ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবনী আক্তার সান

সাকিবের অবদানও কম নয়

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২ নভেম্বর ২০১৬

সাকিবের অবদানও কম নয়

তামিম ইকবালের নজর কাড়া ব্যাটিং, মেহেদী মিরাজের অবিস্মরণীয় অভিষেকে বিষয়টা হয়ত আড়ালে চলে গেছে। তবে ইংলিশদের বিপক্ষে ঐতিহাসিক এই সাফল্যে সাকিবের অবদান কম নয়। দ্বিতীয় টেস্টে ইংল্যান্ডকে হারানোর ‘টার্নিং পয়েন্টটা’ কিন্তু গড়ে দিয়েছিলেন টাইগার তারকা সাকিব-আল হাসানই। জো রুটকে (১) এলবিডব্লিউ, এবং সিরিজজুড়ে বাংলাদেশকে ভোগানো বেন স্টোকসকে সাজঘরে ফিরিয়ে ইংলিশদের ব্যাকফুটে ঠেলে দেন সাকিব। বোল্ড করার পর স্টোকসকে অভিনব এক ‘স্যালুট’ উপহার দিয়ে আলোচনার খোরাক যুগিয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার! তৃতীয় দিনে ফল নির্ধারিত হওয়ার পর এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরে স্টোকসও এক টুইটার বার্তায় বাংলাদেশের জয় সমর্থকদের উল্লাস, সিকিউরিটি ব্যবস্থা এবং সাকিবকে ‘স্যালুট’ জানিয়েছেন! মিরপুর টেস্টে শেষ পর্যন্ত ইনিংসে সাকিবের শিকার সংখ্যা ৪, ম্যাচে ৫। (২+৫) = ৭ উইকেট নিয়ে চট্টগ্রাম টেস্টটাও কিন্তু তিনিই জমিয়ে তুলেছিলেন। যদিও সিরিজে ব্যাট হাতে (৩১, ২৪, ১০ ও ৪১ রান) ঠিক প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি। সবসময় চোখে মুখে দুষ্টামি খেলা করা ২৯ বছর বয়সী টাইগার তারকার মাঝে মধ্যেই এমন ব্যতিক্রম কিছু করার অভ্যাস নতুন নয়। তবে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে ‘স্যালুট’ বোধ হয় এই প্রথম! তাও আবার সেই ওয়ানডে সিরিজের শুরু থেকে যে স্টোকসের সঙ্গে বাংলাদেশী ক্রিকেটার ও সমর্থকদের সম্পর্ক সাপে-নেউলে, সেই তাকে! মড়কের মাঝে একপ্রান্ত আগলে রেখে ব্যাট করছিলেন স্টোকস। শেষ বিকেলে ৩৬ বলে ২৫ রান করা ইংল্যান্ড ব্যাটস্যামানকে পরিষ্কার বোল্ড করে কার্যত ইংলিশদের কফিনে বড় পেরেকটা ঠুকে দেন সাকিব। তখনই টিভি ক্যামেরায় মজার ওই দৃশ্য- ঠায় দাঁড়িয়ে স্টোকসকে স্যালুট জানাচ্ছেন সাকিব! মুহূর্তেই সেটি ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। পেছনের রহস্যটা নিশ্চয়ই অনুমেয়। টেস্টের আগে ঢাকায় সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে দুই দলের ক্রিকেটাররা বেশ বিবাদে জাড়িয়ে পড়েছিলেন। সফরকারী ওয়ানডে অধিনায়ক জস বাটলারকে আউট করার পর অতিমাত্রায় উদ্যাপন করতে গিয়ে সেনাপতি মাশরাফি বিন মর্তুজা ও সাব্বির রহমানকে জরিমানাও গুনতে হয়েছিল। খেলা শেষে হাত মেলানোর সময় তামিমের কাঁধে ঝাঁকুনি দিলে স্টোকসের সঙ্গে আরেক দফা লেগে যায়। সেদিন সাকিবই মধ্যস্থতা করে তাৎক্ষণিক বিবাদটা মিটিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভোলেননি, সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। প্রিয় বন্ধু তামিমের হয়ে এবার কী মধুর প্রতিশোধটাই নিলেন সাকিব! তাও আবার নাক উঁচু কুলীন ইংলিশদের ১০৮ রানে বড় ব্যবধানে হারানোর পর। আহা শান্তি বুঝি একেই বলে! মজার বিষয়, ক্রিকেটে আগের আলোচিত ‘স্যালুট’ ঘটনার সঙ্গেও এই স্টোকসের নাম জড়িয়ে। গ্রানাডায় সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ তারকা মারলন স্যামুয়েলস তাকে এমন ‘ব্যঙ্গাত্মক’ অভিবাদন উপহার দিয়েছিলেন। দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরির (১০৩) পথে স্যামুয়েলসকে যারপরনাই বিরক্ত করছিলেন স্টোকস। পরে স্টোকস আউট হওয়ার পর তাকে মিলিটারি কায়দায় ‘স্যালুট’ করেছিলেন বোলার স্যামুয়েলস! চট্টগ্রাম টেস্টেই বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ১৫০ উইকেটের মাইলফলক পেরিয়েছেন তিনি। চট্টগ্রাম টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নামার আগে ৪২ টেস্টে ১৪৭ উইকেট ছিল তার। প্রথম ইনিংসে ২ উইকেট শিকার করেন দেশের পক্ষে সর্বাধিক টেস্ট উইকেট শিকারি এ বাঁহাতি স্পিনার। তৃতীয়দিন বাংলাদেশ অলআউট হয়ে যাওয়ার পর ইংলিশরা ব্যাটিংয়ে নামার পরই সাকিবের ঘূর্ণি তোপের মুখে পড়ে। জো রুটকে এলবিডব্লিউ করে ১৫০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন সাকিব। এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি ৭৯ রানে ৫ উইকেট নিয়েছেন। এটি সাকিবের ক্যারিয়ারে ১৫তম বার ইনিংসে ৫ উইকেট শিকারের ঘটনা। ইনিংসে ১৫ উইকেট শিকারে তিনি ভারতের সাবেক বাঁহাতি বিষেন সিং বেদীকে (১৪ বার) পেছনে ফেলে ছুঁয়ে ফেলেছেন পাকিস্তানের কিংবদন্তি লেগস্পিনার আব্দুল কাদিরকে। সাকিব ইনিংসের দশম ওভারে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে ফিরিয়ে দেন রুটকে। হয়ে যান বিশ্বের ৯৯তম ক্রিকেটার হিসেবে ১৫০ টেস্ট উইকেটের মালিক। নিজের পরবর্তী ওভারে এসে আবার আঘাত হানেন সাকিব, এবার শিকার করলেন বেন ডাকেটকে। মধ্যাহ্ন বিরতির আগেই সাকিবের বিধ্বংসী বোলিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ইংলিশরা। মধ্যাহ্ন বিরতির পরই তিনি আবার হামলে পড়ে শিকার করেন মঈন আলিকে। ৬২ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে খাদে পড়ে যায় ইংল্যান্ড। এর মধ্যে সাকিবের শিকার ছিল ৩টি। তবে এরপর বেন স্টোকস ও জনি বেয়ারস্টো ১২৭ রানের জুটি গড়ে দলকে দারুণ ভিত দেন। ক্রমেই বিশাল লিড নেয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছিল তারা। কিন্তু বেয়ারস্টোকে বোল্ড করে দেন কামরুল ইসলাম রাব্বি। এরপর সাকিবের ম্যাজিক শুরু হয়ে যায় আবার। দারুণ সেট হয়ে যাওয়া স্টোকসকে এলবিডব্লিউ করার পর আদিল রশিদকেও একইভাবে শিকার করে ৫ উইকেট পূর্ণ করেন এ বাঁহাতি। ঢাকা টেস্টের পর সবমিলিয়ে এখন ১৫৯ উইকেট হয়েছে সাকিবের। টেস্ট ক্রিকেটে এক ইনিংসে ৫ উইকেটের বেশি উইকেট শিকারের ঘটনা এটি সাকিবের জন্য ১৫তম বার। বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় স্থানে আছেন সাবেক বাঁহাতি মোহাম্মদ রফিক ৭ বার ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করে। টেস্ট ইতিহাসে ৩৮তম বোলার হিসেবে ১৫ বার ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করলেন তিনি। আর স্পিনারদের তালিকায় মাত্র ১৬তম বোলার সাকিব। তবে ১৫ বার ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়ার ক্ষেত্রে সাকিব আরেকটি কীর্তি গড়েছেন। সাকিব ছাড়িয়ে গেছেন ৬৭ টেস্ট খেলা সাবেক ভারতীয় বাঁহাতি স্পিনার বিষেন সিং বেদীকে। তিনি ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ১৪ বার ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়ে। আর ছুঁয়ে ফেলেছেন কিংবদন্তি পাক লেগস্পিনার কাদিরকে। ৬৭ টেস্ট খেলা কাদির ১৫ বার ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেছেন। সাবেক পাক স্পিনার দানিশ কানেরিয়াও আছেন সাকিবের পাশাপাশি। তবে সাকিবের পেছনে পড়ে গেছেন সাকলাইন মুস্তাক (১৩ বার), স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল (১২), মুশতাক আহমেদ (১০), জিম লেকারদের (৯) মতো বিশ্ব খ্যাত স্পিনাররা। এদের সবাই ক্যারিয়ার শেষ করেছেন সাকিবের চেয়ে বেশি উইকেট নিয়ে। এভাবে এগিয়ে যেতে থাকলে সাকিব অচিরেই পেছনে ফেলবেন ভগবত চন্দ্রশেখর (১৬), রিচি বেনো (১৬), গ্রায়েম সোয়ান (১৭) ও ল্যান্স গিবসদের (১৮) মতো ভুবন খ্যান স্পিনারদেরও। টেস্ট ইতিহাসে সর্বাধিক উইকেট শিকারি শ্রীলঙ্কার মুত্তিয়া মুরলিধরণ সর্বাধিক ৬৭ বার ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করে সবার ওপরে। তবে ২৯ বছর বয়সী সাকিবের এখনও লম্বা সময় পড়ে আছে নিজের রেকর্ডগুলোকে আরও সমৃদ্ধশালী করার। যেমন ধারাবাহিক সেই সুযোগ তার থাকছেই।
×