ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাজু আহমেদ

মণিপুরি থিয়েটারের ২০ বছর পূর্তি ॥ ঢাকা থিয়েটারের ‘বিনোদিনী’

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ৩ নভেম্বর ২০১৬

মণিপুরি থিয়েটারের ২০ বছর পূর্তি ॥ ঢাকা থিয়েটারের ‘বিনোদিনী’

বাংলা নাটকের ইতিহাস তথা উপমহাদেশের নাট্য ইতিহাসের অন্যতম অবিস্মরণীয় নাম বিনোদিনী দাসী ? বাংলা মঞ্চনাটকে তার অভিনয়শৈলী তাকে অমরত্ব দিয়েছে। নটী বিনোদিনী নামে পরিচিত বিনোদিনী দাসীকে কিশোরী বয়সেই জীবনের প্রয়োজনে হাঁটতে হয়েছে পতিতাবৃত্তির পথে। তারপর সে জীবন ছেড়ে মঞ্চে অভিনয় শুরু। সময়ের তরী বেয়ে তিনিই একদিন হয়ে ওঠেন মঞ্চের মধ্যমণি। সে সময়ের মানুষ বিনোদিনীর অসাধারণ অভিনয় মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেছে। বলা যায়, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগের বাংলা নাট্যজগতের ইতিহাস তাই বিনোদিনীময়। তাকে নিয়েও রচিত হয়েছে নাটক। যা দর্শক নন্দিত হয়েছে দুই বাংলায়। তবে ব্যক্তিজীবন উঠে আসলেও ওপার বাংলায় রচিত নাটকগুলোতে শিল্পী হিসেবে বিনোদিনী দাসীর মূল্যায়ন হয়নি। বিশেষ করে কলকাতা বা দিল্লীর নাটকগুলোতে বিনোদিনীর ব্যক্তিজীবনকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে ফলে বিনোদিনীর শিল্পী সত্তাকে বাদ রেখে ব্যক্তিজীবনের উপস্থাপনা শিল্পের যথাযথ রূপটি আলো পায়নি। যে কাজটি ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে ঢাকা থিয়েটার। ব্যক্তি জীবনের পাশাপাশি শিল্পী বিনোদিনীর কথাও তুলে ধরা হয়েছে ঢাকা থিয়েটারের ‘বিনোদিনী’ প্রযোজনায়। তাদের নাটকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বিনোদিনী দাসীর শিল্পী জীবন ও মঞ্চের জন্য তার আত্মত্যাগের কথা। নাটকটি বেশ কিছুদিন পর আবার মঞ্চস্থ হলো সিলেটের মণিপুরি থিয়েটারের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত মাসব্যাপী নাট্যমেলায়। যথারীতি সেখানেও প্রশংসিত হয় নাটকটি। নটি বিনোদিনী দাসীর উত্থান ১৯ শতকের ৬০-৭০ দশকে। ১৮৬৩ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৮৭৪ সালে এগারো বা বারো বছর বয়সে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের ‘শত্রুসংহার’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। সেখানে তিনি ছিলেন দ্রৌপদীর সখী। ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত গ্রেট ন্যাশনাল, বেঙ্গল, ন্যাশনাল ও স্টার থিয়েটারের সেই সময়ের প্রায় সব নাটকের প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিনোদিনী। অভিনয় দক্ষতা গুণে অল্প সময়ের মধ্যে চারদিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র জীবনে এই নারী ৮০টি নাটকের ৯০টিরও বেশি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তবে স্বাভাবিক শিল্পী হিসেবে নয় বরং অভিনয় জীবনের শিল্পীদের সহযোগী হিসেবে পতিতাপল্লী থেকে তাকে ধরে নিয়ে আসা হয় নাটকে অভিনয় করার জন্য। কারণ সে সময় মেয়েদের মঞ্চে অভিনয় ছিল একবারেই দুঃসাধ্য। যেহেতু বিনোদিনী দাসী পরিত্যক্ত সমাজের বাসিন্দা অথচ বাবুদের অন্যতম প্রমোদিনী সঙ্গীদের পরিবারের সদস্য ছিল সেহেতু তাকে নাটকে নিলে বাবুদের বিনোদনও হবে নাটকওয়ালারও তাদের কর্মযজ্ঞ সুচারু রূপে সম্পাদন করতে পারবেন। সেই অভিজ্ঞানেই বিনোদিনীর উত্থান। কিন্তু বিনোদিনী দাসী তার প্রতি আস্থার মর্যাদা দিলেন শিল্পমূল্য অভিজ্ঞান নমস্যে। শিল্পে তার দুঃখ, কষ্ট, জীবন যন্ত্রণা ঢেলে দিলেন বাবুদের মনরঞ্জনে তার অভিনয়ের মাধ্যমে। ফলে তার অভিনয় শিল্প রূপত পেলোই পাশাপাশি উপমহাদেশ তো বটেই সারাবিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী নাটক সংশ্লিষ্টরা তাকে মনে রাখল যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। এই বিনোদিনী দাসীর জীবনী অবলম্বনে ২০০৫ সালে ‘বিনোদিনী’ নাটকটি মঞ্চে নিয়ে আসে ঢাকা থিয়েটার। এক যুগকালে দেশে-বিদেশ মিলে শতাধিক মঞ্চায়ন হয়েছে নাটকটির। এরই ধারাবাহিকতায় সিলেটের মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ঘোড়ামারা গ্রামের নটম-পে মণিপুরি থিয়েটারের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মাসব্যাপী নাট্যমেলার দ্বিতীয় দিনে মঞ্চস্থ হলো ‘বিনোদিনী’। কিংবদন্তি এই অভিনেত্রীর শিল্পী জীবন, ব্যক্তিজীবনের কষ্ট এবং সংগ্রামের নানা ইতিহাসের পাশাপাশি শিল্পী হিসেবে তার মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা করেছে ঢাকা থিয়েটার। বিনোদিনী দাসীর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার কথা’ এবং ‘আমার অভিনয় জীবন’, এ দুটো বইয়ের আলোকে ‘বিনোদিনী’ নাটকের নাট্যরূপ দিয়েছেন নাট্যকার ও লোক-গবেষক সাইমন জাকারিয়া। নাটকের মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন প্রয়াত নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। যথারীতি নাটকের চলমান শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ। ঢাকা থিয়েটারের ৩১তম এই প্রযোজনা বাংলাদেশেরও সম্পদ ও শিল্প ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে। শিমুল ইউসুফের চরিত্র রূপায়ন, অভিনয়গুণ তথা শিল্প উপস্থাপনার নান্দনিকতায় ‘বিনোদিনী’ হয়ে উঠেছে ইতিহাসের অংশ। যেমনটি সত্যিকারের নাট্য ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বিনোদিনী দাসী। ওপার বাংলার মতো ঢাকার মঞ্চে আসার পর থেকেই ‘বিনোদিনী’ পেয়েছে বিপুল প্রশংসা। সেটা বিনোদিনী দাসীর জীবনী হিসেবে না যতটা তার চেয়েও বেশি শিমুল ইউসুফের একক অভিনয়ে বিনোদিনী হয়ে ওঠার স্পর্ধায়। নাটকের নেপথ্য শিল্পীদের মধ্যে অর্থবহ আলোক প্রক্ষেপণে ইসরাত নিশাত, মঞ্চচিত্রনে কামাল উদ্দীন কবীর ও পোশাকে শিমুল ইউসুফ নিজেও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। যা মঞ্চে একটি পরিপূর্ণ শিল্পের রূপকে অতি রঞ্জিত করেনি।
×