ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রাচীন সুড়ঙ্গ হারং হুরং

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ৪ নভেম্বর ২০১৬

প্রাচীন সুড়ঙ্গ হারং হুরং

সপ্তাহের পাঁচদিন অফিসের কাজে ডুবে থাকতে হয়। শুক্রবার এলেই ঘরে বসে থাকতে মন চায় না বের হয়ে যাই নতুন কিছুর সন্ধানে। তবে এবারের অভিজ্ঞতাটা একটু অন্যরকম। ফেসবুকের কল্যাণে বন্ধু কল্লোল দেব এর কাছ থেকে সন্ধান পেলাম প্রাচীন এক সুড়ঙ্গের নাম হারং হুরং। সিলেট শহরের মালনিছড়া চা বাগানের আশপাশে অবস্থিত এই সুড়ঙ্গ এতটুকু জানতে পেরেছি। দুই সপ্তাহ ধরে পরিকল্পনা করে যাওয়া হয়ে উঠছিল না। শেষ পর্যন্ত আমরা রওনা দিলাম প্রাচীন সুড়ঙ্গ হারং হুরং এর উদ্দেশে। সিলেটি ভাষায় ‘হারং’ মানে সাঁকো বা বিকল্প পথ আর ‘হুরং’ মানে ‘সুড়ঙ্গ’। অর্থাৎ ‘হারং হুরং’ মানে হলো বিকল্প সুড়ঙ্গ পথ। কথিত আছে ১৩০৩ সালে হযরত শাহজালাল (রহ) এর সিলেটে আগমনের খবর পেয়ে রাজা গৌড় গোবিন্দ তার সৈন্যবাহিনীসহ পেঁচাগড় গিরিদুর্গের সুড়ঙ্গপথ দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর নিরুদ্দেশ হয়ে যান। পড়ন্ত দুপুর আমার সঙ্গী ডেনি শর্মা, অজয় আর সঞ্জয়। বাগানের আঁকা বাঁকা পথ অতিক্রম করতে হবে এই ভেবে আমরা দুই চাকার যানকে সঙ্গী করে নিলাম। চৌহাট্টা, আম্বরখানা লাক্কাতুরা চা বাগানরে পাশ কাটিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম চা বাগান মালনীছড়ার মূল কার্যালয় সংলগ্ন রাস্তার মাথায়। উপমহাদেশে বাণিজ্যিক চা উৎপাদনের শুরটা এ বাগান থেকে লর্ড হার্ডসনে হাত ধরে। আমাদের কেউই রাস্তা চিনি না তাই সিদ্ধান্ত হলো একজন পথপ্রদর্শক নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করব। বাগানের মুখে বেশ কয়েকজনকে দেখলাম জটলা করে বসে আছে জিজ্ঞেস করলাম, হারং হুরং সুড়ঙ্গ চিনেন নাকি সবার মুখের ভাব দেখে মনে হলো চিনে না। পড়ে মনে হলো রাজা গৌর গোবিন্দের কথা বললে হয়ত চিনবে ঠিক তাই হলো। বাগানের এক কুলিকে পথপ্রদর্শক হিসেবে পেলাম নাম জগন্নাথ। সে এই পথ প্রদর্শনের জন্য দুই শ’ টাকা দাবি করল আমরা আর না করলাম না। আমরা বাগানের মিষ্টি পথ ধরে এগিয়ে চলছি। এক-দেড় কিলোমিটার পরেই বাগানের বালুময় পথের শুরু। দুপাশে উচ্চ টিলায় সুবিন্যস্ত চায়ের বাগান, তার মাঝে সোজা আকাশের দিকে উঠে যাওয়া শেড গাছ মিলে আশ্চর্য এক সবুজের ধারা তৈরি করেছে। অসাধারণ এক প্রাকৃতিক মোহের মাঝে আমরা এগিয়ে চলছি। বৃষ্টির ফলে বাগানের ছড়াগুলোতে জলের প্রবাহ বেশি। জলের মোহনীয় শব্দে মন ভরে যায়। কিছু কিছু পথ খুব ভাঙ্গাচোরা। বৃষ্টির কারণে হয়েছে। খুব সাবধানে দুই চাকার যান নিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। গত দুই সপ্তাহ আগে আমাদের সঙ্গী ডেনি শর্মা মোটরসাইকেল এ্যাক্সিডেন্ট করেছে তাই আজ সে খুব সতর্কভাবে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। আমি একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছি। চলিত পথে কথা হলো জগন্নাথের সঙ্গে ও বলল, বাগানের লোকদের কাছে হারং হুরং সুরঙ্গ গৌর গবিন্দ রাধা গুহা নামে অধিক পরিচিত। তারা প্রতি শনি মঙ্গলবারে পূজা দেয় এখানে। আমরা পৌঁছে গেলাম তেলিহাটি চা বাগানে। শুরুতেই ছোট বাজারের মতো রয়েছে কিছু চায়ের দোকান, চা শ্রমিকদের কিছু ঘর, রাগীব-রাবেয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় আর একটা মসজিদ। আমরা চলছি হঠাৎ করে জগন্নাথ বলে, বাবু আমরা ভুল পথে চলে এসেছি! রাস্তাটা অন্য দিকে হবে হয়ত! আপনারা এখানে অপেক্ষা করেন। আমি সামনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসি। আমারা দেখলাম রাস্তাটা খুব চমৎকার। জগন্নাথ রাস্তার খোঁজ নিয়ে আসুক এই ফাঁকে আমরা কয়েকটা ছবি তুলে নিই। আমি মনের আনন্দে প্রকৃতির ছবি তুলছি। রাজেশ ডেনি ওরা সেলফি তোলায় ব্যস্ত। নিঃস্তব্ধ পরিবেশ জনমানব শূন্য। মনে মনে ভাবছিলাম এমন নিঃস্তব্ধ পরিবেশে মানুষ থাকে কি করে। আমাকে লাখ টাকা দিলেও কেউ রাখতে পারবে না। হঠাৎ করে অজয় মনে করিয়ে দিল প্রায় আধা ঘণ্টা হতে চলল কিন্তু জগন্নাথ তো আসছে না ফিরে আমারও মনে হলো ঠিক তাই তো জগন্নাথ তো এখনও এলো না। এদিকে সন্ধ্যা হতে চলল মোবাইলের নেটওয়ার্কও নেই জনমানব শূন্য। এর মাঝে ডেনি আরও ভয়ঙ্কর কথা শুনালো ওরা বাইকে তেল লোড করে আসেনি দূরত্ব বেশি হবে না এই ভেবে। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের সামনের দিকে না এগিয়ে ফিরে যাওয়া উচিত কারণ সন্ধ্যা হতে চলল। আমারা ফিরছি দশ পনেরো মিনিট পরে আমার মনে হলো আমরা ঠিক পথে ফিরছি তো পাহাড়ী আঁকা বাঁকা পথ ভুল পথে বেশিদূর গেলে আজ আর বাসায় ফিরতে হবে না এখনে রাত কাটাতে হবে। এদিকে খেয়াল করলাম রাস্তায় কোন মোটরসাইকেলের চাকার দাগ নেই আর এখানে কোন মানুষের উপস্থিতিও। সবাই মোটামুটি ঘাবড়ে গেছে আমি বললাম, এই রাস্তা না আমরা ভুল রাস্তায় এগোচ্ছি। তাই আর দেরি না করে মোটরসাইকেল এর চাকার দাগ খুঁজতে লাগলাম। অন্য পথে গিয়ে আমরা দেখা পেলাম সেই কাক্সিক্ষত মোটরসাইকেলের চাকার দাগ। মনে এবার সাহস বাড়ল আর অসুবিধা হবে না বাগান থেকে বের হতে। কিছু দূর যেতে দেখা পেলাম জগ্ননাথ ঘেমে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসছে আমাদের দেখে ও বলল, বাবু আমার এক কাকা কে নিয়ে এসেছি। এবার আমরা যেতে পারব। আমি মনে মনে জগন্নাথকে নিয়ে কি আজেবাজে চিন্তা করছিলাম। আসলে সত্যি কথা বলতে বাগানের লোকগুলো অতি সাধারণ এবং এরা খুব সৎ। জগন্নাথ আর জগন্নাথের কাকা জগবন্ধুকে নিয়ে বিশ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম বুনো এক পরিবেশে। তেলাহাটির দক্ষিণে হিলুয়াছড়া চা বাগানের ১৪নং সেকশনের পাশে অবস্থিত হারং হুরং। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, পাহাড় আর জঙ্গল যেন আমন্ত্রণ জানালো হারং হুরং-এ। হারং হুরং-এ তিনটি সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গগুলো বেশ অন্ধকার। একদিকে সবুজ পাহাড়ী অরণ্য, আরেকদিকে সুড়ঙ্গ দেখে নস্টালজিক হয়ে গেলাম। আমরা চারজনই পালা করে সুড়ঙ্গগুলোতে ঢুকলাম, ছবি তুললাম। কিন্তু অন্ধকার আর ভয়াল পরিবেশের কারণে ভেতরে বেশিদূর গিয়ে দেখার সাহস হলো না। এর মধ্যে ডেনি ভেতরে কিসের যেন শব্দ শুনতে পেল। উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলাম ভেতরে বাদুর । মূল সুড়ঙ্গটি বালি ভর্তি হয়ে প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। থেমে থেমে টিলা চুইয়ে আসা পানির টিপ টিপ শব্দ আর বাদুরের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ নিশ্চিতভাবে কোন হরর ছবির কথা মনে করিয়ে দেবে। বড় সুড়ঙ্গটায় দাঁড়ানো যায়, তবে একটু এগুলেই মাটির দেয়াল দিয়ে বন্ধ করা। প্রচণ্ড স্যাঁতস্যাঁতে, দেয়ালে শ্যাওলা। মোবাইলের আলোয় সুড়ঙ্গের অন্ধকার ভেদ করা গেল না। বেশি ভেতরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। বিষাক্ত সাপ, পোকামাকড় থাকা খুবই স্বাভাবিক। হয়ত অনেক রহস্যও লুকিয়ে রয়েছে এখানে। তার মাঝে এক খোঁড়লের মধ্যে মোমবাতি আর আগরবাতি দেখে বুঝলাম, এখানে চা শ্রমিকরা পুজো করে। পাহাড়ী-জংলী, বন্ধুর পথে গাইড ছাড়া যে চলাফেরা করা কতটা কঠিন ও বিপজ্জনক তা টের পেলাম। আমি প্রবীণ জগবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম সুড়ঙ্গ কোন পর্যন্ত গিয়েছে? কেউ সুড়ঙ্গ পেরিয়ে দেখতে পারেনি? তিনি বললেন, সুড়ঙ্গটির বয়স প্রায় সাতশত বছর বা তারও বেশি। এটাকে কেন্দ্র করে নানা লোককাহিনী স্থানীয়দের মাঝে প্রচলিত আছে। অনেকে বলে জৈন্তা পর্যন্ত এ সুড়ঙ্গ গেছে। তিনি বললেন- যারাই এর মধ্যে প্রবেশ করেছেন তাদের কেউই নাকি জীবিত বের হয়ে আসেননি। আর যদিও বা বের হয়েছেন তারা কিছুদিনের মধ্যে অপ্রকৃতস্থ হয়ে মারা গিয়েছেন। উপস্থিত আরেকজন জানালেন ভারত থেকে বেশ অনেক বছর আগে তিনজন তান্ত্রিক এখানে প্রবেশ করেছিলেন তাদের মধ্য থেকে মাত্র একজন ফিরে এসেছেন আর খুব অল্পদিন বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিও অস্বাভাবিক ছিলেন। এছাড়াও সিলেটের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী নাকি খননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তিনি অস্বাভাবিক স্বপ্ন দেখে সংস্কারকাজ মাঝপথে বন্ধ করে দেন। আর এই গ্রামের এক বুড়ো জোয়ানকালে ঢুকেছিল। এরপর কি দেখে যেন ভয়ে বেড়িয়ে আসে। এরপর পাগল হয়ে যায়, তেলিহাটির বিখ্যাত কবিরাজও তার চিকিৎসা করতে পারেনি। এ কথা শুনে বিশ্বাস না করলেও, কিছুটা শিহরিত হলাম আমরা চারজন। কিভাবে যাবেন ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, রাজারবাগ ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রিনলাইন, শ্যামলী, এনা, হানিফ বা বিআরটিসি বাসে অথবা ট্রেনে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকালে আন্তনগর পারাবাত, দুপুরে জয়ন্তিকা ও কালনী এবং রাতে উপবন সিলেটের পথে ছোটে ভাড়া ৪০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। শহর থেকে মালনিছড়া চা বাগান ভাড়া রিক্সায় ৪০ টাকা, সিএনজি অটোরিক্সা ৮০-১০০ টাকা। সিলেটের আম্বরখানা থেকে অটোরিক্সায় সেখানে যাওয়া যায়। মালনীছড়া চা বাগানের মূল কার্যালয়ের সামনে গাইড পাবেন তাদের নিয়ে সিএনজি বা টমটমে তেলিহাটি, ভাড়া নেবে জনপ্রতি বিশ টাকা। রিজার্ভও যেতে পারেন আম্বরখানা থেকে তেলিহাটি। দুই শ’ টাকার মতো নেবে, আপডাউন চার শ’ তবে অবশ্যই গাইড নেবেন। অচেনা স্থান, তার ওপর নিরাপত্তার সমস্যা। এক শ’ থেকে দুই শ’ টাকার মধ্যেই পাবেন গাইড। সাবধানে হাঁটবেন, না হলে পিছলে পড়তে পারেন। বাইকে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল কারন বাইকে একেবারে স্পটে যাওয়া যায় আর সময় ও অনেক কম লাগে। সেক্ষেত্রে অবশ্য মালনীছড়া বাগান থেকে অনুমতি নেয়া বাঞ্ছনীয়।
×