎসর্গ করে কবিতাও সংবলিত হয়েছে।’ ‘বনলতা সেন’ পড়ার সেই প্রথম দুর্লভ মুহূর্তটি আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। উদীয়মান কিশোরের ভাললাগা, অনুভব-অনুভূতির সঙ্গে ক্ষীণ হয়ে গেল ‘বনলতা সেনের কাব্যিক বৈভব, যা আজও ভেতর থেকে লেখককে উদ্বেলিত করে। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে একই সালে জন্মগ্রহণ করা কাজী নজরুল ইসলামের জীবনাচরণ এবং তাঁর সৃষ্টি বৈচিত্র্যের ভিন্নতা। বর্ধমান এবং বরিশালের ভিন্নমাত্রার সামাজিক, প্রাকৃতিক এবং পরিবারিক প্রতিবেশ সমসাময়িককালের দুই কবির গন্তব্যের ফারাক তৈরি করে দেয়। অথচ দুই কবিই আপন সৃষ্টির মহিমায় অনবদ্য এবং তুলনাহীন। বাংলার চিরায়ত নৈসর্গিক, নান্দনিক এবং দার্শনিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ জীবনানন্দের সৃজনভা-ার বাংলা সাহিত্যের এক অনুপম সম্পদ। এ কথাটাই ঘুরেফিরে লেখকের মানস জগতকে তাড়িত করে। বেঁচে থাকতে কবির সৃষ্টি বৈচিত্র্য না বোঝার অক্ষমতার দায়ভারও চাপিয়েছেন নিজস্ব সম্পদ আর ঐতিহ্য থেকে ছিটকে পড়া সমকালের অনাগ্রহী পাঠকের ওপর। জীবনানন্দকে চেনার, উপলব্ধি করার, তাঁর সাহিত্যের মর্মমূলে প্রবেশ করার যে অনবদ্য প্রয়াস লেখকের তার জন্য তাঁকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। রুচিশীল পাঠক তৈরিতে বইটির ভূমিকা হবে সুদূরপ্রসারী। সামগ্রিক জীবনানন্দকে উপস্থাপন করতে গিয়ে সেই সময়কার সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ঔপনিবেশিক দুঃশাসন, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের দাবানল সবই লেখকের সুচিন্তিত মতাদর্শে সূক্ষ্মভাবে আলোচিত হয়েছে, যা শুধু জীবনানন্দকেই চেনাবে না; আরও অনেক বেশি স্পষ্ট হবে তৎকালীন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিম-ল। লেখকের এই গভীর চিন্তার ফসল পাঠকের মননকেও নানামাত্রিকে সমৃদ্ধ করবে। অনেক অজানা, অচেনা ক্ষেত্রের দ্বার খুলে দেবে। বিশ্লেষণধর্মী এই লেখটি পাঠক সমাজে আদৃত হবে এই আশা ব্যক্ত করে বইটির সফলতা কামনা করছি।
×