ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের নায়ক হয়ে ওঠার নেপথ্যে;###;মোঃ মামুন রশীদ

মিরাজ ঝলকে গর্বিত জাতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২ নভেম্বর ২০১৬

মিরাজ ঝলকে গর্বিত জাতি

ধরণীর বুকে আকাশ থেকে খসে পড়া তারা। হঠাৎ উদয় হওয়া কোন ধূমকেতু নাকি উল্কা। যখন কোন বিপর্যয়ে সঙ্কটকাল তখন এক মহানায়কের আবির্ভাব যুগেযুগেই ঘটে এভাবে। মেহেদী মিরাজ কি তেমন কিছু? যেভাবে আবির্ভাব ঘটেছে তার বিশ্ব ক্রিকেটে সেটাকে হয় তো নাটক-সিনেমার আষাঢ়ে গল্প বলে কেউ মুখ বাঁকাতে পারে। অনেকে রূপকথার কোন কাহিনী মনে করে হেসে উড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু ২০-৩০ অক্টোবর যারা টিভি পর্দায় এবং চট্টগ্রাম ও মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামে থেকে ক্রিকেট পরাশক্তি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম বাংলাদেশ দলের ময়দানী লড়াই দেখেছেন তাদের অন্তত বিশ্বাস না করে উপায় নেই। অবশ্য, যে ইন্দ্রজালে মোহিত করেছেন ১৯ বছর বয়সী তরুণ মিরাজ সেটাকে অবিশ্বাস ছানাবড়া চোখে দেখেছেন সবাই। অনেকে হয় তো চিমটি কেটেছেন গায়ে ঘুমের ঘোরে কোন স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়েছেন কিনা। সেই ঘূর্ণি মূর্চ্ছনাটায় দিকভ্রান্ত আর দিশেহারা হয়ে কুপোকাত হলো মহাপরাক্রমশালী ক্রিকেট শক্তি ইংল্যান্ড। যাদের হাত ধরেই বিশ্ব ক্রিকেটের যাত্রা শুরু ১৮৭৭ সালে। যারা ১৩৯ বছর ধরেই টেস্ট ক্রিকেট খেলছে। মাত্র ১৬ বছর ধরে টেস্ট খেলা বাংলাদেশকে তাদের বিপক্ষে জয় এনে দিয়েছেন মিরাজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে। যেন বিশ্ব ক্রিকেটে এক মহানায়কের আগমণ ঘটল। নায়কের বিরল কীর্তিমাখা কার্যাবলীর জন্যই ইতিহাস লেখা হয়। দুর্বিনীত মীরাজের যে একক ইতিহাস এখান থেকেই রচিত হলো। দুই টেস্টে ধ্বংসলীলা চালিয়ে ইংল্যান্ড শিবিরকে করেছেন বধ্যভূমি! সবমিলিয়ে নিয়েছেন ১৯ উইকেট। অভিষেক হওয়ার পর দুই টেস্টের সিরিজে ১৯ উইকেট কেউ নিতে পারেননি। ১৮৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বাঁহাতি পেসার জন জেমস ফেরিস দুই টেস্টের সিরিজে অভিষেক হওয়ার পর ১৮ উইকেট নিয়েছিলেন। ১২৯ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে দেয়া মিরাজ এখন সেদিক থেকে বিশ্বরের্ডধারী। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টে ভারতীয় লেগস্পিনার নরেন্দ্র হিরওয়ানির পর তিনবার ৬ উইকেট বা তার বেশি আর কোন বোলার নিতে পারেননি। কোন অফস্পিনারের এমন কীর্তি গড়ার রেকর্ড নেই। তার আগে ৫ বোলার শুধু ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টে তিনবার ইনিংসে ৫ বার বেশি উইকেট নিতে পেরেছিলেন যারা কেউ অফস্পিনার ছিলেন না। এক ম্যাচে ১২ উইকেট অভিষেকে নিতে পারেনি কোন বাংলাদেশী। এনামুল হক জুনিয়র ২০০ রান দিয়ে ১২ উইকেট নিয়েছিলেন ২০০৫ সালে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে। ১৫৯ রানে ১২ উইকেট নিয়ে এখন টেস্টে ম্যাচসেরা বোলিংয়ের বাংলাদেশী রেকর্ড মীরাজের। দুই ম্যাচের সিরিজে এর আগে এনামুল ও সাকিব ১৮ উইকেট করে নিয়েছিলেন; মিরাজ সেটাও ছাড়িয়ে গেছেন ১৯ উইকেট নিয়ে। সবচেয়ে কম বয়সে অভিষেক বোলিং নৈপুণ্যে বাংলাদেশের সেরা তিনি। এসব অনেক বর্ণিল রেকর্ডে রঙ্গিন করেছেন নিজেকে মিরাজ। সবচেয়ে বড় উপহারটা দিয়েছেন পুরো বাংলাদেশকে- জয়! তবে এমনটা হয় তো দেশের মাটিতে স্পিন আনুকূল্যের উইকেটে সম্ভব হয়েছে। বিদেশের মাটিতে সম্ভব হবে না। সেটা বুঝতে পারছেন তরুণ মিরাজও। তিনি নিজেই বললেন, ‘এই উইকেটে যেভাবে বল করেছি, উইকেট একটু সাহায্য করেছে। এখানে পাঁচ-ছয়টা করে উইকেট পেয়েছি বাইরের দেশে এভাবে নাও পেতে পারি। আমাকে আরও মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে। আরও ভাল করে অনুশীলন করতে হবে। আমরা যেন দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারি যেকোন কন্ডিশনে। আমার লক্ষ্য ধারাবাহিকভাবে পারফর্মেন্স করা।’ দেশের টেস্ট ক্রিকেটে অনেক নতুন ইতিহাস যেমন গড়েছেন, তেমনি বিশ্ব ক্রিকেটের অনেক ইতিহাসই উল্টে-পাল্টে নতুন করে লিখতে হয়েছে। ডানহাতি অফস্পিনার হিসেবে ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টে তিন ইনিংসে ৫ বা তার বেশি উইকেট নিয়ে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। সেই কারণে রকেটের গতিতে তিনি আইসিসি টেস্ট বোলিং র‌্যাঙ্কিংয়ে স্থান করে নিয়েছেন ৩৩ নম্বরে। বিরল এমন অনেক কৃতিত্বের জন্ম দেয়া মীরাজের উঠে আসার গল্পটা কিন্তু এত মসৃণ নয়। অনেক বিড়ম্বনার মধ্যে দিয়ে নিজের সামর্থ্যটাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন যে তিনি হয়ে গেছেন বাংলাদেশের মহানায়ক। মিরাজ ঐতিহাসিক টেস্ট বিজয়ের পরদিনই বীরবেশে বাড়ি ফিরেছেন। যে বাড়িতে ছোট থেকে ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পেছনে ছিল অনেক ত্যাগ এবং ঘাত-প্রতিঘাত, প্রতিকূলতার চমকপ্রদ কিছু গল্প। মিরাজ শুরুটা মাত্র ৮ বছর বয়সে করেছিলেন। ক্রিকেট খেলার জন্য পরিবারের সমর্থন দূরে থাক, মার খেয়েছেন দরিদ্র বাবার হাতে। কারণ বাবা জালাল হোসেন অটোরিক্সা ড্রাইভার। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে পড়াশুনা করে চাকরি করে সংসারের অভাব-অনটন দূর করবে। সেই ছোট্ট মিরাজ কিনা ক্রিকেট খেলা নিয়ে মেতে থাকে, পড়াশুনা বাদ দিয়ে। এ কারণে খেলার সময় মারতে মারতে বাড়িতেও নিয়ে গেছেন বাবা। তার বাবা জালাল জানিয়েছেন, ১৯৯৫ সালের দিকে তিনি কাজের সূত্রে আসেন খুলনায়। তার পৈত্রিক বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার আউলিয়াপুর গ্রামের ‘তালুকদার বাড়ি’। ১৯৯৭ সালের শেষদিকে বরিশালের নিজ গ্রামেই মিরাজের জন্ম। এরপর ২০০১ সালে পরিবারের সঙ্গে খুলনায় আসেন তিনি। এখান থেকেই মীরাজের ক্রিকেট যাত্রা শুরু। মিরাজ খালিশপুর নয়াবাটি হাজী শরিয়তুল্লাহ বিদ্যাপীঠের ছাত্র ছিলেন। সেখান থেকে এসএসসির পর এইচএসসি শেষ করেন দৌলতপুর ডে-নাইট কলেজ থেকে। কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমি কোচ মোঃ আল মাহমুদ বলেন, ‘৮ বছর বয়সে মীরাজের ক্রিকেট খেলা শুরু। মিরাজের সাফল্যে খুব ভাল লাগছে। আমার ছাত্র এখন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলছে। মিরাজ খেলতে যাওয়ার আগে যা প্রত্যাশা করেছিল, খেলায় তা করে দেখিয়েছে।’ এলাকার এক বড় ভাইয়ের কাছে অনুরোধ করে জায়গা করে নিয়েছিলেন মিরাজ এই ক্রিকেট একডেমিতে। তবে অটোরিক্সাচালক বাবার পক্ষে একাডেমির খরচ বহন করা সম্ভব ছিল না। পুরো ঘটনা খুলে বললেন কোচকে। কোচই নিলেন তাকে ক্রিকেট খেলানোর দায়িত্ব। এভাবেই শুরু হয়ে গেলে মীরাজের হাতেখড়ি। তারপর অনুর্ধ ১৪ জাতীয় বিভাগীয় প্রতিযোগিতায় সেরা ব্যাটসম্যান হন মিরাজ। প্রাইজমানি হিসেবে পান ২৫ হাজার টাকা। সেবার মীরাজের সঙ্গে তার বাবাও ছিলেন স্টেডিয়ামে। ম্যাচ শেষে কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘খেলে যা। একদিন তোকে জাতীয় দলে খেলতে হবে।’ মূলত জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নের শুরু এখান থেকেই। এরপর ২০১০ সালে যখন আইসিসি সভাপতি ডেভিড মরগান তার হাতে সেরা খেলোয়াড়রের পুরস্কার তুলে দেন তখনি অনেকজন তাকে আগামীর তারকা ভাবা শুরু করে। এরপর অনুর্ধ ১৯ দলের হয়ে দারুণ পারফর্ম করে টানা দুই বিশ্বকাপে তিনি বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেন এবং বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী তিনি যা এখনও বিদ্যমান। তিনি একজন অলরাউন্ডার! সাকিবের পর খুঁজে পাওয়া আরেকটা নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডার হিসেবে ব্যাটে-বলে সমান নৈপুণ্য দেখাতে ওস্তাদ! এবার ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজে দেখা যায়নি সেটা। প্রতিপক্ষরা তাকে চিনে গেছে স্পেশালিস্ট অফস্পিনার হিসেবে। অথচ, ব্যাট হাতেও দারুণ পারফর্মার মিরাজ। ব্যাটিংয়ে অনুসরণ, অনুকরণ সবই করেন টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমকে। কিন্তু দুই টেস্টের চার ইনিংসে তার ব্যাট থেকে এসেছে ১, ১, ১ ও ২ রান। অথচ যুব বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে ২৪২ রান করেছিলেন ১২ উইকেট শিকারের পাশাপাশি। দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা এবং ক্রিকেটাররা জানেন দারুণ ব্যাটসম্যান মিরাজ। এ বিষয়ে মুশফিকও বলেছেন, ‘ওর ব্যাটিংয়েও অনেক বৈচিত্র্য আছে। মিরাজ তার ব্যাটিং দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সামনে অনেক রেকর্ড রেখে যাবে যা ভাঙ্গতে অনেক কষ্ট হবে।’ হয় তো ভবিষ্যতে ব্যাটসম্যান মিরাজকেও দেখা যাবে। এ কারণেই ক্রিকেটবোদ্ধারা বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার সাকিবের ছায়া খুঁজে পান মীরাজের মধ্যে। মিরপুর টেস্টের প্রথম ইনিংসেও ৮২ রানে ৬ উইকেট নেয়ার পর তিনি ইংলিশ শিবিরের জন্য হয়ে উঠেছিলেন বিভীষিকার নামান্তর। সেটাকে পুঁজি করে দুর্দান্ত বোলিং করে ঝলসে উঠলেন মিরাজ। আতঙ্কের নীল বীজ বুনে দিলেন ব্যাটসম্যানদের বুকে। একে একে মীরাজের ঘূর্ণিতে কুপোকাত হলেন গ্যারি ব্যালান্স, মঈন আলী, কুক, জনি বেয়ারস্টো ও স্টিভেন ফিন। সাকিবকে সঙ্গে নিয়ে মুড়িয়ে দিলেন চলতি সিরিজে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বিরক্তিকর টেলএন্ডটাকেও। সব প্রতিরোধ ধসিয়ে দিয়ে এভাবেই দলের ঐতিহাসিক এক বিজয় রচনার মহাবীর হয়ে গেলেন। এবার নিলেন ৭৭ রানে ৬ উইকেট। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টের তিন ইনিংসে ৫ উইকেট করে শিকারের ঘটনা মাত্র এর আগে আর ৫টি। প্রথমটি করেছিলেন ইংল্যান্ডের ফাস্ট বোলার টম রিচার্ডসন। ১৮৯৩ সালের আগস্টে অভিষেকে ৪৯ রানে ৫ ও ১০৭ রানে ৫ উইকেট শিকারের পরবর্তী বছর নিজের দ্বিতীয় টেস্টে নেন ১৮১ রানে ৫ ও ২৭ রানে ১ উইকেট। ১৯০১ সালে আরেক ইংলিশ পেসার সিডনি বার্নস, ১৯২৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার লেগব্রেক গুগলি বোলার গ্রিমেট, ১৯৭৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান পেসার রডনি হগ ও ১৯৮৮ সালে ভারতের লেগস্পিনার নরেন্দ্র হিরওয়ানি এই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তবে কোন অফস্পিনারের এমন কীর্তি গড়ার ঘটনা টেস্ট ইতিহাসে এটিই প্রথম। ক্যারিয়ারের দুই টেস্ট খেলেই দেশসেরা হয়ে যাওয়া মিরাজ তাই অফস্পিনার হিসেবে বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী। আর এ বিস্ময়-বালককে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়েছে বিশ্ব! আর সবচেয়ে বড় উপহারটা দিয়েছেন পুরো বাংলাদেশকে- ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক প্রথম টেস্ট বিজয়! বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটের জন্যই এক জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের নাম মিরাজ!
×