ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শীর্ষ ১০০ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক তালিকায় ঠাঁই হয়নি একটিরও

বাংলাদেশের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৪ নভেম্বর ২০১৬

বাংলাদেশের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক

আনোয়ার রোজেন ॥ উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণে প্রভাব নেই দেশের স্বীকৃত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তাদের গবেষণার ভূমিকা কম। গবেষণার গুণগত মান ও প্রভাবের দিক থেকে আন্তর্জাতিকভাবেও এসব প্রতিষ্ঠান পিছিয়ে। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে শীর্ষ ১০০ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোন সরকারী-বেসরকারী গবেষণা সংস্থার নাম। যদিও গুণগত মান বিচারে একই ক্যাটাগরিতে ভারত ও পাকিস্তানের একাধিক গবেষণা সংস্থা তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের থিংক ট্যাংক এ্যান্ড সিভিল সোসাইটিস প্রোগ্রামস (টিটিসিএসপি) প্রতিবছর বিশ্বের গবেষণা সংস্থাগুলোর একটি তালিকা করে। তাতে ২০১৫ সালে প্রায় সব ক্যাটাগরিতেই অবস্থান হারিয়েছে সরকারের একমাত্র বিশেষায়িত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। গবেষণার মান, প্রতিবেদন প্রকাশ ও সঠিক নেতৃত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে অবনমন হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। একই চিত্র বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেলায়ও। বৈশ্বিক তালিকায় ঠাঁই হয়নি বাংলাদেশের কোন বেসরকারী গবেষণা সংস্থার। ২০১৪ সালে বিশ্বের আট হাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০০-এর ভেতরে জায়গা করে নিয়েছিল সরকারী অর্থায়নে পরিচালিত সংস্থা বিআইডিএস। কিন্তু ২০১৫ সালে অবনমন হয়েছে পাঁচ ধাপ। বিশ্বসেরা সাত হাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিআইডিএসের স্থান এখন ১০২তম। আগের বছর এ অবস্থান ছিল ৯৭তম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য যথাযথ গবেষণা ও নীতি সহায়তার প্রয়োজন হয়। উন্নত দেশগুলোতে এ জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক উন্নয়ন ও নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের প্রভাবও রয়েছে। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও নীতি নির্ধারণে প্রভাব- উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখনও বেশ পিছিয়ে। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ লক্ষ্য অর্জনে ‘থিংক ট্যাংক’ ও নীতি নির্ধারকদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। বিশ্বের সেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান নিরূপণ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টিটিসিএসপি কর্তৃপক্ষ। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, সেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তালিকা করতে গিয়ে কতগুলো মানদ- ঠিক করা হয়। এগুলো হলো- সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ওই বছর মানসম্পন্ন গবেষণা তৈরি হয়েছে কি না, গবেষণার বৈচিত্র্য কেমন, কত সংখ্যক জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে, নেত্বত্ব সঠিক পথে আছে কি না, প্রতিষ্ঠানের গবেষণার কাজে গুণগত মান এবং ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সক্রিয়তা ও গবেষকদের খ্যাতি ইত্যাদি বিষয় দেখা হয়। একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদন ওই দেশের নীতিনির্ধারকরা কতটুকু গ্রহণ করেন, অর্থাৎ সরকারের নীতি নির্ধারণে প্রভাব রাখতে পারে কি না সেটিও বিবেচনায় নেয়া হয়। দেশটির আর্থ-সামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের গবেষণার ভূমিকা কতটুকু, গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে কি না কিংবা ওই প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে সচ্ছল কি না সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়নের সময় এসব বিষয়ও দেখা হয়। টিটিসিএসপি ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ চালিয়ে একটি তালিকা করে আসছে। এ নিয়ে নবমবারের মতো থিংক ট্যাংক সূচক প্রকাশ করল প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সব গবেষণা সংস্থার মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে যুক্তরাজ্যের চেথাম হাউস ও যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিকসহ বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে এই তালিকা করে টিটিসিএসপি। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্য দেশগুলোর গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওপর করা জরিপেও বিআইডিএস তাদের অবস্থান হারিয়েছে। এ ক্যাটাগরিতে সর্বশেষ তালিকায় প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান ১১৯তম। আগের বছর ছিল ৯৯তম। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ২০ ধাপ নিচে নেমে গেছে বিআইডিএস। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন দেশগুলোর ক্যাটাগরিতে বিআইডিএস এক ধাপ এগিয়েছে। আগের বছর প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান ছিল ১৭তম। ২০১৫ সালে অবস্থান হয়েছে ১৬তম। ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ক্যাটাগরির বাইরে রাখা হয়েছে। পাকিস্তানের সাসটেইনবল ডেভেলপমেন্ট পলিসি ইনস্টিটিউট এ তালিকায় আছে ১৫ নম্বরে। এক বছরের ব্যবধানে বিআইডিএস কেন তাদের অবস্থান হারাল এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) কে এ এস মুরশিদ জনকণ্ঠকে বলেন, তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবারই টিটিসিএসপি নতুন কিছু কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে থাকে। এ কারণে বিআইডিএসের অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। তার মানে এই নয় যে সংস্থাটির কাজের মান খারাপ হয়েছে। আমি বলব বরং আগের চেয়ে ভাল হয়েছে। টিটিসিএসপি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আমার আলাপে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের গবেষণা সংস্থা হিসেবে বিআইডিএসকেই তারা বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ২০১৪ সালে বিআইডিএসের মহাপরিচালক ছিলেন ড. মোস্তফাকে মুজেরি। তার সময়েই প্রতিষ্ঠানটি শীর্ষ ১০০-এর মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল। তিনি বর্তমানে বেসরকারী ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। সর্বশেষ তালিকায় প্রতিষ্ঠানটির অবনমনের বিষয়ে মোস্তফা কে মুজেরি জনকণ্ঠকে বলেন, আমি দুটি কারণকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। প্রথমত, গত বছর অন্যান্য প্রতিষ্ঠান আমাদের চেয়ে ভাল করেছে, সে জন্য তারা এগিয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, বিআইডিএস আগের বছর যে পারফরম্যান্স করেছে, গত বছর সেটা করতে পারেনি। তবে আমাদের হারানো স্থান ফিরে পাওয়া শুধু নয়, আরও এগিয়ে যেতে হবে। সে জন্য কাজের গতিও বাড়াতে হবে। গবেষণার কাজে বিআইডিএস কেন খারাপ করেছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ও সাবেক একাধিক গবেষক জানিয়েছেন, সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিআইডিএসকে সেভাবে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দেন না। অথচ প্রতিষ্ঠানটিতে অনেক দক্ষ ও যোগ্য গবেষক আছেন। কিন্তু তাঁদের কাজে লাগানো হয় না। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ বলেন, আমাদের দেশে রাজনীতিবিদরাই মূলত উন্নয়ন কর্মকা-ে নীতি নির্ধারণ করে থাকেন। বিআইডিএস এক্ষেত্রে ভাল-মন্দ বিবেচনায় সহযোগিতা করে থাকে। এটা আমাদের বাস্তবতা। তবে গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। একই প্রসঙ্গে মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, গুরুত্ব আসলে আদায় করে নিতে হয়। আমাদের এখানে নীতি নির্ধারক ও থিংক ট্যাংকের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কম। তবে দূরত্ব কমানোর দায়িত্ব গবেষকদেরই। কারণ, জনগণের সঙ্গে নীতি নির্ধারকদের যোগাযোগটা বেশি। তাই থিংক ট্যাংকগুলোর জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। নীতি নির্ধারকদের চাহিদা বুঝতে হবে। থিংক ট্যাংকের নিজেদের মধ্যে সমন্বয়টাও জরুরী। গবেষণার ক্ষেত্রে রিপিটেশন যেন না হয়। গবেষণার বাস্তব উপযোগিতাও থাকতে হবে। প্রয়োগযোগ্য হতে হবে। দেশের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন রূপকল্পের আলোকে লক্ষ্যমাত্রা ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করে থাকে পরিকল্পনা কমিশন। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নেয়ার লক্ষ্য ইতোমধ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশের পর্যাপ্ত গবেষণা প্রস্তুতি রয়েছে বলে মনে করেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, উন্নত দেশ হওয়ার পথে আমাদের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্তমানে উন্নত এমন দেশগুলোর গবেষণা আমরা কাজে লাগাতে পারছি। এজন্য আমাদের বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে না। এটা একটা ইতিবাচক দিক। আবার অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের নিজস্ব গবেষণাও আছে। টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও দীর্ঘমেয়াদী হবে এমন সার্টিফিকেট পাওয়ার পরই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাস্তবায়নের পরের মূল্যায়নকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আগে গবেষণার জন্য বাজেটে বরাদ্দ কম থাকত। বর্তমান সরকার এ খাতে ক্রমান্বয়ে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। অর্থাৎ আমরা সঠিক পথেই এগুচ্ছি। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ॥ সরকারী প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস বাদে বাংলাদেশের ৩৪টি বেসরকারী গবেষণা সংস্থা টিটিসিএসপি’র এ জরিপে অংশ নিয়েছে। তবে শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক তালিকায় বিআইডিএস ছাড়া আর কারও জায়গা হয়নি। ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক ক্যাটাগরিতে ৯৫টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বিআইআইএসএসের (বাংলাদেশের ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ) অবস্থান ২০তম। এছাড়া অলটারনেটিভ ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ বা এডিআই ৪৮তম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ৫০তম, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট ৫২তম এবং ইনস্টিটিউট অব গবর্ন্যান্স স্টাডিজ ৫৩তম স্থানে রয়েছে। আঞ্চলিক তালিকায় অবস্থান বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন তালিকার বিষয়টি আমাদের জানা নেই। ২০০৭ সালের দিকে আমরা এই জরিপে অংশ নিয়েছিলাম। তখন আমাদের অবস্থান বেশ ভাল ছিল। বিশ্বের শীর্ষ ২৫০ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আমরা ছিলাম।
×