ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোকসানা বেগম

সাদা পোশাকে রঙিন ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২ নভেম্বর ২০১৬

সাদা পোশাকে রঙিন ইতিহাস

জিম্বাবুইয়েকে প্রথমবারের মতো হারিয়ে সে কী উল্লাস হয়েছে। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও হারানো গেছে। তবে দুটি দলকে হারিয়ে যে আনন্দ উপভোগ করা বাকি ছিল, ইংল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো হারিয়ে সেই আনন্দ উপভোগ করল পুরো দেশবাসী। প্রথমবারের মতো কোন পূর্ণশক্তির দলকে যে হারানো গেল। সেই দলটি আবার ইংল্যান্ড। বাংলাদেশে একটু বাজেভাবে হারলেই যে দেশের ক্রিকেট বিশ্লেষকরা সবচেয়ে বেশি সমালোচনায় মুখর থাকতেন। তাদের মোখ্যম জবাব দেয়া গেছে। তিনদিনেই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। আর তাতে করে সাদা পোশাকে রঙিন ইতিহাসও গড়া হয়ে গেল। প্রথম টেস্টেও জিততে পারতো বাংলাদেশ। কিন্তু ২২ রানে হারে। শেষ মুহূর্তে গিয়ে তীরে এসে তরী ডোবে। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে আর সেই ভুল হয়নি। ১০৮ রানের বড় ব্যবধানেই জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। ২০০৩, ২০০৫ ও ২০১০ সালে দুইবার দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হারলেও, এবার আর হারেনি বাংলাদেশ। দল যে শুধু ওয়ানডেতেই নয়, টেস্টেও বদলে যাচ্ছে; সেই আলামতই কী মিলছে না! অবশ্য প্রথম টেস্টে জয় না পাওয়ার আফসোসও থাকছে এরসঙ্গে। প্রধান কোচ চন্দিকা হাতুরাসিংহেই যেমন বলেছেন, ‘আমরা ২-০তে জিততে পারতাম।’ তাই বলে ১-১ ব্যবধানে সিরিজ শেষ হওয়ায় হতাশার কোন সুযোগ নেই। তাই হাতুরাসিংহে বলেছেন, ‘তা সম্ভবও (দুই টেস্টেই জেতা) ছিল। হতে পারতো। আমি আশাবাদী ছিলাম। আমি মনে করি, আমরা ভাল করেছি। আপনার যদি অনেক অভিজ্ঞতা থাকে, টেস্টে অনেক ম্যাচ খেলেন, ২-০তে জিততে পারতাম। টেস্টে এটা বলা কঠিন যদিও। কিছু অবস্থায় কিভাবে জিততে হয় আমরা জানি না। এখন আমরা জেনেছি অনেক কিছু, আমরা অনেক আত্মবিশ্বাসী এসব অবস্থায় ম্যাচ জেতার ক্ষেত্রে। আমি খুশি।’ একটি টেস্ট যে জেতা গেছে, সেটিই অনেক বড় পাওনা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ আরও ৭ টেস্ট জিতেছে। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৫টি ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুইটি। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ২০০৫ সালে যে জিতেছে, সেটি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেরই প্রথম টেস্ট জয়। সেই সঙ্গে প্রথম সিরিজ জয়ও এসেছিল। এরপর জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে আরও চারবার জেতা গেছে। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হারিয়েছে বাংলাদেশ। সেটি বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়। দুটিতেই আনন্দ হয়েছে। উৎসব হয়েছে। তবে মনের প্রশান্তি এনে দেয়া আনন্দ যেন মনের ভেতরেই লুকানো ছিল। যেটি হলো এবার, ইংলিশদের কুপোকাত করার পর। সবার মুখেই তাই একই বাণী, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা জয় এটি।’ বাংলাদেশ টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম যেমন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের পর বলেছেন, ‘আসলে কোনকিছু স্বপ্ন না থাকলে সেটা বাস্তব করা কঠিন। সত্যি বলতে আমাদের পরিকল্পনা, ইংল্যান্ডে আসার আগে যখন আমরা জেনেছি ইংল্যান্ড আসবে তখন থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম যে এমন উইকেট বানাব সেটা যেন তিন থেকে চারদিনের হয়। যে উইকেটে আমাদের স্পিনাররা অনেক হেল্প পাবে এবং ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের অনেক সমস্যা হবে। তো আমরা চট্টগ্রাম টেস্টে অনেক ভাল খেলেছি। তবে সত্যি বলতে আমি অনেক সারপ্রাইজ হয়েছি যে উইকেটটাতে আমরা দুটি দলই পাঁচদিন ধরে অনেক ফাইট করেছি। ওটা যে উইকেট ছিল তিন বা সাড়ে তিনদিনের বেশি হয় তো চারদিন যাওয়ার কথা ছিল না। সেদিক থেকে বলব আমাদের টিম ম্যানেজমেন্ট বা আমাদের খেলোয়াড় বলেন যে পরিকল্পনা ছিল সেটা এক্সিকিউট করেছে আমাদের বোলাররা এবং আমাদের ব্যাটসম্যানরা, অনেক ভাল খেলেছে এবং সে জন্যই এটা হয়েছে। অবশ্যই ভাল লাগছে। অনেক সাধনার পর কোন একটা জিনিস পাওয়া গেলে অবশ্যই ভাল লাগে। আর এটাও তার ব্যতিক্রম কিছু না। আমি বলব এটা পূর্বপরিকল্পিতই ছিল যে আমরা অবস্থা তৈরি করব। আর শেষ টেস্ট খেলার পর যেটা বলেছিলাম যে এই ম্যাচে আমরা যদি এমন একটি অবস্থা তৈরি করতে পারি যেটা জয়ের সেখান থেকে যেন না ছাড়ি। আল্লাহর রহমতে সেটা হয়েছে সেজন্য নিজেদের কাছে অনেক ভাল লাগছে।’ সঙ্গে মুশফিক আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় অর্জন।’ বিশ্ব গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়টি নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ‘ইংল্যান্ডের ধসে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয় সিরিজ ড্র।’ দ্য টেলিগ্রাফ লিখেছে, সেরা একটি মুহূর্ত বাংলাদেশের। দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট তাদের প্রধান সংবাদের শিরোনাম করেছে, ‘ধসে পড়লো ইংল্যান্ড ঃ বাংলাদেশের জয়। ডেইলি মেইল লিখেছে, ‘বাংলাদেশের কাছে ইংল্যান্ডের বিপজ্জনক হার।’ তাদের আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘অনভিজ্ঞ মেহেদী হাসানের সামনে ভেঙে পড়লো ইংল্যান্ডের টপ অর্ডার। প্রকাশ পেল স্পিনের বিপক্ষে তাদের দুর্বলতা আর বাংলাদেশ জিতলো ঐতিহাসিক টেস্ট।’ বিবিসি লিখেছে, ‘ইংল্যান্ড ধসে ঐতিহাসিক জয় তুলে নিল বাংলাদেশ।’ ‘ডেইলি এক্সপ্রেস’ তো শুধু বাংলাদেশ নিয়ে পড়ে থাকেনি, ইংলিশদের আসন্ন ভারত সফরের বিষয়টিও এনেছে তাদের প্রতিবেদনে, ‘এই জয়ে বাংলাদেশ ১-১ ব্যবধানে সিরিজ শেষ করল। আর একইসঙ্গে ভারত সফরের আগে ইংল্যান্ডের কপালে এঁকে দিল বড় এক প্রশ্নÑ উপমহাদেশের কন্ডিশনে খেলতে তারা কতটা পারদর্শী?’ এদিকে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব ওয়েবসাইট শিরোনাম করেছে, ‘বাংলাদেশের জয়ে ক্রিকেটের বিজয়।’ দেশটির আরেক সংবাদ মাধ্যম ফক্স স্পোর্টস লিখেছে, ‘ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো জয়ে সিরিজে সমতা বাংলাদেশের।’ এছাড়াও সিডনি মর্নিং হেরাল্ড লিখেছে, ‘টেস্ট ম্যাচে নাকাল হলো ইংল্যান্ড।’ এছাড়াও ভারতীয় গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস শিরোনামে করেছে, ‘১০৮ রানের জয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম বিজয়।’ দেশটির অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভি লিখেছে, ‘মেহেদি হাসানের দুর্দান্ত পারফর্মে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়।’ মেট্রো লিখেছে, ‘ইংল্যান্ডের ধসে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়।’ জিম্বাবুইয়ে আর খর্বশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই দু’দল বাদে আর কোন দলের বিপক্ষেই এতদিন বাংলাদেশের টেস্ট জয়ের রেকর্ড ছিল না। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এসে পূরণ হলো সেই অধরা স্বপ্ন। মাত্র তিনদিনের মধ্যেই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ। জয়ের ব্যবধানটা ১০৮ রানের। বাংলাদেশের ২৭৩ রানের লক্ষ্য ঠিক করে দেয়ার পর ১৬৪ রানে অলআউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড। ফলে ১-১ সমতায় থেকেই শেষ হলো দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ। এখন অবশ্য বাংলাদেশের কাছ থেকে প্রত্যাশা বেড়ে গেল। এখন শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বাংলাদেশকে ভাল কিছু করে দেখাতে হবে। ইংল্যান্ড অলরাউন্ডার ইয়ান বোথামই যেমন মনে করছেন, ‘এই জয় অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য বিশেষ কিছু। তবে এখন তাদের বিদেশের মাটিতে জিতে দেখাতে হবে। এই মুহূর্তে এটাই বাংলাদেশের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। ঢাকা টেস্টের উইকেট ছিল বাংলাদেশের উপযোগী করে তৈরি করা। এটি পুরোপুরি স্পিনবান্ধব উইকেট। যখন কোন টেস্ট ম্যাচে স্পিনাররা বোলিং সূচনা করে, তখনই বোঝা যায় গোটা টেস্ট ম্যাচে কী অপেক্ষা করে আছে।’ বোথামের কোন কথাই এখন কারও কানে বাজবে না। বাজার কথাও না। কারণ এখন যে কয়েকটা দিন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের আনন্দ করার পালা। সেই আনন্দে কারও কোন কথাই কানে দেয়ার সময় নেই। যা হওয়ার সময়ই বলে দেবে। এখন সাদা পোশাকে রঙিন ইতিহাস হয়েছে। উৎসবটাও রঙিন।
×