ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যুব দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

যুব সমাজকে মাদক ও জঙ্গীবাদের পথ ত্যাগ করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২ নভেম্বর ২০১৬

যুব সমাজকে মাদক ও জঙ্গীবাদের পথ ত্যাগ করতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদক, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের পথ পরিহার করে নিজেদের মেধা নিজের, পরিবারের ও জাতির উন্নয়নের জন্য ব্যয় করার জন্য দেশের যুব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা চাই না আমাদের দেশের যুব সমাজ বিপথে চলে যাক, আর বাবা-মায়ের জন্য দুঃখের কারণ ঘটুক। মাদকাসক্তি, সন্ত্রাস, উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদ থেকে যুব সমাজকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এই পথ মানুষকে সুস্থ পথে নিয়ে যায় না। আর এই পথ বেহেশত আর স্বর্গেও নিয়ে যাবে না। হুর-পরীও দেবে না। বরং মানুষ হত্যা ও ধর্মীয় জঙ্গীবাদ সৃষ্টিকারীর জায়গা হবে নরকে। মঙ্গলবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় যুব দিবস উপলক্ষে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, শান্তির ধর্ম ইসলামে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের কোন স্থান নেই। ইসলাম কোনভাবেই মানুষ হত্যাকে সমর্থন করে না। হায়াত ও মউতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। এসব তাঁরই হাতে। মানুষ হত্যা ও ধর্মীয় জঙ্গীবাদ সৃষ্টিকারীর জায়গা বেহেশতে নয়, দোজখে হবে। তাই যুব সমাজকে বলব- মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ এ ধরনের কর্মকা- থেকে বিরত থেকে নিজের জীবনকে, নিজের পরিবারকে যেমন উন্নত করা যাবে, দেশটাও উন্নত হবে। ‘আত্মকর্মী যুবশক্তি- টেকসই উন্নয়নের মূলভিত্তি’- সেøাগানে এবারের যুব দিবস পালিত হচ্ছে। আলোচনা পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ জনকে জাতীয় যুব পুরস্কারে ভূষিত করেন। এবারই প্রথমবারের মতো অটিজম কোটায় পুরস্কার দেয়া হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন সিকদার, উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান রাসেল অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী আখতার উদ্দিন, যুব সংগঠক অমীয় প্লাবন চক্রবর্তী, সেলফ এমপ্লয়ার সুলতানা পপি, যুব ও ক্রীড়া অধিদফতরের মহাপরিচালক আনোয়ারুল করিম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠান শেষে পুরস্কারপ্রাপ্তদের সঙ্গে ফটোসেশনেও অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। যুব সমাজকে দেশের প্রাণ এবং উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার চালিকাশক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যুবক, যা পৃথিবীর অনেক দেশেরই নেই। এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পূর্ণ সদ্ব্যবহারকল্পে সৃজনশীল ও উৎপাদনশীল কর্মকা-ে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্তকরণের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যুবকদের সংগঠিত করে বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামে উজ্জীবিত করেছিলেন, উদ্যমী করেছিলেন। এই যুবকরাই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। আমরা বিজয়ী জাতি। এখন সবাইকে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে উজ্জীবিত হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কারো কাছে হাত পাতব না, আত্মমর্যাদাশীল, কর্মোদ্যমী হয়ে উঠব। আমরা চাই না আমাদের যুবশক্তি কোনভাবেই বিপথে যাক এবং তাদের অভিভাবকদের যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াক। তাদের অবশ্যই মাদক, সন্ত্রাস এবং জঙ্গীবাদ থেকে দূরে থাকতে হবে। এগুলো কোন সুস্থ ধারা নয়, এগুলো সবসময়ই যুব সমাজের সুন্দরভাবে বিকাশের অন্তরায়। তিনি বলেন, হায়াত এবং মউতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। এসব তাঁরই হাতে। যুব উন্নয়নে তাঁর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, দেশের সকল জেলায় যুবদের জন্য একই ধরনের প্রশিক্ষণ অবকাঠামোগত সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে নতুন করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে এবং বিদ্যমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণ পেয়ে যুবকরা আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। সরকার যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মাধ্যমে বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, ঋণ সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে তাদের মানবসম্পদে পরিণত করছে। প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে জাতির পিতার একটি উদ্বৃতির উল্লেখ করে বলেন, জাতির পিতা ১৯ আগস্ট ১৯৭২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে কারিগরি শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে যুবকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘কাজ কর, কঠোর পরিশ্রম কর, না হলে বাঁচতে পারবে না। শুধু শুধু বিএ, এমএ পাস করে লাভ নেই। আমি চাই কৃষি কলেজ, কৃষি স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও স্কুল, যাতে সত্যিকার মানুষ পয়দা হয়। বুনিয়াদি শিক্ষা নিলে কাজ করে খেয়ে বাঁচতে পারবে।’ প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকার গৃহীত যুব উন্নয়নমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপের তথ্য তুলে ধরে বলেন, জাতির পিতার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী যুবদের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁর সরকার একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করছে। দেশে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটায় ২০০৯ সালে সারাদেশে পলিটেকনিকে ভর্তির আসন ছিল যেখানে ছিল মাত্র ২৫ হাজার। বর্তমানে তা ১ লাখ ২৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদফতর প্রতিষ্ঠার পর থেকে জুন ২০১৬ পর্যন্ত প্রায় ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার ৪৬২ জনকে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ৮ লাখ ৫৩ হাজার ৭৮৯ জনকে ১ হাজার ৪৫৯ কোটি ১৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষিত যুবদের মধ্যে ২০ লাখ ২১ হাজার ১০৩ জন আত্মকর্মে নিয়োজিত হয়েছে। তিনি বলেন, শিক্ষিত বেকার যুবকদের অস্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যে কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত একজন যুবক-যুবনারী প্রতি মাসে ৬ হাজার টাকা কর্মভাতা পেয়ে থাকেন। এ পর্যন্ত ২৮টি জেলার ৬৪টি উপজেলায় প্রশিক্ষণ সমাপনকারীর সংখ্যা মোট ১ লাখ ১১ হাজার ১১৬ জন। কর্মসংস্থান প্রাপ্তদের সংখ্যা ১ লাখ ৮ হাজার ৭৮২ জন। অস্থায়ী কর্মসংস্থান শেষে অনেকে স্থায়ী কর্মসংস্থান কিংবা আত্মকর্মী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে কেউ যেন প্রতারিত না হয়, সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ বিদেশ যেতে পারবে না। যুবকদের স্বনির্ভর করতে তৃণমূল পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, ন্যাশনাল সার্ভিসে যুবনারীদের অংশগ্রহণ শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ। তাদের এই বিপুল অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়নকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। নীতিমালা অনুযায়ী ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচী ক্রমান্বয়ে সারাদেশে সম্প্রসারিত হবে। এছাড়া যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানে কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সৃষ্টিসহ দেশব্যাপী যুব উন্নয়ন অধিদফতরের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, বিদেশে গমনেচ্ছু তরুণ-যুবাদের জন্য টেনিক্যাল ট্রেনিং, দেশের বিদ্যালয়গুলোতে ভকেশনাল ট্রেনিং কর্মসূচী চালু এবং শেখ হাসিনা যুব কেন্দ্রকে সেন্টার অব এ্যাক্সিলেন্স হিসেবে গড়ে তোলার সরকারের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে জাতির পিতার অপর একটি বক্তৃতার উদ্বৃতি দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের সময় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেয়েও দেশ গড়াকে বেশি কঠিন উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা যদি একটু চেষ্টা করি, একটু বেশি পরিশ্রম করি, সকলেই সৎপথে থেকে সাধ্যমতো নিজের দায়িত্ব পালন করি এবং সবচাইতে বড় কথা, সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকি-তাহলে আমি বিনা দ্বিধায় বলতে পারি ইনশাল্লাহ কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের স্বপ্নের বাংলা আবার সোনার বাংলায় পরিণত হবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে ভিশন-২০৪১ ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের সকল আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা সে লক্ষ্যে নিবেদিত। যুব সমাজ আত্মোন্নয়নের মাধ্যমে সরকার প্রদত্ত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্রতী হবে এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সততা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের সঙ্গে কর্তব্য পালন করলে আমরা অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো। এ বছরের জাতীয় যুবদিবসের প্রতিপাদ্য ‘আত্মকর্মী যুবশক্তি, টেকসই উন্নয়নের মূলভিত্তি’ অত্যন্ত যথাপযুক্ত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে দেশে যুব জাগরণ ঘটেছে। বিশেষ করে আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। কাজেই যুব সমাজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে সততা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের সঙ্গে কর্তব্য পালন করলে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো।
×