ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

কর্মচঞ্চল ‘এনবিআর’ ॥ করমেলা উৎসবে পরিণত

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৪ নভেম্বর ২০১৬

কর্মচঞ্চল ‘এনবিআর’ ॥ করমেলা উৎসবে পরিণত

করদাতার সংখ্যা দ্বিগুণ হবে- এই মর্মে অর্থমন্ত্রীর আশাবাদের একটি প্রধান খবর দিয়েছে দৈনিক জনকণ্ঠ। উপলক্ষ আয়কর মেলা-২০১৬ যা শুরু হয়েছে পহেলা নবেম্বর থেকে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এই মেলার উদ্বোধন করেন ঢাকায়। ‘সুখী স্বদেশ গড়তে ভাই, আয়করের বিকল্প নাই’- এই স্লোগান নিয়ে সারাদেশে আয়কর মেলার আয়োজন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এনবিআর বরাবরই তা করে, তবে এবারের আয়োজন আর সব বারকে ছাড়িয়ে গেছে। মেলা বস্তুত উৎসবে পরিণত হয়েছে বলে মিডিয়া খবর দিচ্ছে। হাজার হাজার লোক মেলায় যাচ্ছে- কর কীভাবে দিতে হয়, কীভাবে করদায় হিসাব করতে হয় ইত্যাদি সম্পর্কে সবাই খবর নিচ্ছে। অনেকে মেলায় বসেই আয়কর রিটার্ন জমা দিচ্ছে বলে টেলিভিশনের খবরে দেখলাম। এই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে আয়কর সম্পর্কে এবং আয়কর বিভাগ সম্পর্কে মানুষের ভয়ভীতি কাটছে। এটা বড়ই আনন্দের খবর, সুখের খবর। ধারণা করি, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেখেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, করদাতা দ্বিগুণ হবে। বর্তমানে ১৩ লাখ করদাতা আছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে এই সংখ্যা ২৫ লাখে উন্নীত হবে বলে অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নতুন তিন লাখ করদাতা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা। ইতোমধ্যেই সেই সংখ্যায় করদাতা পাওয়া গেছে। বছরের আরও ৮ মাস বাকি, অতএব আশা করা যায় করদাতার সংখ্যা আরও বাড়বে। এই মুহূর্তে চলমান যে মেলা তাতে যে সাড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা মেলার শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ আগামী সাত দিন অব্যাহত থাকলে করদাতার সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি প্রদত্ত আয়করের পরিমাণও বিপুলভাবে বাড়বে বলে আশা করা যায়। অর্থমন্ত্রী এই ধারা আজ ধারণ করেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটের আকার হবে ৫ লাখ কোটি টাকা। অবশ্যই তা হতে হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) হতে হবে আরও গতিশীল, সৃজনশীল ও কুশলী। বর্তমান চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান মেলা আয়োজন এবং এর সঙ্গে যে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন তা দেখে আশা করা যায় ‘এনবিআর’ আগামী দিনে সরকারের বিশ্বস্ত বিভাগ হবে। আর এটি হলে রাজস্বের অভাবে সরকারকে এলোপাতাড়ি ‘শূটিং’ করতে হবে না। এই উপলক্ষে আমি রাজস্ব বোর্ডের বর্তমান উদ্যোগকে স্বাগত জানাই এবং কিছু সুপারিশ রাখতে চাই। প্রথমেই এনবিআরের বর্তমান চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ দিতে চাই একটি বহু প্রতীক্ষিত পদক্ষেপের জন্য। কথা ছিল সঞ্চয়পত্রে প্রাপ্ত সুদ আয়ের ওপর যে কর উৎসে কাটা হয় তাকে ‘চূড়ান্ত দায়মুক্তি’ হিসেবে গণ্য করা যায়। এর আগে বহুদিন সঞ্চয়পত্রের প্রাপ্ত সুদে কোন আয়কর ছিল না। পরে সেই সুদকে করের আওতায় আনা হয়। তার ওপর যথাযোগ্য হারে কর দিতে হতো। গতবার থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদ আয়করের মধ্যে রাখা হয়। তবে উৎসে কর কাটার পরে চূড়ান্ত হিসাবে আর নিয়মিত কর হার প্রযোজ্য করা হয়নি। এই পদক্ষেপে মধ্যবিত্ত কিছুটা উপকৃত হবে। এই পদক্ষেপের জন্য এনবিআরকে ধন্যবাদ, তবে সঞ্চয়পত্রের ওপর আরও কিছু পদক্ষেপের প্রয়োজন আছে তা বারান্তরে আলোচনা করব। আজকে কয়েকটি ভিন্ন কথা বলতে চাই। সব সময়ই বলা হয়, আমাদের করদাতার সংখ্যা কম ইত্যাদি ইত্যাদি। দৃশ্যত কথা ঠিকই কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে ‘ওয়েজ আর্নাররা’ করমুক্ত। সেখানে লাখ লাখ লোক আছেন। এক অর্থে তারাও করদাতা, শুধু রিটার্ন জমা দেয় না! অবশ্য এরা বাদে দেশে প্রচুর লোক আছে যারা করদাতা হওয়ার ‘মহাযোগ্য’। কিন্তু তারা করও দেয় না রিটার্নও জমা দেয় না। দেশে দুই-তিন লাখ প্রাইভেট কোম্পানি আছে কাগজের খবরে দেখি তাদের পঞ্চাশ শতাংশও রিটার্ন জমা দেয় না। অথচ এরা চুটিয়ে ব্যবসা করছে। আরও খবর দেখি দেশের কয়েক হাজার পোশাক ব্যবসার মালিকদের বিরাট অংশ রিটার্ন জমা দেয় না। এর কোন কারণ বোঝা দায়। দেশে পার্টনারশিপ ও একক মালিকানাধীন ব্যবসার সংখ্যা কত? লাখ লাখ। এক ঢাকাতেই হবে কয়েক লাখ। আজকাল প্রত্যেক উপজেলাতেই গড়ে উঠেছে শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অনেক উপজেলা শহরে বেশ কয়েকটি করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সোনার দোকান আছে। তাদের কয়জন আয়কর দেয় সেই সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। সংবাদকর্মী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারী, পেশাজীবী, শিক্ষক প্রাইভেট টিউটর ইত্যাদি শ্রেণীর হাজার হাজার লোক আছে যাদের কয়জন করের আওতায় আছে তা বলা মুশকিল। ধানম-ি, মোহাম্মদপুর, গুলশান, বনানী, উত্তরা, শান্তিনগর, কাপ্তানবাজার ইত্যাদি নামীয় বাজারে বহু মুদিদোকান, মাছের দোকান, মাংসের দোকান আছে যাদের বাৎসরিক আয় করমুক্ত আয়সীমার অনেক অনেক পরে। তাদের অনেকে বেশ ধনাঢ্য, ঢাকা শহরে জমিজমা, বাড়িঘর ও ফ্ল্যাট আছে। এদের কয়জন করের আওতায়? এভাবে দেখলে মনেই হয় করের আওতায় আসতে পারে আরও কয়েক লাখ লোক। এনবিআর তার সীমিত জনবলে রাজনৈতিক পৃষ্ঠাপোষকতার অভাবে এসব ক্ষেত্রে করদাতার সন্ধানে নামতে পারছে না বলে মনে হয়। সীমাবদ্ধতার মধ্যেই তারা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। এটা ভাল খবর। নানা সীমাবদ্ধতা ও কারণে দেখা যাচ্ছে সম্ভাব্য বড় বড় করদাতা কম কর দিচ্ছে, অথবা করই দিচ্ছে না। এবার যে শ্রেষ্ঠ করদাতাদের নাম কাগজে ছাপা হয়েছে তাতে দেশের নামকরা ও প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ীদের নাম কোথায়? যাদের নাম কাগজে ছাপা হয়েছে তাদের অধিকাংশই অখ্যাত ব্যক্তি। এটা কেমন কথা যারা সম্পদ কর দেয় তাদের মধ্যে অনেক সাধারণ করদাতাও আছে যারা ফিন্যান্সিয়াল এ্যাসেট দেখিয়ে এখন ধনাঢ্য ব্যক্তি এনবিআরের খাতায়। অথচ প্রকৃত ধনাঢ্যরা সম্পদ কর দেয় না। বিদেশী বহু কোম্পানি কর ফাঁকি দিচ্ছে, কর দিচ্ছে না, মামলা করে কর পরিশোধের দায়িত্ব আটকে রাখছে এসব খবর প্রতিদিন কাগজে দেখছি। ‘এনবিআর’ লড়ছে, কিন্তু আইনী ব্যবস্থা এমনি যে, সেখানে সফলতা আনা বড়ই কঠিন। উপরোক্ত সীমাবদ্ধতার মধ্যে দেখা যাচ্ছে করের বোঝা বাড়ছে সাধারণ করদাতার। সরকারের চাপ রয়েছে এনবিআরের ওপর। এনবিআর যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে যেতে পারছে না অথবা পাচ্ছে না। অথচ তাকে রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে। বিশাল টার্গেট। সম্ভবত এসব কারণে দেখা যায় তারা এগোচ্ছে উৎসে কর কাটার ব্যবস্থায়। উৎসে কর কাটার ব্যবস্থা ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। সবাইকে সমান হারে কর দিতে হয়। মেয়াদী আমানতের সুদে যে হারে উৎসে কর কাটা হয় তা বড়-ছোট সবার জন্যই প্রযোজ্য। এটা করনীতিবিরুদ্ধ বলেই জানি। অথচ উৎসে কর কাটার আওতা দিন দিন বাড়ছে। এতে অবশ্য সরকারের কাজ সহজতর হয়। কর আদায় সহজতর হয়। ঝামেলা কম, লোকবল কম লাগে, হিসাবপত্রের ঝামেলা কম। দ্বিতীয়ত. ‘ভ্যাট’। ভ্যাট কিন্তু এক অর্থে ‘ভোগকর’ (কনজামশন ট্যাক্স)। সরকার এদিকেই বেশি নজর দিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। ভ্যাট এখন প্রায় সর্বত্র। প্রতিদিনই এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে। কষছে ব্যবসায়ীরা। তাদের কথা এটা তাদের উপর জুলুম। তারা ভোক্তাদের স্বার্থের কথা বলছেন না। ভোক্তারা যে প্রতিস্তরে ভ্যাট দিচ্ছে এ কথা কেউ বলে না। ‘ভ্যালু যেখানে এ্যাড’ হয় না সেখানেও ‘ভ্যালু এ্যাডেড ট্যাক্স’ আরোপিত হচ্ছে। ‘ভ্যাট’ বস্তুত সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে। কিন্তু এটি পরোক্ষ কর। পরোক্ষ করের ব্যবস্থাও ধনী-দরিদ্র-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এক কেজি চিনি কিনলে যে ট্যাক্স দিতে হয় তা ধনীও দেয়, গরিবও দেয়। মীনা বাজার থেকে মাল কিনলে মধ্যবিত্ত যে ভ্যাট দেয়, ধনীও তাই দেয়। ‘ভ্যাট’ ব্যবস্থা বৈষম্য তৈরি করে। আগেই দেখেছি ‘উৎসে কর কাটার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য’ আয়গুলোর মধ্যে বিপুলসংখ্যক আয়ের মালিক নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, ধনী নির্বিশেষে সমস্ত লোকজন। অথচ করের হার এক। এতেও বৈষম্য সৃষ্টি হয়। বলা হয়েছে সম্পদ করেও বেঁচে যাচ্ছে বড় বড় সম্পদ, বাড়ি-ঘরের মালিকরা। এভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সরকারের রাজস্বের সিংহভাগ জোগাচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। যাদের কর দেয়া ‘ফরজ’ তারা কর দেয় না, তারা সরকারের কাছ থেকে বরং সুবিধা নেয়। আমি মনে করি আগামী দিনে শুধু রাজস্ব বাড়ানোর দিকে নজর দিলে হবে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে শুধু রাজস্বের টার্গেট দিয়ে চাপ দিলে হবে না। কারণ, টার্গেটভিত্তিক ব্যবস্থা পরিণামে বিপর্যয় ডেকে আনে। ব্যাংকিং-এ তার নজির আছে। ‘টার্গেটভিত্তিক এ্যাগ্রেসিভ ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং’ ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। ব্যাংক রক্ষা তাদের ব্রাঞ্চের মুনাফার টার্গেট পরিপূরণ করতে গিয়ে যাকে তাকে ঋণ দিয়েছে। স্বল্প মেয়াদে মুনাফার টার্গেট পুরিত হয়েছে। কিন্তু পরিণামে বেড়েছে খেলাপী ঋণ। সরকারের টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে ‘এনবিআর’ পথ না পেয়ে ছোট ছোট কাজ করছে। যেমন ‘বিনিয়োগ এলাউন্স’ কমাচ্ছে, কর রেয়াতের পরিমাণ কমাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে এনবিআর সৃজনশীলতা দেখাতে পারেনি যদিও অনেক ক্ষেত্রে তারা এর স্বাক্ষর রেখেছে। কাজেই শুধু ‘হেভি টার্গেট’ নয়, নৈতিক দিকও দেখতে হবে। যারা প্রকৃতপক্ষে করের যোগ্য তাদের করের আওতায় আনুন। ধনী-দরিদ্র সবাইকে একই হারে কর দিতে বাধ্য করা উচিত নয়। করের ক্ষেত্রে ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এনবিআর ও সরকার যদি আগামী দিনে এ বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেয় তাহলে তাদের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে, নেতৃত্ব প্রশংসা পাবে। মনে রাখতে হবে মধ্যবিত্তই বাজারে যায়- যে বাজার ‘বাজার অর্থনীতি’র কেন্দ্রবিন্দু বা স্তম্ভ। সেই মধ্যবিত্তের ‘ডিসপোজেবল ইনকাম’ ঠিক রাখতে হবে এবং পারলে বাড়াতে হবে যাতে ‘ভোগ স্তর’ ঠিক থাকে। ইতোমধ্যে তাদের অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের সুদ আয় বিপুলভাবে হ্রাস পেয়েছে। তা মানুষের ভোগে প্রভাব রাখবে। গেল বছর বেতন বাড়িয়ে ভোগস্তরে ‘স্রোত’ আনা হয়েছে। প্রত্যেক বছর তা হবে না, এবারও তা হবে না। ওয়েজ আর্নারভিত্তিক রেমিটেন্স আগের মতো বাড়ছে না। এমতাবস্থায় করদাতাদের আয় যাতে অধিকতর করের বোঝার কারণে হ্রাস না পায় তা সরকারকে মনে রাখতে হবে। ‘এনবিআর’-এর বর্তমান কর্মচঞ্চল নেতৃত্ব আগামী দিনে আরও সৃজনশীল হবে এবং করদাতাবান্ধব হবে এটা দেশবাসীর প্রত্যাশা। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×