ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাম্প্রদায়িক হামলা

নাসিরনগরের ওসি প্রত্যাহার

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৩ নভেম্বর ২০১৬

নাসিরনগরের ওসি প্রত্যাহার

রিয়াজউদ্দিন জামি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ॥ কেন নাসিরনগরে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল? সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই কি পরিকল্পিতভাবে সে দিন তা-ব চালানো হয়েছিল? কেন নীরব ছিল সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা। এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। বুধবার নাসিরনগর ডাক বাংলোতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে খোদ স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এ্যাডভোকেট মোঃ ছায়েদুল হকের বক্তব্যে এমন আভাসই মিলেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ক্ষমতাসীন দলের উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্বপালনে শৈথিল্যতা সে দিনের ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। অন্যদিকে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগাম সতর্ক বার্তাতে হামলা পূর্ববর্তী পরিস্থিতি ও সতর্কতা সম্পর্কে আভাস না দেয়ায় রবিবারের চরম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা মনে করেন। ঘটনার আকস্মিক ভয়াবহতায় অসহায় হয়ে পড়ে স্থানীয় প্রশাসন। তবে জেলার পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ কেন অশান্তিপূর্ণ হলো তা নিয়ে কর্মকর্তারাও হতচকিত হয়ে পড়েন। তবে ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনে স্থানীয় পুলিশ এবং প্রশাসনের কোন অবহেলার কথা মানতে নারাজ কর্মকর্তারা। একটি সূত্র জানায়, সে দিন যদি কোন অবহেলা থেকে থাকে সে জন্যেই তো পৃথক ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারাই প্রকৃত ঘটনার কারণ খুঁজে বের করবে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, পবিত্র কাবা শরীফ বিষয়ক ঘটনাটি নজরে আসে ২৮ অক্টোবর সকাল ৯টায়। উপজেলার হরিণবেড় গ্রামের রসরাজ দাস (৩০)-এর আইডি থেকে পোস্ট করা হয়। মুহূর্তের মধ্যেই ছবিতে লাইক ও শেয়ার দেয় বেশ কিছু লোক। দ্রুত খবরটি চাউর হয় সবখানে। তাৎক্ষণিকভাবে হরিণবেড় গ্রামের কিছু লোক রসরাজকে খুঁজতে তার বাড়িতে যায়। তখন সে বাড়িতে ছিল না। পরে তাকে ধরে আনা হয়। আটক রাখা হয় ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে। এদিনই পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। বিকেলে মিছিল হয়। রাস্তায় টায়ারে আগুন দেয়া হয়। রাতে সংবাদ আসে পরদিন রবিবার বিক্ষোভ মিছিল হবে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মামলা ও আসামি ধরা পড়ায় প্রতিবাদ করার কিছুই নেই। তারপরও গ্রামে গ্রামে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন বিক্ষোভের সমর্থনে উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে মাইকিং করা হয়। পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, মূলত পবিত্র কাবা শরীফকে নিয়ে ব্যঙ্গ করায় প্রবল ক্ষোভ সৃষ্টি হয় সাধারণ মানুষের মাঝে। প্রচ- প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এমন মেসেজ আমরা পাই। প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে পুলিশের পক্ষ থেকে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। এরমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুমতি নিয়ে সকাল সাড়ে ১০টায় কলেজ মোড় ও আশুতোষ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সমাবেশ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সকালে সেখানে ১ প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনাও বাড়তে থাকে। সে সঙ্গে বাড়ে লোক সমাগম। পরে আরও এক প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ডাকা হয় র‌্যাব, বিজিবি এবং অতিরিক্ত পুলিশ। উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত নেতৃবৃন্দ, পুলিশ কর্মকর্তা প্রশাসনের কর্তাসহ অনেকেই বক্তব্য রাখেন দুটি সমাবেশে। পুলিশের দাবি তারা সমাবেশস্থল ঘিরে রাখে। দুপুর প্রায় ১২টায় খবর আসে বেশ কিছু যুবক হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসা বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশের ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন প্রায় পৌনে ১ ঘণ্টার মধ্যেই নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি করে দুর্বৃত্তরা। এ ফাঁকেই কর্মকর্তাসহ পুুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। সংখ্যালঘুদের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে গ্রামে গ্রামে পেট্রোল চালু করে (টহল)। বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আহাদ বলেন, আমরা প্রশাসনের তেমন সহযোগিতা পাইনি। নিজেরা লাঠি নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছি। তিনি আরও বলেন, সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে গিয়ে যারা আহত হয়েছেন তাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। ইউপি চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি বলেন, স্থানীয় মন্ত্রীর আশির্বাদে যারা রাজনীতি করছে তারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের সংসদ সদস্য ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এ্যাডভোকেট সায়েদুল হক বলেছেন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সকলকে নিয়ে আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছি। তবে কিভাবে কারা ছবি পোস্ট করেছে এসব বের করে এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর এবং মন্দিরে হামলাকারীদের খুঁজে বের করা হবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ঘটনার পর দিন জনকণ্ঠকে বলেন, আমি এ ঘটনায় মর্মাহত। যারা অপরাধী তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা এবং উস্কানিই এর জন্য দায়ী। ওসি প্রত্যাহার ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সৃষ্ট ঘটনায় থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদেরকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে তাকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন ওসির প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, প্রশাসনিক কারণে ওসি আবদুল কাদেরকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ॥ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পবিত্র কাবা শরীফ অবমাননার করে আপত্তিকর ছবি পোস্ট করার প্রতিবাদে মিছিল চলাকালে নাসিরনগর উপজেলা সদরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি ঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামালের নেতৃত্বে নাগরিক কমিটি ড. এনামুল হক চৌধুরী নেতৃত্বে মানবাধিকার কমিশন ও ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাস গুপ্তের নেতৃত্বে হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধি দল পৃথক পৃথক ভাবে হরিপুরসহ নাসিরনগর গৌর মন্দির, দত্তবাড়ি মন্দির, কালীবাড়ি মন্দির, জগন্নাথ মন্দিরসহ বিভিন্ন বাড়িঘর পরিদর্শন করেন ও আহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। পরিদর্শনকালে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল সুষ্ঠু তদন্ত করে এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি জানান। এদিকে বুধবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি হারিপুর গ্রামে বাড়ি ঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাংচুরের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। কওমী ওলামা পরিষদ ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে পবিত্র কাবা ঘরের ছবির ওপর শিবমূর্তি বসিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, প্রতিমা ও বাড়িঘরে হামলা ভাংচুর, লুটপাটের ঘটনার প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে কওমী ওলামা পরিষদ। সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে নাসিরনগর উপজেলা কওমী ওলামা পরিষদের সভাপতি মাওলানা মোঃ সামছুদ্দীন বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুসলমান-হিন্দুসহ অন্য ধর্মের অনুসারীদের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যারাই নাসিরনগরের হামলার সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা আব্দুর রহিম কাসেমী, মাও. সাজিদুর রহমান, মুফতি এনামুল হাসান, নাসিরনগর উপজেলা কওমি ওলামা পরিষদের সহসভাপতি মাওলানা মুখলেছুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আবদুস সাত্তারসহ সংগঠনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং জেলার বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষকগণ উপস্থিত ছিলেন। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্যপরিষদ ॥ বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্যপরিদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী সংসদ ও সংসদের বাইরে বারবার বলেছেন তার দল আগাছায় ভরে গেছে। বুধবার বিকেলে ব্রাহ্মণাবড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা সদরে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও ঘর-বাড়ি পরিদর্শনে এসে বলেন, ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে যে সব ঘটনা ঘটেছে নাসিরনগরের ঘটনাটি তারই ধারাবাহিকতা বলে আমাদের কাছে দৃশ্যমান। গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। নাসিরনগরের হামলার ঘটনাকে হালকা অথবা লঘুভাবে বিবেচনা করা কোনভাবেই ঠিক হবে না। যদি লঘুভাবে বিবেচনা করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আরও বড় হামলার মুখোমুখি হবে আমরা তা অনুমান করতে পারি। রাজনৈতিক দল ও প্রশাসন একইসঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার চক্রান্তকারীরা এর মধ্যেই অবস্থান করছে কিনা। রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে কেন্দ্রীয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্যপরিষদের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। পরে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে দোষীদের গ্রেফতারের দাবি করে শুক্রবার সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা করেন।
×