ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিন হাজার ১শ’ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করার প্রস্তাব

রূপালী ও বেসিক ব্যাংকে তীব্র মূলধন ঘাটতি

প্রকাশিত: ০৪:২০, ২ নভেম্বর ২০১৬

রূপালী ও বেসিক ব্যাংকে তীব্র মূলধন ঘাটতি

রহিম শেখ ॥ মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারের কাছে ৩১০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করার প্রস্তাব দিয়েছে দুই রাষ্ট্রমালিকানধীন ব্যাংক। এরমধ্যে সরকারের বিশেষায়িত বেসিক ব্যাংক ২৬টি বন্ডের মাধ্যমে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা দেয়ার আবেদন করেছে। ব্যাংকের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রতিটি বন্ডের মূল্যমান হবে ১০০ কোটি টাকা। ব্যাংকের পক্ষ থেকে সুদবিহীন এই বন্ড দেয়ার জন্য ব্যাংকিং বিভাগের কাছে গত মাসে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংক সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড হিসেবে সরকারের কাছে ৫০০ কোটি টাকা চেয়েছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, এর আগে তারা দুইবার ৫০০ কোটি টাকার বন্ড চেয়েছিল, কিন্তু তা দেয়া হয়নি। এখন আন্তর্জাতিক মূলধন মান ব্যাসেল-৩ মেটানোর জন্য অবিলম্বে এই ৫০০ কোটি টাকার বন্ড দেয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে সুদের হার দিতে চায় ব্যাংক। জানা গেছে, চলতি বছরের জুন শেষে ৯ ব্যাংক এ মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারী মালিকানাধীন ৭টি ও বেসরকারী খাতের ২টি ব্যাংক। একইসঙ্গে এ সময়ে মূলধন পর্যাপ্ততার হারও কমে গেছে। মূলত যেকোন ঝুঁকি এড়াতে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রতি ত্রৈমাসিকে মূলধন পর্যাপ্ততার হার (সিআরএআর) হিসাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকা, এর মধ্যে যেটি বেশি তার ভিত্তিতে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত নির্ধারণ করা হয়। ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ হিসাবে ঋণ, বাজার ও পরিচালন ঝুঁকিগুলোকে বিবেচনায় নেয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, উদ্যোক্তাদের যোগান দেয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দেখা দিলে তার ভিত্তি দুর্বল হিসেবে ধরা হয়। একই সঙ্গে ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। মূলত সরকারী খাতের ব্যাংকগুলোর কারণেই সার্বিক ব্যাংকিং খাতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বেসিক ব্যাংকের পক্ষ থেকে সুদবিহীন দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকার বন্ড দেয়ার জন্য ব্যাংকিং বিভাগের কাছে গত মাসে একটি চিঠি দেয়া হয়েছিল। চিঠিতে ব্যাংক বলেছে, তারা এখনও প্রবল আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে। এই আর্থিক সঙ্কট লাঘবের জন্য বন্ডের মাধ্যমে হলেও যেন বেসিক ব্যাংককে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা দেয়া হয়। তবে এই বন্ড হবে সুদমুক্ত। অর্থাৎ, এই অর্থের জন্য কোন ধরনের সুদ দিতে রাজি নয় ব্যাংক। বেসিক ব্যাংক ২৬টি বন্ডের মাধ্যমে এই অর্থ দেয়ার আবেদন করেছে। প্রতিটি বন্ডের মূল্যমান হবে ১০০ কোটি টাকা। এবং পুরো বন্ডটি হবে সুদবিহীন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ১৭৭৭ কোটি টাকা। এই ঘাটতি বেড়ে চলতি বছরের জুনে মূলধন ঘাটতি গিয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ২৮৬ কোটি টাকায়। খেলাপী ঋণ ডিসেম্বরে ছিল ৬ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা, এ বছর জুনে তা বেড়ে হয় ৬ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এর আগেও বেসিক ব্যাংকের আর্থিক সঙ্কট কমানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তিন দফায় দুই হাজার ৩৯০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল। প্রথমবার ২০১৪ সালে দুই দফায় ৭৯০ কোটি এবং ৪০০ কোটি টাকা দেয়া হয়। গত বছর দেয়া হয়েছিল আরও ১২০০ কোটি টাকা। এ সম্পর্কিত অর্থ বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল, অর্থ বিভাগের ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকের মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে ১২০০ কোটি টাকা বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের অনুকূলে মূলধন পুনর্ভরণ খাতে প্রদান করা হলো। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, যে টাকার বন্ড চাওয়া হয়েছে তা যদি সরকার দেয় তবে ব্যাংকের যে মূলধন ঘাটতি আছে তা পূরণ করে মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারবে। ওই টাকা না দিলে ব্যাংকের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। বেসিক ব্যাংকের বন্ডের আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মোঃ আজিজুল ইসলাম বলেন, বেসিক ব্যাংক যে বিপদে পড়েছে তা থেকে উদ্ধার হতে গেলে সরকার বন্ড ছাড়তেই পারে। তবে তা হতে হবে শর্তসাপেক্ষ। রূপালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকিং বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘২০১৫ সালের ২ জুন এবং ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ এ সংক্রান্ত দুটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, ব্যাসেল-৩ গাইডলাইন অনুসারে রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে টায়ার-২তে ৫০০ কোটি টাকার ‘রূপালী ব্যাংক লিমিটেড সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড’ ইস্যু অনুমোদন প্রদানের জন্য আবেদন করা হয়। সে লক্ষ্যে আপনার নির্দেশনায় অতিরিক্ত সচিবের সভাপতিত্বে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু অদ্যাবধি এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার উল্লেখ করে চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণে মার্চ ২০১৫ থেকে ব্যাসেল-৩ কার্যকর করেছে। মার্চ ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে ডিসেম্বর ২০১৯ সালে ব্যাসেল-৩ গাইডলাইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হবে। ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ন্যূনতম মূলধন ১০ শতাংশের স্থলে পর্যায়ক্রমে বাড়িয়ে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং লেভেরাজ রেশিও ৩ শতাংশ সংরক্ষণের নির্দেশনা প্রদান করেছে। উল্লেখ্য, মার্চ ২০১৬ ভিত্তিতে মূলধন সংরক্ষণের হার ১০ দশমিক ৬২৫ শতাংশের বিপরীতে রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৫৪৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী রূপালী ব্যাংকের চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত মূলধন ঘাটতি ছিল এক হাজার ৫২ কোটি টাকা। আর খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৩৬০ কোটি টাকা, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ১৫৪৯ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এই বন্ড ইস্যু বিষয়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৫ সালের ২৭ মে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার ৭ বছর মেয়াদী ফ্লোটিং রেইট (সুদের হার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে নির্ধারিত হবে) এ রূপালী ব্যাংক লিমিটেড সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এমতাবস্থায় ব্যাসেল-৩ গাইডলাইন অনুসারে রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে টায়ার-২তে ৫০০ কোটি টাকার রূপালী ব্যাংক লিমিটেড সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যু করার জন্য আপনাদের সবিনয় অনুরোধ করছি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ে উর্ধতন এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়া যায় তার জন্য এ মাসেই একটি বৈঠকের আয়োজনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
×