ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিচার বিভাগে সরকার হস্তক্ষেপ করলে তাভেলা হত্যাকারী ও মাহমুদুর রহমান কি জামিন পেতেন?

’৭২-এর ১১৬ অনুচ্ছেদ বহাল হলে ৯৬ নয় কেন ॥ আইনমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২ নভেম্বর ২০১৬

’৭২-এর ১১৬ অনুচ্ছেদ বহাল হলে ৯৬ নয় কেন ॥ আইনমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দ্বৈত শাসনের ফলে বহু জেলায় শূন্যপদে সময়মতো বিচারক নিয়োগ প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। বিচারপ্রার্থী জনগণের ভোগান্তি বেড়ে যায়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল করে ১৯৭২-এর সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ ফেরানোর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার আহ্বানে বিস্ময় প্রকাশ করে এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কথা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দিবস উপলক্ষে সোমবার এক বাণীতে প্রধান বিচারপতির ওই আহ্বান আসার পর মঙ্গলবার আইন মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের প্রতিক্রিয়া জানান আনিসুল হক। প্রধান বিচারপতি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটি বাহাত্তরের সংবিধানে যেমন ছিল তেমনই করার বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিকে স্ববিরোধী বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদ বাহাত্তর সালের সংবিধানে যেতে পারলে ৯৬ অনুচ্ছেদ নয় কেন? নির্বাহী বিভাগ আদালতের বিচারিক কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না। সরকার মনে করে গণতন্ত্রের বিকাশ ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার খুব প্রয়োজন। মন্ত্রী বলেন, ‘অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে ওনার (প্রধান বিচারপতি) বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। সংবাদ সম্মেলনে আইন বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মোঃ জহিরুল হক দুলাল এবং লেজিসলেটিভ বিভাগের সচিব শহীদুল হক উপস্থিত ছিলেন। আইনমন্ত্রী তার বক্তব্যে একদিকে প্রধান বিচারপতির প্রস্তাবকে ‘স্ববিরোধী’ বলেন এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ বদলানোর ‘দরকার নেই’ বলে মত দেন। বক্তব্যের আরেক জায়গায় তিনিই আবার বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে সেটা করা যেতে পারে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, ২০১১ সালে যখন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ’৭২-এর চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনা হয়, তখন সংসদীয় কমিটির নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই সে সংশোধনীগুলো আসে। সে সময় বাহাত্তরের ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব কোনো পক্ষের কাছ থেকে সরকার পায়নি। প্রধান বিচারপতির বাণীর বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদ যেটা ১৯৭২ সালের ছিল, সেখানে ফিরে যাওয়ার কথা। ১১৬ অনুচ্ছেদ বদলালো কবে, ১৯৭৮-এ। সেটাকে এখনকার যে রূপ আছে। আপনারা জানেন ষোড়শ সংশোধনীতে অনুচ্ছেদ ৯৬-কে ১৯৭২’র সংবিধানে যা ছিল তা হুবহু করা হয়েছে। এখন ওনারা, দুটি ক্ষেত্রে সুগ্রীমকোর্টের বিচাপতিদের অপসারণ এবং রিমুভাল ফর ইন ক্যাপাসিটি অর মিস কনডাক্টস গ্রস মিসকনডাক্ট। দুটো কারণে তাদের রিমুভ করা যায়, এ আইনটা একদম ১৯৭২ সালে যা ছিল তা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সেটা হাইকোর্ট বাতিল করে দিয়েছে যে আলট্রা ভায়ার্স অব কনস্টিটিউশন। এটা এখন আপীল বিভাগে আপীল হিসেবে আছে। একদিকে বলা হচ্ছে যে ওইটা হিস্ট্রোরিক্যাল মিসটেকস, আবার বলা হচ্ছে যে ১১৬, বাহাত্তরে যা আছে তাতে ফিরে যেতে হবে। এটা তো স্ববিরোধী কথা। ১৯৭২ সালের সংবিধানে চেক এ্যান্ড ব্যালান্সের মেইনটেইন করার প্রভিশন ছিল জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সেই চেক এ্যান্ড ব্যালান্সের মেইনটেইন করা ইম্পর্টেন্ট। সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদে ফিরে যাওয়া উচিত কিনা- জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগের বিচারিক কাজের স্বাধীনতা হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিষয়। সংবিধানের ১১৬-ক অনুচ্ছেদ, বিচারিক স্বাধীনতার ব্যাপারে গ্যারান্টি। সেই জন্য ১১৬-ক থাকলে আমার মনে হয় না আর ১১৬ আর ১৯৭২ সালে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন আছে। তারপরও এ রকম দরজা বন্ধ হয়নি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় সংসদীয় কমিটিতে গেলেও ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব কোথাও থেকে যায়নি উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, আজকে যখন নতুন করে সবকিছু হয়ে গেছে তখন এ ধরনের প্রস্তাব আসাটা আমার কাছে একটু আশ্চর্য লাগছে। ‘কিন্তু যদি এমন হয় যে বিচার ব্যবস্থাকে আরও স্বাধীন করার জন্য, বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য যা যা করা দরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তাই করবে। ১১৬’র পরিবর্তন-সংশোধনের প্রয়োজন হলে সেটাও করা হবে। রাষ্ট্রপতির হয়ে আইন মন্ত্রণালয় বদলি, পদোন্নতি করছে- এমন অভিযোগের বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, অন্ততপক্ষে দুই-আড়াই বছরে পরিষ্কার বলতে পারি, আমি সুপ্রীমকোর্টের সব সুপারিশ মানার চেষ্টা ও বাস্তবায়নের চেষ্টা করি। আইনমন্ত্রী বলেন, বিচারিক কার্যক্রম, ১১৬ এই গুরুদায়িত্ব দিয়েছে আমাকে? আমাকে মন্ত্রী হিসেবে তো করেনি। এটা করেছে রাষ্ট্রপতিকে, রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন হেড অব দ্য স্টেটস এবং জুডিশিয়ারিতে এ্যাপানমেন্ট, প্রমোশন, ট্রান্সফার এবং রিমুভাল- এগুলো কোন ব্যক্তি বা কোন গোষ্ঠীর কারণে যেন একটা বিচারককে রিমুভ করা না যায় বা তাকে অসুবিধায় না ফেলা যায় সেটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। সেই জন্যই রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তিকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনিই সব বিচার করার পরে তাদের সরানো যাবে কি না, তাদের দোষ সবকিছু দেখে তারপর তিনি স্বাক্ষর করবেন- এই জিনিসটা তাকে দেয়া হয়েছে। এবং সেটা সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ সাপেক্ষেই। ‘আমার মনে হয় না, রাষ্ট্রপতি এখন পর্যন্ত এমন কাউকে রিমুভ করেছেন যেখানে সুপ্রীমকোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করা হয় নাই। তাহলে আজকে এ প্রশ্ন কেন এলো?’ আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ২০০৭ সালের ১ নবেম্বর মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণের কাজ শুরু হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা পরিষ্কার বলা আছে। চেক এ্যান্ড ব্যালেন্সের মাধ্যমে সেটি মেইনটেইনও করা হচ্ছিল। কিন্তু মাঝপথে সামরিক সরকার ক্ষমতায় এসে বিচার বিভাগের চলমান গতিশীল পথকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সে জঞ্জাল অপসারিত করেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী না হওয়ায় সেই উদ্যোগ আবারও বাধাগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন জেলায় অবকাঠামো উন্নয়ন ও নতুন নতুন বিচারকের পদ সৃষ্টি করে মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকারকে ত্বরান্বিত করেছে। সেই কাজ এখনও অব্যাহত আছে। বিচার প্রক্রিয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিচার বিভাগের গতিশীলতা আনতে সব কাজই করবে। কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। এটি অব্যাহত থাকবে। সরকারের পক্ষ থেকে আমি বলতে চাই বিজ্ঞ বিচার বিভাগের কাজের সরকার কখনই হস্তক্ষেপ করবে না। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘তাভেলা সিজার হত্যা মামলার আসামিকে নিম্ন আদালত জামিন দেয়নি। কিন্তু উচ্চ আদালত জামিন দিয়েছেন। মাহমুদুর রহমানও জামিন পেয়েছেন। সরকার যদি হস্তক্ষেপ করত তাহলে এই স্বাধীনতা কি থাকত বিচার বিভাগের?’ ‘নির্বাহী বিভাগ আদালতের বিচারিক কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না। সরকার মনে করে গণতন্ত্রের বিকাশ ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার খুব প্রয়োজন।’ আইনমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগের বিচারকসহ অন্যদের বদলি, পদোন্নতি, অপসারণ এগুলোর গুরুদায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর। রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তিকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় এখানে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও সুপ্রীমকোর্টের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করে। সুপ্রীমকোর্ট কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, সুপ্রীমকোর্ট সারাদেশের জনগণের, সুপ্রীমকোর্ট একটা ইনস্টিটিউশন, যে বিচার করে এবং মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। এটার ব্যাপারে আমি কথা বলার ক্ষেত্রে যেমন সাবধানতা অবলম্বন করি, সেটার ব্যাপারে কাজ করতেও অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করি। নতুন করে সংশোধনের প্রশ্নের পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই বলেও দাবি করেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, হয়ত কাজ করতে গিয়ে অনেকের চিন্তাভাবনার আসতে পারে। প্রধান বিচারপতি যেটা বলেছেন তার প্রধান প্রিন্সিপাল হচ্ছে মামলার জট নিরসনে ব্যবস্থা করা। আমি তার সঙ্গে সেই দিকে মামলার জট নিরসনের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে একমত। বিভিন্ন স্তরে বিচারকের ৯৫৫টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ৬৫৭ পদ পূর্ণ এবং ২৯৮ পদ শূন্য রয়েছে। এসব শূন্য পদগুলোতে নিয়োগের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের নবম পরীক্ষায় ১০০ জন সহকারী জজকে নিয়োগের জন্য সুপারিশের আজকে ফাইল এসেছে। আজকে পাস করব। এছাড়া দুই দফায় ২৭০ জনের নিয়োগের জন্য কমিশনে পাঠানো হয়েছে। বিচারাধীন থাকায় ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে মন্তব্য করেননি আইনমন্ত্রী।
×