ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ নাসিম

আমার পিতা আমার অহঙ্কার

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ৩ নভেম্বর ২০১৬

আমার পিতা আমার অহঙ্কার

শহীদ এম মনসুর আলী সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মহানায়ক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে চারজন জাতীয় নেতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার অন্যতম শহীদ এম মনসুর আলী। যিনি আমার গর্বিত পিতা এবং সর্বসময় সর্বমুহূর্তে আদর্শিক নেতা। যখনই আমি কোন কাজ করি, চিন্তা করি আমার চিন্তা-চেতনায় সব সময় আমার পিতার স্পর্শ-আবেগ অনুভব করি। তিনি যেমন জীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন, মরণেও আজকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই আছেন। আমার পিতা তাঁর পরিবারের বাইরে প্রতিটি মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবতেন, বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়া যেন তাঁর কোন অস্তিত্ব ছিল না। মাঝে মধ্যে আমার মনে হতো তিনি যেন আমাদের চাইতে বঙ্গবন্ধুকে বেশি ভালবাসতেন। তিনি যখন রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছেন সেই মুহূর্ত থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছাড়া তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোন কিছু করারই চিন্তা করতেন না। আমি তাঁর সন্তান হিসেবে দেখেছি ৬ দফার আন্দোলনে যখন বঙ্গবন্ধুর অনেক সহকর্মী তাকে ত্যাগ করে চলে গেছেন কারাবন্দী অবস্থা থেকেও আমার পিতা মনসুর আলী শত প্রলোভন ও চাপের মুখেও তখনকার পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান, সালাম খানদের সঙ্গে যোগদান করেননি। অথচ দীর্ঘ কারাজীবন ভোগ করেছেন কিন্তু নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে বেইমানি করেননি। আমার পিতার দৃঢ় অভিব্যক্তি মনোভাবকে দেখেছি, তখন আমি ৬৬/৬৭ সালে যখন তিনি পাবনা কারাগারে বন্দী ছিলেন আমিও ছাত্রাবস্থায় পিতার সঙ্গে সে মুহূর্তে একই কারাগারে আটক ছিলাম। দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম শেষে যখন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানে কারাগারে বন্দী তখন আমার পিতাসহ জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে মুজিবনগর সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দেন। সেই বিরল মুহূর্তগুলো দেখার বা জানার আমার সুযোগ হয়েছে। আমি দেখেছি সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে শহীদ এম মনসুর আলী কি দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ মনোভাব নিয়ে স্বাধীনতার বিজয় এবং জীবিত বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং কাজ করে গেছেন। খন্দকার মোশতাকের মতো একজন সুযোগ সন্ধানী বিশ্বাসঘাতক ওই প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের মুহূর্তেও চেষ্টা করেছে এই চারজনের মধ্যে ফাটল ধরাবার জন্য এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোস করার নানা রকম প্রলোভনের জাল বিস্তার করে মুজিবনগর নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করার। কিন্তু একটি বিপজ্জনক এবং জাতির যুগসন্ধিক্ষণে শহীদ এম মনসুর আলী অন্য তিন নেতার সঙ্গে থেকে সব ভয়-ভীতি, অনিশ্চয়তা এবং প্রলোভন উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করেছেন। সফেদ সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আমার পিতা মনসুর আলী এই ক’মাস অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে মুজিবনগরের রণাঙ্গনে ছুটে বেরিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকেছেন, সাহস দিয়েছেন। প্রবাসী সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার শত শত দলীয় সহকর্মী, দেশ থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার কর্মীকে অর্থসহ নানাভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। আমি দেখেছি হাজার অনিশ্চয়তা ও অমানিশা অন্ধকারের মধ্যেও সাধারণ বাঙালীর চেয়েও দীর্ঘদেহী আমার পিতার উজ্জ্বল প্রত্যয় মুখোচ্ছবি দেখতাম। তিনি সর্বদা বলতেন, বাঙালীর বিজয় অবশ্যম্ভাবী এবং তিনি সর্বদা বলতেন, ‘জীবিত বঙ্গবন্ধুকে আমরা ইনশা আল্লাহ মুক্ত করব।’ আসলে জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে মুজিবনগরে যে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব সংঘটিত হয়েছিল তা নিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করা যেতে পারে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলা, চট্টগ্রাম ও খুলনা পোর্ট পুনরায় চালু করে কার্যকর বন্দরে পরিণত করা, সর্বোপরি এক নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, স্বাধীনতাবিরোধী এবং তথাকথিত হঠকারী বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী নামধারীদের অপতৎপরতা রোধ করে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করা ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। তবু তিনি যে সবের মোকাবেলা করেছেন। আমার পিতাকে চিরদিনের জন্য হারানোর আগে মাত্র কয়েক ঘণ্টা তার সঙ্গে আমি ছিলাম। ১৫ আগস্টের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সে সময় তাকে দেখেছি কি উদ্বেগ এবং প্রচ- বেদনা নিয়ে একদিকে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর কথা মনে করছেন, অন্যদিকে প্রতিশোধ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে দলীয় সহকর্মী এবং তদানীন্তন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। শহীদ এম মনসুর আলী আত্মগোপন অবস্থায়ও চেষ্টা করেছেন নানাভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু কিছু সহকর্মীর ভীরুতা আপোস এবং জীবন রক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা, অন্যদিকে তখনকার সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতা, চরম কাপুরুষতায় শহীদ এম মনসুর আলী ভীষণভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন এবং হতাশ হয়েছিলেন। কিছু করতে না পারার বেদনা এবং অশ্রুসিক্ত চেহারা আমি দেখেছিলাম। কিন্তু একটা জিনিস ধ্রুব তারার মতো সত্য, তিনি জীবন দেবেন কিন্তু অন্য অনেকের মতো বিশ্বাসঘাতকতা করে খন্দকার মোশতাকের হাতে হাত মেলাবেন না সেই দৃঢ় প্রত্যয় তার মাঝে আমি দেখেছি। যে কারণে তিনি মাথা উঁচু করে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের মুখের ওপর বলেছিলেন- তোমার মতো বেইমানের সঙ্গে আমি হাত মেলাব না। জীবন দেব; প্রধানমন্ত্রী হব না। তিনি তার কথা রেখেছেন। শহীদ এম মনসুর আলী আপোস করেননি, আত্মসমর্পণ করেননি, জীবনের ভয়ে মাথানত করেননি, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী অবস্থায় ঘাতকের হাতে জীবন দিয়েছেন। ১৫ আগস্টের পরে বাঙালীর রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক বিশ্বাসঘাতক-কাপুরুষের জন্ম হলেও চারজন মৃত্যুঞ্জয়ী নেতার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন। যারা জীবন দিয়েছেন, জাতির পিতার সঙ্গে বেইমানি করেননি, তাদের সঙ্গে একজন হবেন আমার পিতা শহীদ এম মনসুর আলী। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমার পিতা শহীদ এম মনসুর আলীকে আমি হারিয়েছি এর চেয়ে বড় বেদনা, এর চেয়ে কষ্ট আমার জীবনে কিছু নেই। কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে বড় গর্ব ও অহঙ্কার হলো আমি খন্দকার মোশতাকের মতো কোন বেইমানের সন্তান নই, শহীদ এম মনসুর আলীর মতো একজন সাহসী মৃত্যুঞ্জয়ী পিতার সন্তান। নেতা বা নেতার আদর্শের সঙ্গে বেইমানি নয়, বিশ্বাসঘাতকতা নয়, কোন আপোসকামিতা নয়, আমার শহীদ পিতার এই আদর্শ ধরেই আমি কাজ করেছি, কাজ করে যাব- ৩ নবেম্বরের শহীদের প্রতি এটাই আমার প্রত্যয়দীপ্ত শ্রদ্ধা। লেখক : এমপি, মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সভাপতিম-লীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
×