ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতারক চক্র বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে

সিঙ্গাপুরে জনশক্তি রফতানি নিয়ে প্রতারণা থামছে না

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২ নভেম্বর ২০১৬

সিঙ্গাপুরে জনশক্তি রফতানি নিয়ে প্রতারণা থামছে না

ফিরোজ মান্না ॥ সিঙ্গাপুরে জনশক্তি রফতানি নিয়ে প্রতারণা কিছুতেই থামছে না। নতুন নতুন প্রতারণার জাল বিস্তার করে একটি প্রতারক গোষ্ঠী হাতিয়ে নিচ্ছে দরিদ্র মানুষের অর্থ। নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে অনেক পরিবার। মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এই প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ‘প্রোগ্রেসিভ টেস্ট সেন্টার প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি প্রতারণা চক্রের অন্যতম। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক সিঙ্গাপুরের নাগরিক। তার জনশক্তি রফতানির লাইসেন্স ২০১২ সালের মে মাসে (১৯৯৪ সালের ৩৪৬ ধারার বিধানমতে) বাতিল করা হয়েছে। লাইসেন্স বাতিল হওয়ার পর ‘প্রোগ্রেসিভ ট্রেড সেন্টার’ ও ‘জিহান ওভারসিস’ নামে বাংলাদেশী মালিকানাধীন লাইসেন্সের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ শুরু করে। সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের চাহিদাপত্র না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা জনপ্রতি নিচ্ছে। এসব কর্মী সিঙ্গাপুরে গিয়ে মাসের পর মাস চাকরি না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিতর্কিত ওই ব্যবসায়ী প্রতারণার দায়ে একাধিকবার সিঙ্গাপুরে জেল খেটেছেন। সিঙ্গাপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনেও তার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ জমা পড়েছে। সিঙ্গাপুরে কর্মী নিয়োগে প্রতারণার বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব কোন কথা বলতে রাজি হননি। সিঙ্গাপুর থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, প্রোগ্রেসিভ ট্রাস্ট সেন্টার প্রাইভেট লিমিটেড মালিক চীনা বংশোদ্ভূূত সিঙ্গাপুরের নাগরিক ভিক্টর বাংলাদেশে একটি ট্রেনিং সেন্টার পরিচালনা করেন। তার কোন জনশক্তি রফতানির লাইসেন্স নেই। ২০১২ সালের মে মাসে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় তার লাইসেন্স বাতিল করে দেয়। এর পর বাংলাদেশের জনশক্তি ব্যবসায়ী শাহাজাদা রণির লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান প্রোগেসিভ ট্রেড সেন্টারের নামে কর্মী পাঠাচ্ছেন। কর্মীদের সিঙ্গাপুরে চাকরি ঠিক না করেই তিনি কয়েক শ’ করে কর্মী নিয়ে যান। সিঙ্গাপুর সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ ধরনের কর্মীর মধ্য থেকে কয়েকজন করে কিছুদিন পর পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। এই সুযোগটি ভিক্টর লি কাজে লাগাচ্ছেন। সিঙ্গাপুরে অবস্থানকারী কয়েক জনশক্তি রফতানিকারী বলেন, ভিক্টোর লি হচ্ছে একজন বড় ধরনের প্রতারক। প্রতারণার দায়ে তিনি সিঙ্গাপুরে কয়েক দফা জেল খেটেছেন। এরপরও তার প্রতারণা থেমে নেই। একের পর এক প্রতারণা করেই যাচ্ছে। সম্প্রতি তিনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সিঙ্গাপুরে জনশক্তি রফতানি বিষয়ে মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশন দিয়েছেন। ওই সময়েই তিনি সিঙ্গাপুরে কর্মী নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের দুটি এজেন্সির মাধ্যমে তিনি এই টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের একটি চক্র তার পক্ষে কাজ করছে। মন্ত্রণালয়ের প্রতিটিস্তরেই তিনি ম্যানেজ করেন বলে তারা জানান। সিঙ্গাপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিক্টোর লির বিরুদ্ধে বহুবার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। হাইকমিশন অভিযোগের কাগজপত্র প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠালে মন্ত্রণালয় তার বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয় না। উল্টো হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের মন্ত্রণালয় থেকে শাসিয়ে দেয়া হয় বলে হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রোগেসিভ ট্রেড সেন্টারের মালিক শাহাজাদা রণির সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমরা নিয়ম মেনেই সিঙ্গাপুরে কর্মী নিয়োগ করছি। ভিক্টির লির সঙ্গে ব্যবসা রয়েছে। তবে তিনি সরাসরি কোন কর্মী নিয়োগ করেন না। আমাদের এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ করেন। বিএমইটির মাধ্যমে ম্যানপাওয়ার করিয়ে যথাযথ নিয়মে কর্মীদের সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। সূত্র জানিয়েছে, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় প্রতারক চক্রটি কর্মী পাঠানোর অনুমোদন নিচ্ছে। সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর জন্য ১৪টি বৈধ লাইসেন্স রয়েছে। এই বৈধ লাইসেন্স থেকে ৫ টি লাইসেন্সের বিষয়ে অভিযোগ থাকায় তারা কোন কর্মী পাঠাতে পারছেন না। বাকি ৮ টি প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর সুযোগ পাচ্ছেন। তবে ভিক্টোর লি যে দুটি এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠান, ওই দুটি এজেন্সি বেশিরভাগ কর্মী পাঠাচ্ছে। এ নিয়ে অন্যরা মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা আবেদনও করেছে। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। ভিক্টর লি যে কাজের কথা বলে কর্মী নিচ্ছে সেখানে গিয়ে তারা সে কাজ পাচ্ছেন না। অনেক কর্মীকে মাসের পর মাস বসে থাকতে হচ্ছে। ভাগ্য ভাল হলে সরকারের পক্ষ থেকে ডাক পেয়ে চাকরি পান। এখানে ভিক্টর লির কোন অবদান নেই। জানা গেছে, প্রোগ্রেসিভ টেস্ট সেন্টার লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭ সালের ২৯ এপ্রিল ‘লিমিটেড কোম্পানি’ হিসেবে নিবন্ধন লাভ করে। ২০১২ সালের ৮ মে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদফতর থেকে কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণার তথ্য গোপন করে প্রতিষ্ঠানটি গত চার বছর ধরে বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তিপত্র গ্রহণ করে সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠাচ্ছে। ২০১৫ সালের ১০ আগস্ট প্রোগ্রেসিভ সেন্টার সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর জন্য ওয়েসিস সার্ভিসেস রিক্রুটিং এজেন্সি ও জিহান ওভারসিস রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত হয়। এছাড়া এই কোম্পানির কর্ণধার সম্প্রতি বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর ব্যয় কমানোর প্রস্তাব করে। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে তিনি সিঙ্গাপুরে ৪-৫ লাখ টাকায় কর্মী নেয়ার প্রস্তাব দেয়। অথচ সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর জন্য সরকার নির্ধারিত ফি এক লাখ টাকারও নিচে। বিলুপ্ত কোম্পানির তালিকাভুক্তি এবং সরকার নির্ধারিত সীমার কয়েকগুণ বেশি অর্থে কর্মী নিয়োগের প্রস্তাব তিনি কিভাবে মন্ত্রণালয়ে দিয়েছেন এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ৪-৫ লাখ টাকার কথা বললেও তিনি আসলে জনপ্রতি ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নিচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের কাছে নিজের ভাবমূর্তি ভাল রাখার জন্য কৌশলে তিনি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়া ভারসাগি এ্যাপসের মাধ্যমে এই চক্রটি সিঙ্গাপুরে কর্মী নিয়োগের লিফলেট বিলি করছে। লিফলেটে সিঙ্গাপুরে কর্মীদের জন্য লোভনীয় সব অফার দেয়া হয়। এতে বলা হয়, এই এ্যাপসের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন নিয়ে নাকি সিঙ্গাপুরে তিন লাখ কর্মী নিয়োগ করা হবে। সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত ‘স্বপ্নের দেশ’ নামে একটি বাংলা পত্রিকায় ভারসাগি মেনেজমেন্ট প্রাঃ লিঃ একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতেও সিঙ্গাপুরে বসবাস করার লোভনীয় অফার রয়েছে। এই ভারসাগি কোম্পানির মালিক ভিক্টর লি। বিশ্বের যে কোন দেশে কর্মী প্রেরণের জন্য চাহিদার বিপরীতে স্থানীয় দূতাবাস সত্যায়িত করে দেয়। এই সত্যায়নের ভিত্তিতেই বিএমইটি ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিদেশে লোক পাঠানোর অনুমতি দিয়ে থাকে। কিভাবে এই ভারসাগি লিঃ এসব কর্মকা- পরিচালনা করছে এর জবাব নেই কারো কাছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভিক্টর লি সেগুনবাগিচায় এক সংবাদ সম্মেলন করে সিঙ্গাপুরে অভিবাসন ব্যয় ৭/৮ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে অর্ধেক করার ঘোষণনা দেয়। তিনি দাবি করেন, ভারসাগি এ্যাপসের মাধ্যমে তার প্রতিষ্ঠানকে এককভাবে সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দেয়া হলে ৪/৫ লাখ টাকায় তিনি কর্মী পাঠাতে পারবেন। সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি সিঙ্গাপুরে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে ১ লাখ টাকার বেশি গ্রহণ করতে পারবে না। প্রশ্ন উঠেছে, এই ব্যক্তি কিভাবে প্রকাশ্যে ৪/৫ লাখ টাকায় লোক পাঠানোর ঘোষণা দেয়। প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তারা কোন কথা বলতে রাজি হননি। তবে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ভিক্টর লি মন্ত্রণালয়ে আস্থাভাজন একজন। সিঙ্গাপুরের বাজারটি তিনি একাই নিয়ন্ত্রণ করছেন। যেহেতু ৫ টি কোম্পানির লাইসেন্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাই তারা আপাতত কোন কর্মী সিঙ্গাপুর পাঠাতে পারছেন না। বাকি ৬ টি কোম্পানিকে খুব একটা কাজ দেয়া হয় না। ভিক্টর লি হচ্ছে একমাত্র ব্যক্তি যিনি একচেটিয়া সিঙ্গাপুরে কর্মী নিয়োগ করছে বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। সিঙ্গাপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে ভিক্টর লির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ এসেছে, এটা সত্য। এসব অভিযোগ মন্ত্রণালয় আমলে েিনবে না, এটাও সত্য। ভিক্টর লির যত অন্যায়ই থাকুক না কেন তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে না।
×