ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাট্যজন রবিউল আলমের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ৩ নভেম্বর ২০১৬

নাট্যজন রবিউল আলমের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাজু আহমেদ ॥ চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনের উন্মেষ ও বিকাশ পর্বের অন্যতম সারথি, দেশের প্রথিতযশা নাট্যজন, নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক ও সংগঠক রবিউল আলম। প্রবীণ এই নাট্যজন বিগত সাড়ে চার দশক ধরে নাট্য আন্দোলনের প্রতিটি পর্বে নিবিড়ভাবে যুক্ত আছেন। চট্টগ্রামের নন্দিত সংগঠন তীর্যক নাট্যগোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। নাট্যজগতের প্রায় সব শাখায় তার সরব পদচারণা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। তার রচিত অসংখ্য মঞ্চনাটক তীর্যকসহ দেশের বিভিন্ন সংগঠন মঞ্চায়ন করছে। তিনি বেতার এবং টেলিভিশনের জন্য নাটক রচনা, প্রযোজনা ও অভিনয় করেছেন। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের অন্যতম প্রাণ পুরুষ রবিউল আলমের জন্মদিন আজ। এ উপলক্ষে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরা এই গুণীজনকে নিয়ে বিশেষ আয়োজন করেছে। রবিউল আলমের জন্ম বগুড়ার বারপুর গ্রামে হলেও নাটকের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন চট্টগ্রামে। ১৯৬৫ সালে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ করেন। অভিনেতা-নাট্যকার রূপে জীবনের প্রথম রচিত নাটক ‘বর সঙ্কট’ প্রযোজনা করেন প্রথমে কর্মস্থল টিএসপি ও পরে কল্লোল থিয়েটারে। সেটাও ১৯৭২-৭৩ সালের কথা। অতঃপর ১৯৭৪ সালে তীর্যক নাট্যগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে যুক্ত হন। তীর্যকের প্রথম প্রযোজনা ‘জননীর মৃত্যু চাই’-এর রচয়িতা রবিউল আলম। এ ছাড়াও দলের জন্য ‘সমাপ্তি অন্যরকম’, ‘এক যে ছিল দুই হুজুর’, ‘আকাক্সিক্ষত একজন’, ‘বিপক্ষে বন্দুক’সহ সাতটি নাটক লিখেছেন। অনুবাদ করেছেন শেক্সপিয়ারের ‘এ্যাজ ইউ লাইক ইট’ নাটক। তীর্যক নাট্যমাসিকে প্রকাশিত হওয়ার সুবাদে সত্তর-আশির দশকে তার রচিত নাটক দেশের সর্বত্র মঞ্চস্থ হয়। দলের বাইরে তার রচিত মঞ্চস্থ হওয়া উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার মধ্যে রয়েছে ‘নাপুস’ (ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, কোরাস, বেনানাশিস ও চট্টগ্রাম ক্লাব), ‘রাজা সাহিত্য কারখানা’ (থিয়েটার ওয়ার্কশপ চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ক্লাব ও শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র), ‘বিবি পাঠশালা’ (ত্রিতরঙ্গ, মতিঝিল থিয়েটার), ‘আকাশ পারের আগন্তুক’ এবং ‘উল্টো ফাঁদে’ (চট্টগ্রাম ক্লাব), ‘মিশার কীর্তি’ এবং ‘চলন বিলে কলঙ্ক’ (প্রাকৃতজন, বগুড়া)। সম্প্রতি ঢাকার তিনটি দল তার তিনটি নাটকের নিয়মিত প্রযোজনা করছে। এর মধ্যে ‘চলন বিল’ এবং রবীন্দ্রনাথের গল্পের নাট্যরূপ ‘কঙ্কাল’ মঞ্চায়ন করছে নাট্যতীর্থ, ‘নিঃসঙ্গ নিরাময়’ মঞ্চায়ন করছে নাট্যপ্রয়াস ও মতিঝিল থিয়েটার। এ নাটকগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটির নির্দেশক রবিউল আলম নিজে। তার রচিত ‘সমাপ্তি অন্যরকম’ রাজশাহী সাংস্কৃতিক সংঘ ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় জাতীয় নাট্যোৎসবে প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চস্থ করে। এ ছাড়া তার অনুবাদিত-নির্দেশিত শেক্সপিয়ারের ‘এ্যাজ ইউ লাইক ইট’ ১৯৯১ সালে চতুর্থ জাতীয় নাট্যোৎসবে তীর্যক প্রযোজনা হিসেবে প্রশংসিত হয়। তার রচিত ‘নাপুস’ নাটকটি ১৯৯৩ সালে বেনানাশিস জাতীয় নাট্যোৎসবে শ্রেষ্ঠ প্রযোজনার স্বীকৃতি পায়। ‘সমাপ্তি অন্যরকম’ নাটকটি ছিল চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটারের প্রথম ২৫তম মঞ্চায়নের নাটক। মঞ্চের নিবেদিত কর্মী ও নাট্যকার রবিউল আলম ১৯৭৫ সালে ‘বর সঙ্কট’ নাটকের মাধ্যমে বেতারের নাট্যকার হিসেবে যুক্ত হন। এরপর অভিনেতা ও পরে অতিথি প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন। তার বেশির ভাগ মঞ্চ নাটকের বেতার নাট্যরূপ প্রচারিত হয়েছে চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বেতার কেন্দ্র থেকে। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের অভিনেতা ও নাট্যকার। তার রচিত উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘বন্ধনহীন গ্রন্থি’, ‘অমি যখন বন্দী’, ‘পরাহত’, ‘শান্তা একদিন’, ‘কখনও সৈকতে’, ‘অজ্ঞাতবাস’, ‘ছায়াহীন বৃক্ষ’, ‘যার সাথে যার’, ‘বাঁধ ভেঙে দাও’ (বিটিভি); ‘নিভৃত নিবাস’ (ইটিভি), ‘উল্টো ফাঁদ’ (চ্যানেল আই), ‘নাপুস’ (অধুনালুপ্ত টিইএন), ‘এক সকালে’ ও ‘চন্দ্রাহত’ (এটিএনবাংলা)। মঞ্চ, বেতার ও টিভি নাটক ছাড়াও রবিউল আলম ‘আলগা নোঙর’, ‘হালদা’সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ১৪টি নাট্যগ্রন্থসহ রবিউলের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৮। এর মধ্যে শেক্সপিয়ার, মলিয়ের ও হ্যারল্ড পিন্টারের নাটকের তিনটি অনুবাদগ্রন্থও রয়েছে। রবিউল সম্পাদনা করেছেন তীর্যক নাট্য ত্রিমাসিক পত্রিকার (১৯৭৬-’৭৯) যার বারোটি সংখ্যায় পত্রস্থ হয় সে সময়ের ৩০টি নাটক। এ ছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত তীর্যক প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হয়েছে বেশ কয়েকজন নাট্যকারের দশটি গ্রন্থ। নাট্যকার হিসেবে বেশ কিছু সম্মাননা পেয়েছেন রবিউল আলম। এর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক যুববর্ষ পদক চট্টগ্রাম (১৯৮৫), বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন-বেঙ্গল ফাউন্ডেশন সংবর্ধনা (২০০৫), এ্যামবিশন সম্মাননা বগুড়া (২০১০) ও আরণ্যক সম্মাননা (২০১৩) ও নান্দীমুখ সংবর্ধনা (২০১৫)। ব্যক্তি রবিউল আলমের জন্ম বগুড়া জেলার বারপুর গ্রামে ১৯৪৬ সালের আজকের দিনে। তার পিতা জসিমউদ্দিন আহমেদ; মাতা জমিলা খাতুন। ব্যক্তি জীবনে তিনি কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (বুয়েট) থেকে ১৯৬৯ সালে লেখাপড়া শেষ করেন। কর্মজীবনে তিনি টিএসপি ফার্টিলাইজার, ইউনিলিভার বাংলাদেশ ও কোহিনূর কেমিক্যালে ৩৫ বছর ধরে কাজ করেছেন। ভ্রমণ করেছেন এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন দেশ। তিনি বাংলা একাডেমি, ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স আজীবন সদ্য, সদস্য চট্টগ্রাম ক্লাব ও চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামের দক্ষিণ খুলসী আবাসিক এলাকায় বসবাস করছেন। আজ ৩ নবেম্বর রবিউল আলমে ৭০তম জন্মদিন। বরেণ্য এই নাট্যজনের জন্মদিন উপলক্ষে ‘রবিউল আলম জন্মবার্ষিক উদযাপন পরিষদ’ আজ চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার রুমে ‘নাট্যকার রবিউল আলমের ৭০তম জন্মদিন উদযাপন’ শীর্ষক অনুষ্ঠামালার আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ, সম্মাননা প্রদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সবশেষে নাটক মঞ্চায়ন। জীবনের বেশিরভাগ সময় নাটকের জন্যই আনন্দের সঙ্গে ব্যয় করেছেন রবিউল আলম। এই সময়ে এসে জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেবে করেছেন কী? এ প্রসঙ্গে রবিউল আলম জনকণ্ঠকে বলেন আমরা নাটকের মানুষ। প্রাপ্তি বলতে একটাই সেটা হলো মানুষের ভালবাসা অর্জন। জীবনে যা করেছি সবই মানুষের জন্য। তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। নাটক নিয়েই বাঁচতে চাই। জন্মদিনের আয়োজন প্রসঙ্গে বলেন, এই প্রথমবার আমার জন্মদিন নিয়ে আয়োজন করা হচ্ছে। যারা আমাকে ভালবাসেন তারা এ আয়োজন করেছেন। এ জন্য আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। বরেণ্য এই নাট্যজন আজীবন নাটকের জন্যই নিবেদিত থাকবেন সেই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। জন্মদিনে তার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা।
×