ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বদির জেল- সরকারের দৃঢ় মনোভাবের স্পষ্ট পরিচায়ক

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৪ নভেম্বর ২০১৬

বদির জেল- সরকারের দৃঢ় মনোভাবের স্পষ্ট পরিচায়ক

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ হেন অপকর্ম নেই যা উখিয়া-টেকনাফ আসনের আওয়ামী লীগ এমপি আবদুর রহমান বদি করেননি। ব্যাপকভাবে সমালোচিত এই বদি। অপকর্মের জন্য কখনও দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। উল্টো বরাবরই করেছেন দম্ভোক্তি। তবে দেশজুড়ে এমন বদির সংখ্যা কম নয়। সম্পদের তথ্য গোপনের দায়ে দুদকের দায়েরকৃত একটি মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত আবদুর রহমান বদিকে বুধবার ৩ বছরের কারাদ-ের আদেশ ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। অনাদায়ে আরও তিনমাসের জেল দিয়েছে। বর্তমান মহাজোট সরকারের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্য এ ঘটনা একটি বড় ধরনের প্লাস পয়েন্ট। এমনিতেই বিভিন্নভাবে এ সরকার দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে একের পর এক তা বাস্তবায়ন করছে, সেক্ষেত্রে বদিদের মতো দলে থাকা কথিত রাজনীতিকের দুর্নীতির জন্য ছাড় না দেয়া অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সম্পদের তথ্য গোপনের দায়ে কক্সবাজার অঞ্চলজুড়ে নিন্দিত এই বদির শাস্তির আদেশ হয়ে জেলে গমনের ঘটনা বুধবার থেকেই দেশজুড়ে বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রামে দলমত নির্বিশেষে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেননা, একদিকে এই বদি বর্তমান সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এবং অপরদিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বিভাগে শ্রেষ্ঠ করদাতাদের অন্যতম হয়েছিলেন। অবৈধ পথে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ উপার্জন করে চালচলনে তিনি ছিলেন সাংঘাতিক দাপুটে। তার ওপর সরকারী দল করে সংসদ সদস্য অর্থাৎ দেশের আইনপ্রণেতা বনে যাওয়ার পর তার অহমিকা পর্বতসম হয়ে দাঁড়ায়। এলাকায় জোরজুলুম, মানব ও মাদক পাচার, চাঁদাবাজি, চামচাদের দিয়ে টেন্ডারবাজিসহ সকল অপকর্মের নেপথ্য নায়কে পরিণত হন এই বদি। সরকার পক্ষে তদন্ত করে পুলিশ যে রিপোর্ট দিয়েছে তাতে ইয়াবা পাচারে তিনি আছেন এক নম্বরে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে- এ নিয়ে তার কেশাগ্রও কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। সবকিছুর একটি শেষ পরিণতি আছে বলে কথা আছে। তাই হয়েছে তার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ বিধি বাম। দুদকের মামলায় সম্পদের তথ্য গোপনের দায়ে তাকে জেল-জরিমানার ঘটনাটি কক্সবাজার অঞ্চলের সর্বত্র বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। কেননা, এ অঞ্চলজুড়ে বদি ভয়ঙ্কর এক আলোচিত চরিত্র; যা চলচ্চিত্রের ভিলেনদেরও হার মানায়। স্কুল শিক্ষক, সরকারী প্রকৌশলী, নির্বাহী কর্মকর্তা, বন কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার অনেককেই তিনি মারধর করে রেকর্ড গড়েছেন। তিনি দুদকের এক সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে গালমন্দ করে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। দেশে মরণনেশা ইয়াবার বিস্তৃতির নেপথ্যের শীর্ষ কুশীলব এই বদি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আশ্রয় ও প্রশয়দাতাদেরও অন্যতম তিনি। তাকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় যত রিপোর্টই হোক না কেন, এসব নিয়ে তিনি থোরাই কেয়ার করেন। এবারই তিনি সম্ভবত টের পেলেন ‘কত ধানে কত চাল, চোরের দশদিন গৃহস্থের একদিন’। বদি হলেন দ-িত, তার বাহিনী স্তম্ভিত। এ দ-ের প্রতিবাদে তার জন্য গোটা কক্সবাজার অঞ্চলের উখিয়ার একটিমাত্র ইউনিয়নে বৃহস্পতিবার নামকাওয়াস্তে একটি হরতাল ডাকা হয় মাত্র। কি দুর্ভাগ্য বদির। দ-িত হয়ে কারাগারে গমনের ঘটনায় তার জন্য দুঃখ বা আক্ষেপ প্রকাশে এগিয়ে আসার মানুষ মিলছে না। এর মূল কারণÑতার অপকর্ম সম্পর্কে কে না জানে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল সদস্যের মুখে মুখে তার যত অপকর্মের কথা। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া যায়নি কখনও। দুদকই প্রথমবারের মতো তাকে কাঠগড়ায় নিতে সক্ষম হয়েছে। আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দ- দিয়েছে। এ জন্য কক্সবাজার অঞ্চলে বিষয়টি এক ধরনের নীরব উল্লাসে পরিণত হয়েছে। একজন শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজ, মানব ও মাদক পাচারের হোতার পক্ষে কারও সামান্যতম মনোবেদনা নেই। তার দ-াদেশ সরকারের ইমেজকে আরও একধাপ বাড়িয়েছে বলে এলাকার মানুষ মনে করছে। তাই অধিকাংশ মানুষ খুশি। পিতা মরহুম ইজাহার মিয়া ছিলেন প্রথম জিয়ার সমর্থক। পরে হন এরশাদের পৃষ্ঠপোষক। তারই যোগ্যপুত্র আবদুর রহমান বদি। তিনিও বিএনপিতে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে যান। এর পরই তার উত্থান ঘটতে থাকে। সঙ্গে বাড়তে থাকে দম্ভ। প্রসার ঘটে মাদক ও মানব পাচারের। সৃষ্টি হয় একাধিক সিন্ডিকেট। সব সিন্ডিকেটের মাসোয়ারা তার জন্য নির্ধারিত। সম্পদের তথ্য গোপনের ঘটনায় দ-িত হয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে উখিয়া, টেকনাফসহ কক্সবাজার অঞ্চলে বদিযুগের অবসান হবে কিনা তা বলা কঠিন। কেননা, ইতোমধ্যে চাউর হয়েছে জামিনে তার মুক্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর তার সংসদ সদস্য পদ খারিজ হবে বলেও আওয়াজ উঠেছে। এ বিষয়টিও হলফ করে বলা যাবে না। কারণ, এ পদ দীর্ঘ এবং বন্ধুর। এ জন্য বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্তও গড়াতে পারে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, দেশে এক বদি নিজের অপকর্মের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু দেশজুড়ে আরও বহু বদির অস্তিত্ব রয়েছে। দুদক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যেতে পারলে এসব বদির মুখোশ উন্মোচন করা কঠিন কোন ব্যাপার নয়। প্রশাসনে, রাজনীতিতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে, সামাজিক নেতৃত্বে নানা পেশা ও শ্রেণীতে বদিদের ছড়াছড়ি। আবদুর রহমান বদি যেমন একদিনে অপকর্মের শীর্ষে পৌঁছেননি তেমনি দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা বদিরাও অনুরূপ। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অবৈধ পথে অর্জিত আয়ের অর্থে এ জাতীয় বদিরাই দেশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে আছে। এরা টাকার গরমে অন্যদের নরম করে ফেলে। আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সৎ মানুষদের পথে নাজেহাল করে। প্রয়োজন হলে গুমও করে ফেলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর কিছুসংখ্যক অসৎ কর্মকর্তাকে রীতিমতো কিনে ফেলে যা ইচ্ছা তা করে, যেমন খুশি তেমন সাজে। এসব বদি এখনও সুদিনে। উখিয়া- টেকনাফের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির মতো এদের কখন আইনের আওতায় এনে জব্দ করা যাবে তা-ই দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ।
×