ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেজওয়ানা আলী তনিমা

নারীর অনলাইন নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ৪ নভেম্বর ২০১৬

নারীর অনলাইন নিরাপত্তা

প্রযুক্তির আশীর্বাদে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। এরই অনুষঙ্গ হয়ে যুগের প্রয়োজনে এসেছে নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কড ইন ইত্যাদি। প্রযুক্তি সাধারণভাবে মানুষের জন্য ভীষণ উপকারী হলেও কারও কারোর জীবনে হয়ে এসেছে অভিশাপ, বিশেষভাবে ভুক্তভোগী হলেন নারীরা। অনলাইনে নারীর ওপর রকমারি হয়রানি হচ্ছে। ফেসবুকে এডিট করে বিকৃত ছবি ছড়িয়ে দেয়া, ব্যক্তিগত গোপনীয় ছবি ও ভিডিও শেয়ার, আজেবাজে কমেন্ট করে হেনস্থা, অশ্লীল বার্তা পাঠিয়ে বিরক্ত করা, অসৎ উদ্দেশ্যে ফেইক এ্যাকাউন্ট তৈরি, অযাচিত নজরদারি ইত্যাদি কর্মকা-ের ফলে বহু নারীর জীবনে বিপর্যয় নেমে আসছে। সামাজিকভাবে নারীর সম্মানহানি হচ্ছে। এমনকি আত্মহত্যাও করছেন কেউ। অনলাইনে যেমন চরিত্রহীন বিবেকহীন লোক কর্তৃক নারীর ওপর ঘরে বাইরে অত্যাচার হলে মেয়েরা নীরবে সহ্য করেন, করতে বাধ্য হন সে রকম অনলাইনেও তো সেই মানুষগুলোরই উপস্থিতি, সেই একই সমাজ এখানে শুধু মেয়েদেরই ওপর কড়া প্রহরায়, পুরুষেরা যাই করুক দোষ মেয়েদের ওপরই আসে। অতএব শুভাকাক্সক্ষীর তরফ থেকে মেয়েটিকেই গুটিয়ে যেতে বলা হয় অনেকক্ষেত্রে। কিন্তু গুটিয়ে ফেললেই কি সব রক্ষা হয়? যেখানে পুরুষ নারীর প্রতি যে কোন অন্যায় করে পার পেয়ে যেতে পারে তাতে সমস্যা থেকে পালিয়েও কতদূর বাঁচা যায়? যেমন ধরা যাক- খুব বেশি আগের কথা নয়, ২০১৪-এর ঘটনা। চট্টগ্রামের এক কলেজছাত্রীর বাড়িতে কম্পিউটার ও মোবাইল মেরামতকারী যুবক ইমরান কাজ করতে এসে গোপনে মেয়েটির ছবি নিয়ে নিজের ফেসবুক এ্যাকাউন্টে ছেড়ে দেয়। শেয়ার ও অশ্লীল মন্তব্য হলে ছবিটির কথা জানাজানি হয়ে যায়। তাহলে বলা যায়, যেখানে নিজের ঘরেই এমন বিপদের আশঙ্কা সেখানে নারী কোথায় কিভাবে নিরাপদ হবে? কতখানি সঙ্কুচিত করবে নিজের সুস্থ অবাধ জীবনের অধিকারকে? সমাজের খাতিরে মেয়েদের অধিকাংশই গ্লানি চেপে রাখেন। খোদ ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম একবার মন্তব্য করেছিলেন, তিন-চতুর্থাংশ নারীই সাইবার নির্যাতনের শিকার হলেও অভিযোগ করেন মাত্র প্রায় এক-চতুর্থাংশ! ভাবা যায়! খোদ দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ মহল থেকেই বলা হয়, মেয়েরা একেবারে নিরুপায় না হলে আইনী ব্যবস্থা নেন না। কারণও ওই সমাজ। যে সমাজ অপরাধীকে স্র্রেফ পুরুষ বলেই রক্ষা করে, অপরাধের শিকার হয়েও লোকলজ্জার ভয়ে একাকী মেয়েটি দগ্ধ হয়। করণীয় কি? অবশ্যই প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার উত্তম। তাই নিজের অনলাইন এ্যাকাউন্টগুলোর সুরক্ষা খুব জরুরী। এ ছাড়াও নিজের ছবি ও ভিডিও শেয়ার করার বেলাতেও সাবধান থাকা দরকার। সমস্যা হলে আইনী ব্যবস্থা নেয়া দরকার হতে পারে, লাগতে পারে কাউন্সেলিং সাহায্য। জরিপ চালিয়ে ও সংশ্লিষ্ট সাহায্যকারী সংস্থার কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেকেই জানেন না কোথায় সাহায্য পাওয়া যায়। সাইবার অপরাধ হলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে সর্বোচ্চ ১৪ বছর জেল পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়াও কোন অভিযোগ থাকলে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি (বিটিআরসি) কমিশনকে ইমেইল, ওয়েব-বক্সে ও ডাকযোগে জানানোর সুবিধা আছে। অভিযোগ প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে গেল মে থেকে একটি চার ডিজিটের শর্টকোড (২৮৭২) কল সেন্টারের মাধ্যমে চালু হয়েছে। এখন শুধু মোবাইলে সম্ভব হলেও শীঘ্রই ল্যান্ডফোন, পিএসটিএন বা ফিক্সড ফোন নম্বর থেকে অভিযোগ/পরামর্শ দেয়া-নেয়া যাবে এমন ব্যবস্থা হবে। তা ছাড়াও আছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হেলপলাইন-১০৯২১। সুবিধা আছে, অনেকে জানেন না- কিন্তু কথা এখানেই শেষ নয়। শুধু আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়। দরকার সমাজের মানসিকতা বদল ও সেই বদলের পেছনে নারীর নিজের মনোবল। আবার দেখা গেছে যারা নারীকে উত্ত্যক্ত করে বেশিরভাগ সময়েই তারা প্রভাবশালী। বিচারকে প্রভাবিত করতে সক্ষম বা বিচার হলেও প্রতিশোধ নেয়ার ভয় আছে। এ জন্য নারীরা সাহস করে উঠতে পারেন না। উপরোল্লিখিত ইমরানের ঘটনায় ছাত্রীর পরিবার পুলিশকে অভিযোগ করলে ভ্রাম্যমাণ আদালত এক বছরের কারাদ- দেয় তাকে। এখানে নারীটি ও তার পরিবার ব্যতিক্রমী সাহস দেখিয়েছেন ঠিকই কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার সাজাপ্রাপ্ত যুবক সমাজের ক্ষমতাধর সদস্য না, সাধারণ মেকানিক মাত্র। নারীকে দমিয়ে দিতে চাইলেও নারীরা প্রতিবাদে এগিয়ে আসছেন। হয়ত ধীরে হয়ত সংখ্যায় কম কিন্তু আসছেন। নিন্দা, লোকভয়ের ঝুঁকি নিয়েও আওয়াজ তুলছেন এমন একটি দিনের জন্য যেদিন নারী ও পুরুষ উভয়েই সমাজে সম্মান নিয়ে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকবে। অপরাধী হোক পুরুষ, নিরীহ নারীকে নির্যাতন হয়রানি করে কেউ পার পাবে না। আসবে তো এমন সোনালি দিন?
×