ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিজে অভিযুক্ত হলেও তিন পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন

রাজাকার পুত্র ইউসুফের খুঁটির জোর কোথায়-

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২ নভেম্বর ২০১৬

রাজাকার পুত্র ইউসুফের খুঁটির জোর কোথায়-

মিজানুর রহমান ও কবির হোসেন, সাতক্ষীরা থেকে ॥ মাওলানা আবু তাহের জিয়া উদ্দিন মোঃ ইউসুফ। যশোরের কেশবপুর উপজেলার ৯ নং গৌরিঘোনা ইউনিয়নের আগরহাটি ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। এলাকায় তাহের নামে পরিচিত। ’৭১-এর রাজাকার কমান্ডার আব্দুল বারী ওয়াদুদির বড় ছেলে এই ইউসুফ। সাতক্ষীরার বাঁশদহা আলহাজ মোহাম্মদ আলী দাখিল মাদ্রাসার সাসপেন্ড হওয়া শিক্ষক। দীর্ঘ দুই বছর ধরে মাদ্রাসার খাতায় নিখোঁজ রয়েছেন। নিখোঁজ সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় এই ইউসুফ সোমবার জনকণ্ঠসহ তিনটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকের নামে যশোরের আদালতে মামলা করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মাদ্রাসায় অনুপস্থিত থাকায় তিন দফায় মাদ্রাসায় অনুপস্থিত থাকার সুস্পষ্ট জবাব চেয়ে প্রতিষ্ঠানে যোগদানের নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু তারপরও তিনি প্রতিষ্ঠানে যোগদান বা উপস্থিত হননি। এরই জের ধরে গত ১৮ আগস্ট মাদ্রাসার সুপার মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এই ইউসুফের নিখোঁজের বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন। অভিযোগে বলা হয়, দুটি দৈনিকে তার নিখোঁজের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও তিনি মাদ্রাসায় হাজির বা যোগদান করেননি। অভিযোগ, মাদ্রাসায় চাকরি করাকালে তিনি এসেম্বলি করার সময় জাতীয় সঙ্গীত গাইতেন না। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া বেদাত বলে তিনি ফরমান জারি করেন। মাদ্রাসা সুপারের লিখিত অভিযোগ, মাওলানা ইউসুফের মাদ্রাসায় চলাফেরা রাষ্ট্রবিরোধী ও জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে কিনা এ বিষয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সন্দেহ রয়েছে। দেশজুড়ে নিখোঁজদের তালিকা করার সময় এই মাওলানা ইউসুফের নিখোঁজের বিষয়টি প্রকাশ পায়। এরই জের ধরে গত ২৪ আগস্ট দৈনিক জনকণ্ঠসহ সাতক্ষীরার স্থানীয় দৈনিকসহ খুলনা ও যশোর থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিকে এই মাদ্রাসা শিক্ষকের নিখোঁজের খবরটি ছাপা হয়। প্রকাশিত খবরের কোথাও তার জঙ্গী সম্পৃক্ততা বা পলাতক থাকার বিষয় উল্লেখ না থাকলেও প্রকাশিত এই নিখোঁজের খবরে তার মানহানি হয়েছে এবং তাকে জঙ্গী সাজানোর হীন উদ্দেশে এই খবর করেছেন বিবাদীগণ এই অভিযোগ এনে ইউসুফ সোমবার যশোরের কেশবপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালতে জনকণ্ঠসহ তিনটি পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশকসহ ৬ জনকে বিবাদী করে মানহানির মামলা দায়ের করেছেন। মামলার আরজিতে ইউসুফ নিজেকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও সাতক্ষীরার মাদ্রাসা শিক্ষক হিসেবে নিজেকে দাবি করেছেন। আদালত মামলাটি তদন্ত করে রিপোর্ট দেয়ার জন্য যশোরের পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন। মামলায় খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সময়ের খবরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী মোতাহার হোসেন, প্রকাশক এসএম রিয়াজ মাহমুদকে প্রথম ও দ্বিতীয় বিবাদী, জনকণ্ঠ সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক মোঃ আতিকুল্লাহ খান মাসুদ, উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান ও স্বদেশ রায়কে তৃতীয়, ৪র্থ ও ৫ম বিবাদী এবং যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক যশোর পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক জাহিদ হাসান টুকুনকে ৬ নং বিবাদী করে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। মঙ্গলবার সরেজমিনে বাঁশদহা আলহাজ মোহাম্মাদ আলী দাখিল মাদ্রাসা ও কেশবপুরের আগরহাটি গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা যায় এই ইউসুফের নানা তথ্য। ওই শিক্ষক ২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরের পর থেকে মাদ্রাসায় আসেননি। দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকার কারণে নোটিস প্রদানের পরও কোন খবর না পেয়ে ২০১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি সাতক্ষীরা থেকে প্রকাশিত দৈনিক কাফেলা ও ওই একই বছরের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক খবরপত্র পত্রিকায় চূড়ান্ত নোটিস প্রদান করা হয়। এরপর গত ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক এটিজেডএম ইউসুফের বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে অভিযোগ দেয়া হয়। কিন্তু তিনি ওই শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে হাজির হনননি বলে অভিযোগ। পরে এটিজেডএম ইউসুফের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতে না পেরে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর একটি প্রতিবেদন জমা দেন উপজেলা শিক্ষা অফিসার জয়নাল আবেদিন। উক্ত মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার মোহাম্মাদ রিয়াজুল ইসলাম মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে বলেন, তিন দফা নোটিস ডাকযোগে তার বাড়িতে পাঠানো হলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। পক্ষান্তরে মাদ্রাসার সুপার, সভাপতিসহ পরিচালনা বোর্ডের ১২ জনের নামে ইউসুফ একই আদালতে ৭ ধারার একটি অভিযোগ দায়ের করেন এবং কেশবপুর থানায় তাদের বিরুদ্ধে তার বাড়িতে হামলা ভাংচুরের অভিযোগ এনে পৃথক মামলা দায়ের করেন। অথচ তদন্তের সময় তিনি হাজির না হওয়ায় মামলাগুলো খারিজ হয়ে যায়। ভারপ্রাপ্ত সুপার জানান, তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মাদ্রাসা বোর্ডকে লেখা হয়েছে। তিনি জানান এই ইউসুফের বিরুদ্ধে কেশবপুর থানায় নারী নির্যাতন মামলার ওয়ারেন্ট রয়েছে বলে পুলিশ তাদের জানিয়েছে। এদিকে এই ইউসুফ ওরফে তাহেরের গ্রামে গিয়ে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মাওলানা আবু তাহের জিয়া উদ্দিন মোঃ ইউসুফ ’৭১-এর রাজাকার কমান্ডার আব্দুল বারী ওয়াদুদির বড় ছেলে। সাতক্ষীরার একটি মাদ্রাসায় তিনি চাকরি করতেন বলে এলাকাবাসী জানতেন। এলাকায় একজন খারাপ মানুষ হিসেবে তিনি পরিচিত। গৌরিঘোনা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি এসএম আলী রেজা জানান, ইউসুফ খারাপ চরিত্রের লোক। তার বাবা রাজাকার। সে কোন দল করে না। সদ্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব জানান, ইউসুফের বউ ও মেয়ের সঙ্গে বনিবনা নেই। বউ ও একমাত্র মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। সে বাড়ির জমি বিক্রি করে দিয়েছে। আগরহাটি সরকারী আশ্রয়ণ কেন্দ্রের গুচ্ছ গ্রামে তার থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেয়া হলেও সেখান থেকেও সে চলে গেছে। বর্তমানে যশোরের কোন এক মসজিদে ইমামের কাজ করে বলে তারা শুনেছেন। তিনি বলেন, আগরহাটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের লোক কম থাকায় এবং সাতক্ষীরার একটি সুপারিশপত্রে তাকে ওই ওয়ার্ডের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য ও ইউসুফের বাড়ির পাশের বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম জানান, ইউসুফ এলাকায় তাহের নামে পরিচিত। সে সাতক্ষীরার একটি মাদ্রাসায় চাকরি করত। সেখানে এক নারী ঘটিত কেলেঙ্কারিতে ইউসুফকে ওই মাদ্রাসা থেকে বিতাড়িত করা হয়। তখন এলাকায় ফিরে আসে এবং বাড়িতে যে বউ ও মেয়ে ছিল তাদের সঙ্গে বিবাদ বাঁধে। সাতক্ষীরার ওই মেয়েকে কেন্দ্র করে বাড়ির বউ ও মেয়ে চলে যায়। গত বছর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের সময় সে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটিতে নাম লেখায়। কিন্তু সে সক্রিয়ভাবে দল করে না। এরপর সে বাড়িতে তার অংশের জমি বিক্রি করে যশোরে চলে যায়। সেখানে এক মসজিদে বর্তমান ইমামের দায়িত্ব পালন করছে। এখন ইউসুফ এলাকায়ও আসে না। রেজাউল ইসলাম আরও জানান, ’৭১ সালে ইউসুফের পিতা আব্দুল বারী ওয়াদুদি গৌরিঘোনা রাজাকার কমান্ডার ছিল। অনেক আওয়ামী লীগ পরিবারের লোককে রাজকার ওয়াদুদি হত্যা করে। তার মধ্যে ভায়না গ্রামের নকুল শেখ, ইসমাইল, সারুটিয়া গ্রামের হাবিল, কাবিলসহ সেভেন মার্ডার করে তার পিতা। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে আব্দুল বারী ওয়াদুদি বর্তমান বাড়িতে অবস্থান করছে। এদিকে একটি সাধারণ নিখোঁজ সংবাদের জের ধরে বিতর্কিত এই রাজাকার পুত্রের পত্রিকা সম্পদকদের নামে মামলা করার নেপথ্যে করা কাজ করছে তাদের খুঁজে বের করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। পুলিশের খাতায় ওয়ারেন্ট থাকার পরও সে প্রকাশ্যে কিভাবে ঘুরে বেড়ায় এবং মাদ্রাসা সুপারের অভিযোগ অনুয়ায়ী তার আচরণ রাষ্ট্রবিরোধী ও সন্দেহজনক হওয়ার পরও কেন সে গ্রেফতার হয় না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।
×