ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নেপথ্যে মাদকের ঘটনা

তৈয়বা মজুমদার ব্লাড ব্যাংকে নির্যাতিত একজনের মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২ নভেম্বর ২০১৬

তৈয়বা মজুমদার ব্লাড ব্যাংকে নির্যাতিত একজনের মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ দিনাজপুরে তৈয়বা মজুমদার ব্লাড ব্যাংকে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আহতাবস্থায় মঞ্জুরুল ইসলাম (১৮) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের স্বজনদের অভিযোগ, ইয়াবার চালানকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার নির্যাতনে সে মারা গেছে। নিহত মঞ্জুরুল ইসলাম সদর উপজেলার ৫নং শশরা ইউনিয়নের মহতুল্লাপুর গাজারমারি গ্রামের আব্দুল কাদেরের ছেলে। সে পেশায় ট্রাকের হেলপার ছিল। নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানায়, মঞ্জুরুল ইসলাম একজন ট্রাক হেলপার। গত কয়েকদিন আগে সে সদর উপজেলার খোদমাধবপুর গ্রামের মির্জা মামুনের ট্রাকের হেলপার হিসেবে চট্টগ্রামে যায়। সেখান থেকে আসার সময় রাস্তায় ট্রাকের চালক নেমে যায়। ট্রাকটি নিয়ে মঞ্জুরুল ইসলাম ফিরে আসে। পরে ২৫ অক্টোবর মঙ্গলবার রাতে মঞ্জুরুল ইসলাম বাসায় ফিরেনি। ২৬ অক্টোবর মোবাইল ফোনে জানতে পারে মঞ্জুরুল ইসলাম দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। সেখানে গিয়ে তারা মঞ্জুরুল ইসলামের কাছে জানতে পারেন ট্রাকের মালিক মির্জা মামুনের নেতৃত্বে জনৈক তরিকুল, সিরাজুল সালেকিন রানাসহ ৫-৬ জন মিলে গত ২৫ অক্টোবর মঙ্গলবার রাতে তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর উপশহর ১নং ব্লকের বেগম তৈয়বা বেগম রেডক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংকে আটকে রেখে সারারাত ধরে নির্যাতন চালায়। নিহত মঞ্জরুল ইসলামের পিতা আব্দুল কাদের ও বোন নাসিমা বেগম জানায়, নির্যাতনে প্লাস দিয়ে মঞ্জুরুল ইসলামের হাতের নখ তুলে ফেলা হয়, দু’হাতে ব্লেড দিয়ে চিরে সেখানে লবণ ও মরিচের গুঁড়া লাগিয়ে দেয়া হয়। এরপর তাকে দেয়া হয় বৈদ্যুতিক শক। পরে সেখানে গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে র‌্যাব সদস্যরা দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। ওইদিনই র‌্যাব সদস্যরা ক্ষমতাসীন দলের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য সিরাজুল সালেকিন রানাকে আটক করে র‌্যাব ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয়া হয়। এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন তারা। তারা জানান, ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়ায় এখন মামলা করতে ভয় পাচ্ছেন তারা। বড় বোন আলেয়া বেগম জানান, মঞ্জুরুল ইসলাম মারা যাওয়ার আগে বলে গেছে তাকে মির্জা মামুনের নেতৃত্বে জনৈক তরিকুল, সিরাজুল সালেকিন রানাসহ ৫-৬ জন মিলে তুলে নিয়ে আসে। প্রথমে তাকে শশরা স্কুল মাঠে মারধর করে জানতে চাওয়া হয় ট্রাকে থাকা ইয়াবা চালানের কথা। এ বিষয়ে সে কিছুই জানে না বললে তাকে তুলে নিয়ে বেগম তৈয়বা বেগম রেডক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংকে গার্ডরুমে নিয়ে আসা হয়। সেখানে সারারাত তাকে নির্যাতন চালানো হয়। সেখানে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে লবণ ও মরিচের গুঁড়া লাগিয়ে দেয়া হয়। দেয়া হয় বিদ্যুতিক শক। গরম পানির বোতল ও কারেন্টের তার দিয়ে পেটানো হয়। এ সময় সে বার বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান ফিরে এলে আবার তাকে টর্চার করা হয়। বার বার তার কাছে জানতে চাওয়া হয় ইয়াবা চালান কোথায় বা চালক কোথায়। কিন্তু সে এ ব্যাপারে কিছুই জানে না বলে জানায়। পরের দিন ২৬ তারিখে স্থানীয় একজন ব্যক্তি র‌্যাবকে ফোন দিলে র‌্যাব সদস্যরা সকাল ১১টায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। এ সময় আটক করা হয় সিরাজুল সালেকিন রানাকে। পরে চারদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মঞ্জুরুল ইসলামকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। বাসায় থাকা অবস্থায় মঙ্গলবার সকাল ১১টার সময় সে মারা যায়। নিহতের চাচাত ভাই সামিনুল, চাচা আজগর আলী, ভাগিনি শাহিনা বেগম জানায়, নির্যাতনের শিকার মঞ্জুরুলের মাংস পচে গা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। মাঝে মাঝেই হতো রক্ত বমি। নির্যাতনের ফলে সে ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছিল না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্লাড ব্যাংকের এক কর্মচারী জানান, ওই প্রতিষ্ঠানটির গত বছর থেকে নতুন কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলার রেস্ট হাউসটি নিজ কব্জায় নেয় সিরাজুল সালেকিন রানা। সেখানে টেন্ডারবাজি, মাদকখানাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। র‌্যাব দিনাজপুর সিপিসি ক্যাম্প-১ এর অধিনায়ক মেজর আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ রাজু জানান, জিজ্ঞাসাবাদের পর রানা অভিযুক্ত না থাকায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়া তাদের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ অভিযোগ করেনি। এ ব্যাপারে দিনাজপুরের পুলিশ সুপার হামিদুল আলম জানান, মারধরের ঘটনায় মঞ্জুরুল মারা যাওয়ার ঘটনা জানার পরপরই তার মরদেহ নিয়ে আসা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসলেই বিষয়টি ঠিকভাবে বোঝা যাবে। তিনি জানান, এ ঘটনায় কেউ অভিযোগ দিলে মামলা দায়ের করা হবে। তাছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে মঞ্জুরুল মাদকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করেন তিনি।
×