ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিআইবিএমে ‘ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অপরাধ’ শীর্ষক কর্মশালায় বক্তারা;###;ভাগাভাগি করে ঋণ নিচ্ছেন ব্যাংকের পরিচালকরা;###;দুই-তৃতীয়াংশ ব্যাংকে আর্থিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে;###;আর্থিক অপরাধগুলোর মধ্যে ৬৫ শতাংশই হচ্ছে চেক জালিয়াতি

৯০ শতাংশ অপরাধে ব্যাংকের নিজের লোক জড়িত

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ৪ নভেম্বর ২০১৬

৯০ শতাংশ অপরাধে ব্যাংকের নিজের লোক জড়িত

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যাংকে আর্থিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকের গোষ্ঠীগত চক্র, পরিচালনা পর্ষদ, গ্রাহক, অপরাধী চক্র, আইনী দুর্বলতা, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার দুর্বলতা এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কারণে এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ব্যাকিং খাতে আর্থিক অপরাধগুলোর মধ্যে ৬৫ শতাংশই হচ্ছে চেক জালিয়াতি সংক্রান্ত। বৃহস্পতিবার বিআইবিএমে ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অপরাধ’ শীর্ষক এক কর্মশালার মূল প্রবন্ধে এসব তথ্য উঠে আসে। কর্মশালায় বক্তারা বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে সংঘটিত ৯০ শতাংশ অপরাধে নিজেদের লোক জড়িত। বিশেষ করে পরিচালকদের হাত থাকে বেশি। বর্তমানে ব্যাংকের পরিচালকরা একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ঋণ নিচ্ছেন। তারা আরও বলেন, ব্যাংকের এমডিরা আগে স্বাধীন ছিলেন। বর্তমানে তা দেখা যাচ্ছে না। কর্মশালায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অপরাধ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। কর্মশালাটি আয়োজন করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহাঃ রাজী হাসান। এ সময় ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি এসএ চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসিন আলী, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হেলাল আহমেদ চৌধুরী ও সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) ফারুক মইনুদ্দিনসহ বিভিন্ন ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কর্মশালায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অপরাধ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। গবেষণাটি তৈরি করেছেন বিআইবিএমের অধ্যাপকও পরিচালক ড. শাহ মোঃ আহসান হাবিব। তাকে সহযোগিতা করেছেনÑ বিআইবিএম সদস্য এসকে নাজিবুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক নেহাল আহমেদ, সহকারী অধ্যাপক অতুল চন্দ্র প-িত, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) জুলকার নাইন ও বিএফআইইউর যুগ্মপরিচালক কামাল হোসেন। কর্মশালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, দীর্ঘদিন এক পদে থাকলে সেখানে অপরাধের প্রবণতা বাড়ে। মনে রাখতে হবে, ব্যাংকের ৯০ শতাংশ টাকা আমানতকারীদের। তাদের আমানতের নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। ব্যাংক খাতে অপরাধ যেহেতু বেড়েছে তাই প্রত্যেক ব্যাংকে একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী গঠন করতে হবে। এদের কাজ হবে, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগে পূর্বাভাস দেয়া। এদের পরিচয় সবাই জানার দরকার নেই। বর্ণচোরা হয়ে কাজ করবে। গত ৩০ অক্টোবর ব্যাংকের পরিচালক পদে আজীবন থাকার দাবি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) নেতারা। ওই বৈঠকে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। এভাবে পরিচালকদের অযৌক্তিক দাবির সঙ্গে আগে কখনও এমডিরা একাত্মতা প্রকাশ করেনি বলে জানান বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এতে ব্যাংকের এমডিরা পরিচালকদের লেজুরবৃত্তি হওয়ার নতুন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশ্বের কয়েকটি বড় ব্যাংকও এ ধরনের কর্মকা-ে জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত দেউলিয়া হয়েছে। বিদ্যমান ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী, ব্যাংকের পরিচালকরা টানা দুই মেয়াদ (৬ বছর) পরিচালক থাকতে পারেন। মাঝখানে বিরতি দিয়ে পরে আবার তারা পরিচালক পদে আসতে পারেন। কিন্তু বিএবি ও এবিবির দাবি, উদ্যোক্তারা আজীবনই ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকেন, ছয় বছর পরে কেন বিদায় নেবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহাঃ রাজী হাসান বলেন, অর্থনৈতিক ও আর্থিক অপরাধ এখন বৈশ্বিক সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবিলা করে আমাদের এগোতে হচ্ছে। বিশেষ করে মানি লন্ডারিংয়ের প্রবণতা বেড়েছে। কর্মশালায় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএ চৌধুরী বলেন, পরিচালকরা বর্তমানে ভাগাভাগি করে ঋণ নিয়ে যাচ্ছেন। বলেÑ তুমি আমার ব্যাংক থেকে নাও, আমি তোমার ব্যাংক থেকে নেব। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিনের খেলাপী হওয়া অর্থ ফেরত পেতে মামলা করে। কোর্ট থেকে সে মামলার স্থগিতাদেশ নিয়ে আবার ঋণ নিচ্ছে খেলাপীরা। এ ধরনের ঋণ নেয়া বাংলাদেশ ব্যাংককে সার্কুলার করে বন্ধ করতে হবে। আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট কোন ব্যাংকে নেই। এটা গঠন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে ৪১ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ আদায় হয়েছে। বাকি টাকার হদিস নেই। এ টাকা আদায়ের কোন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসিন আলী বলেন, ব্যাংকে কিছু ব্যক্তি সব সময় অনিয়ম-দুর্নীতি করে। এতে সে নিজে ও অন্যকে বিপদে ফেলে। উর্ধতন কর্মকর্তা সৎ না হলে অপরাধ দমন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ব্যাংকের ৯০ শতাংশ অপরাধে নিজেদের লোক জড়িত। তিনি বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপীরা যদি আর্থিক অপরাধী না হয় তাহলে কোনটিকে আর্থিক অপরাধ বলব? আসলে প্রত্যেকে নিজের অবস্থান নিয়ে চিন্তিত। চাকরি চলে যাওয়ার ভয়। সে কারণে অনেক সময় জেনেও জানে না, বুঝেও বুঝে না। ব্যাংক খাতে সৎ লোক দরকার। কিন্তু চাকরি দেয়ার সময় সৎ-অসৎ খোঁজার কি কোন ব্যবস্থা আছে? সিটি ব্যাংকের এএমডি ফারুক মইনুদ্দিন বলেন, ব্যাংক খাতে ইচ্ছাকৃত খেলাপীদের চিহ্নিত করা হোক। এদের অনেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশ সফরে যেতে দেখা যায়। এছাড়া ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও এ্যাকাউন্ট খোলায় বিশেষ নজর দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। কারণ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভুয়া এ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। উপস্থিত কিছু ব্যাংকার বেশ কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেন। ফিরোজ আলম নামের একজন ব্যাংকার বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অপরাধীদের তালিকা চাই। এছাড়া অযৌক্তিক মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। আরও কয়েকজন বলেন, চেক প্রতারণায় জগাখিচুড়ি অবস্থা চলছে। কেওয়াইসির শর্ত পরিপালন করা হচ্ছে না। অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।
×