ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাহেরা বেগম জলি

হে সভ্যতা শিহরিত হও

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ৪ নভেম্বর ২০১৬

হে সভ্যতা শিহরিত হও

পাঁচ বছরের ছোট্ট পূজা, এক নিষ্ঠুর শিকারে পরিণত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। ওর ভেতরে যতটুকু প্রাণ আছে, তা এ সমাজকে বিদ্রুপ করার জন্যই। ওর সংজ্ঞাহীন নিথর দেহের উপস্থিতিই বলে দেয়, এ সমাজ হয়ে উঠেছে মানুষের বসবাসের অযোগ্য। বিষাক্ত পিশাচের দংশনে পূজার সারা শরীর বিষে জর্জরিত। এক উন্মাদ পূজাকে তার ভয়াবহ বিকৃতির শিকারে পরিণত করেছে। ফুলের মতো পূজার হাসি নিভে গেছে সারা জীবনের মতো। গোটা সমাজ পূজার কাছে হারিয়েছে বিশ্বাসযোগ্যতা। ও চোখ মেলে দেখবে, ওর চারপাশে মানুষ নেই। চারদিকে চরে বেড়াচ্ছে ওকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার এক ধরনের ড্রাকুলার। ওর দিকে নখরদন্ত বিস্তার করে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে এক শ্বাপদজন্তু। আর কিছু ক্লিব জাতীয় প্রাণী- আমরা নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছি- এ জীবন থেকে সে জীবনে। পূজার এই উপলব্ধি ক্রমেই বদ্ধমূল হবে, পূজাদের জীবন এ সমাজে ক্রমাগত বিপন্নই হতে থাকবে। শুধু পূজারই উপলব্ধি কেন, ঘটনাও তো তাই-ই বলে। আমাদের চারপাশে আগাছার মতো বেড়ে উঠছে এক শ্রেণীর ভয়াবহ নরপশু। পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে- ওরা যেন অপ্রতিরোধ্য। তাছাড়া ক্রমাগত ওদের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রমাণ করে দেয়, কোন না কোনভাবে সমাজে তারা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছে। কিছুদিন আগেও নারী শিশু নিপীড়ন ছিল বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ঘটনা। কিন্তু আজ তা অস্তিত্ববিনাশী শক্তি নিয়ে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে মহামারির মতো। আমরা দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি নারি-শিশুর জীবনের নিরাপত্তার বলয় ভেঙ্গে পড়েছে পুরোই। পৈশাচিক তাণ্ডবের লাগাম যেন চলে যাচ্ছে আমাদের নাগালের বাইরে। দুর্বৃত্ত সমাজের কাছে ঘোলা পানি অনেকটা নির্মল বায়ুর মতো। মানুষকে হিতাহিত জ্ঞান শূন্যতার স্তরে নামিয়ে আনতে পারলেই ওদের লাভ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই চক্রান্তের অনুকূলেই বইছে আমাদের সমাজের বাতাস। দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদে পা দিয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের যুবসমাজের একটা বড় অংশ। যার অনেক বড় মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদের। নারী-পুরুষ শুধুমাত্র নারী-পুরুষ নয়, মানুষও। এটাই কিছুদিন আগেও আমাদের দেশের স্বাভাবিক চিত্র ছিল। কিন্তু কালবৈশাখীর ঝড়ে সব যেন হয়ে যাচ্ছে লণ্ডভণ্ড। প্রাকৃতিক ঝড়ে যেমন ভেঙ্গে পড়ে- দুর্বল ঘর বাড়ি,পুরনো গাছপালা। ঠিক তেমনি আমাদের দেশের বঞ্চিত দুর্বল জনগোষ্ঠী পরিণত হচ্ছে বিপথগামী গোষ্ঠীর শিকারে এবং মানবিক মূল্যবোধ থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে যোজন যোজন দূরে। মাঝে মধ্যে মনে হয় আমাদের দেশে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা সামাজিক দায়কে নিজেদের দায় মনে করেন। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে কেন জানি তাদের দেখা পাই না। উঁকিঝুঁকি মেরে দু-একজন গলা বাড়িয়ে বলতে চান, আমরা অর্থনীতি-রাজনীতি নিয়ে ভাবতে গিয়ে, হাতে সময়ের বড় টান পড়েছে বা পাঁচ বছরের শিশু পূজাকে নারী বানিয়ে, আরও দু-একজন সৎ উপদেশ দেয়ার গরজে বলেন, নারীদের নিরাপত্তার দায় নারীদেরই নেয়া উচিত! তাদের অবগতির জন্য নিবেদন করছি। নারী শিশু নিধনের যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে, এটা বড় ধরনের সামাজিক সঙ্কট। তাদের জানা দরকার নগরে আগুন লাগলে তার থেকে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। সমাজের অভ্যন্তরে একে অপরের মাংস খুবলে খাওয়ার যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, এর উত্তাপ থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। নদীর পাড় যখন ভাঙ্গে, চার পাশ নিয়েই ভাঙ্গে। পক্ষান্তরে আমাদের দেশের বিদুষী নারী নেতৃত্ব, পুরুষের সমকক্ষ হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় বেশ এগিয়ে। আমরা তা অত্যন্ত সম্মানের চোখেও দেখি। কিন্তু এটা না ভেবে পারিনে, ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়ে কতখানিই বা এগোনো যায় বা আদৌ এগোনোর পরিবর্তে ক্রমেই হাস্যকর মানুষে পরিণত হচ্ছি কিনা! নারী আন্দোলনের যে শক্তি এখনও আমাদের দেশে বিরাজমান, তাতে, তাদের মোহমুক্তি ঘটলে, নারী-শিশু নির্যাতন আমাদের দেশে বীভৎসতার এতবড় উপকরণ হয়ে নিশ্চয় থাকবে না। যে দেশে প্রতিদিন নারী শিশু নিপীড়নের লোমহর্ষক একেকটা ঘটনা আমাদের জীবনকে করে তুলেছে অসহনীয়। সেই দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী কিন্তু নারী। সেই নারী গোষ্ঠীর কোটায় যারা মহান সংসদে প্রবেশ করেছেন, তাদের কাছেও আমাদের কিছু প্রত্যাশা থেকে যায়। যাকগে, পাথরে মাথা ঠুকলে মাথাই রক্তাক্ত হবে। বরং ফিরে যাই বাস্তবে। এমন একটা সকাল আমরা চাই, যেদিন আমরা সত্যিকার মানুষের মতো শুরু করতে পারব দিন। যদিও আজ আমাদের কাছে এটা অনেক বেশি চাওয়া। কারণ, অগ্রগতির ঝলকানির মাঝে আমাদের (নারী জাতির) চারদিকে ঘনিয়ে এসেছে ঘোর অন্ধকার। সমঅধিকারের সঙ্গে সমদায়িত্বের নির্মম প্রশ্নের মুখোমুখি আজ আমরা দাঁড়িয়ে। রক্তাক্ত আক্রমণ রুখতে হলে চাই রক্তাক্ত প্রতিরোধ এবং নিশ্চয় তা একতরফা নয়। এখানে মুখ লুকিয়ে সরে যাওয়ার কোন পথ নেই। বার বার নারী জাতিকে নাইবা টানলাম! যাদের রক্তে বার বার রঞ্জিত হচ্ছে আমাদের মাটি, তাদের পাশে আজ মাতৃজাতিকে দাঁড়াতেই হবে। তবেই আমারই রক্ত মাংসে আশ্রয় নিয়ে বেড়ে ওঠা পূজাদের রক্ষা করতে পারব।
×