ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোহাম্মদ আলী

দুই নেত্রী? একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২ নভেম্বর ২০১৬

দুই নেত্রী? একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন থেকে একটি ভ্রান্ত-নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। তা হলো এ দেশের দুই রাজনৈতিক নেত্রী বা ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়াকে এক পাল্লায় মাপা হয়, তাদের একই ধরনের মূল্যায়ন করা হয় এবং তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য কারও দৃষ্টিগোচর হয় না অথচ তাদের দু’জনের মধ্যে মানুষ হিসেবে এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তাদের কখনও সচেতনভাবে তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করা হয় না। এই নৈর্ব্যক্তিক তুলনামূলক বিশ্লেষণ না করার ফলে অতীতে আমরা অনেক ভুল করেছি এবং এখনও সেই ভুল করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে আমাদের এই ভুলগুলো সযতেœ পরিহার করা উচিত। দুই নেত্রীর অধীনেই সরকারের একজন সচিব হিসেবে তাদের অতি কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে আমি দু’জনকেই তুলনামূলকভাবে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি। তাদের ব্যক্তিগত গুণাবলী, বুদ্ধিমত্তা, সরকার পরিচালনার জটিল বিষয়াদি সঠিকভাবে বুঝতে পারার ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস, সাহস, দেশপ্রেম, দেশের ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন, সরকারপ্রধান হিসেবে তাদের কর্মদক্ষতা ও পড়সসরঃসবহঃ এবং তাদের সাফল্য-ব্যর্থতা সবকিছুর বিবেচনায় যথাসম্ভব নির্মোহভাবে আমি তাদের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি। প্রথমেই বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে আলোচনা করব। তাঁকে আমি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। ওই সময়ে আমি পর পর ৪টি মন্ত্রণালয় যথা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন, ভূমি, বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং যমুনা সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। একজন সচিব মন্ত্রীর পরেই প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, একজন রহংরফবৎ, তাকে প্রায়শই সরকারপ্রধানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হয়। বিভিন্ন বিষয়ে তাকে পরামর্শ দিতে এবং তাঁর কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে হয়। একজন সচিবের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যকলাপ যতটা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়, অন্য কারও পক্ষে তেমনটি সম্ভব নয়, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর অনেক রাজনৈতিক সহকর্মীর পক্ষেও নয়। সভার আলোচ্যসূচী সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট সচিবকে কেবিনেট মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতে হয়। খালেদা জিয়ার সময়ে আমি অনেক কেবিনেট মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলাম। গভীর আগ্রহ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের ব্যবহার, কার্যকলাপ, বক্তব্য লক্ষ্য করেছি। কিন্তু যা দেখেছি তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। বেগম জিয়া কোন দিন নির্দিষ্ট সময়ে সভায় আসেননি, প্রায় প্রতিদিন অনেক বিলম্বে এসেছেন। চঁহপঃঁধষরঃু বা সময়ানুবর্তিতা শব্দটা তাঁর অভিধানে নেই সেটা আমি অনেকবার লক্ষ্য করেছি। তার চেয়েও মারাত্মক যে বিষয় সেটা হলো তিনি কখনও প্রস্তুতি নিয়ে সভায় আসতেন না। আমি তাকে কোন দিন কেবিনেট পেপারস মনোযোগ দিয়ে পড়া তো দূরের কথা, এসবের ওপর চোখ বোলাতেও দেখিনি। তিনি কেবিনেট রুমে এসে তার চেয়ারে বসার পর তাঁর অউঈ কেবিনেট পেপারসের ফোল্ডারটি তাঁর সামনে টেবিলে রাখতেন এবং সভার পর আবার সেটি উঠিয়ে নিয়ে যেতেন। বেগম জিয়াকে কোন দিন ফোল্ডারটি বা কেবিনেট পেপারসগুলো স্পর্শ করতেও দেখিনি। আলোচ্য বিষয়ের ওপর তার কোন নধপশমৎড়ঁহফ শহড়ষিবফমব আছে বলে মনে হতো না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে বিষয়গুলো তার জানা থাকার কথা যেমন দেশের শাসনতন্ত্র, জঁষবং ড়ভ ইঁংরহবংং এবং ঝবপৎবঃধৎরধঃ ওহংঃৎঁপঃরড়হ এসব কোন বিষয়েই তাঁর জ্ঞানের পরিচয় কোন দিন পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে বড় কথা কেবিনেট মিটিংয়ে যেখানে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য ভূমিকা পালন করার কথা, আলোচনায় নেতৃত্ব দেয়ার কথা এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার দায়িত্ব সেখানে প্রতিটি কেবিনেট মিটিংয়ে আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি তিনি আসতেন, অন্য মন্ত্রীরা আলোচনা করতেন, কথা বলতেন সাইফুর রহমান, মান্নান ভূঁইঞা, এম কে আনোয়ার, ড. মোশাররফ হোসেন এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরীরা। বেগম জিয়া চুপচাপ বসে থাকতেন, কোন বিষয়ে তার সামান্যতম রহঢ়ঁঃ থাকত না। বেগম জিয়া সর্বত্র প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে বিলম্বে আসতেন। নিজের অফিস, কেবিনেট মিটিং, ঊঈঘঊঈ এবং ঘঊঈ-র মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংগুলোতে তিনি কোন দিন নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হতেন না। বিলম্বের কারণে তিনি কোন দিন বিব্রতবোধ বা দুঃখ প্রকাশও করতেন না। একটি ঘটনা আমার খুব পরিষ্কার মনে আছে। ১৯৯৬ সালে বেগম জিয়ার শেষ ঘঊঈ মিটিং, সেই মিটিংয়ে তার পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. মঈন খানের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (চবৎংঢ়বপঃরাব চষধহ) উপস্থাপনের কথা। মন্ত্রী, সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, সংস্থা প্রধান এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা আমরা অপেক্ষা করছি। বেগম জিয়ার দেখা নেই। এই গুরুত্বপূর্ণ সভার প্রায় ২ ঘণ্টা পর তিনি আসলেন, বিলম্বের কারণটি জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না এবং কোন দুঃখ প্রকাশও করলেন না। বেগম জিয়ার সৌজন্যবোধের কোন বালাই ছিল না। সেই সভায় সাইফুর রহমান সাহেবের বিরোধিতার কারণে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুমোদিত হলো না। বেগম জিয়া পরিকল্পনার পক্ষে বা বিপক্ষে একটি বাক্যও উচ্চারণ করলেন না। বেগম জিয়া সকালে তার অফিসে কোন জরুরী মিটিং না থাকলে সাধারণত ১২টার আগে অফিসে আসতেন না, এ কথাটি আমি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা, যাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হতো, তার মুখে শুনেছি। খালেদা জিয়ার দিনের অর্ধেক সময়ই নষ্ট হতো বিনা কাজে। বেগম খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অর্থাৎ যমুনা সেতুর বাস্তবায়ন কাজ চলছিল। আমি সেতু বিভাগের সচিব/যমুনা সেতু কর্তৃপক্ষের ঊীবপঁঃরাব উরৎবপঃড়ৎ বা নির্বাহী পরিচালক হিসেবে সেই প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করছিলাম। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বিষয়ে সরকারপ্রধান হিসেবে তাকে কোন দিন কোন আগ্রহ প্রকাশ করতে বা দিকনির্দেশনা দিতে দেখিনি। একদিন আমি স্ব^-উদ্যোগে সেতুর ংরঃব-এ প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি নৎরবভরহম-এর আয়োজন করলাম। তিনি আমার এবং উর্ধতন প্রকৌশলীদের নৎরবভরহম শুনলেন কিন্তু অর্থবহ রহঃবৎধপঃরড়হ দূরের কথা, একটি মন্তব্যও করলেন না। প্রধানমন্ত্রীর এই চূড়ান্ত অনাগ্রহ দেখে আমরা সবাই খুব হতাশ হয়েছিলাম। ১৯৯৬ সালের প্রথম দিকে আমি একবার ভাবলাম সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে নৎরবভ করা দরকার। আমি তাঁর একান্ত সচিব সাবিউদ্দিনকে ফোন করে এবং পরবর্তীতে লিখিতভাবে ধঢ়ঢ়ড়রহঃসবহঃ চাইলাম। কোন জবাব নেই। এক সপ্তাহ অপেক্ষা করার পর আমি তাঁর একান্ত সচিবকে ফোন করে আমার ধঢ়ঢ়ড়রহঃসবহঃ সম্বন্ধে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, দেখি কী করা যায়। সেই দেখা আর হলো না, কারণ তার কয়েক সপ্তাহ পরেই খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদে ইস্তফা দিতে হয়। খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করা খুব কঠিন ছিল, সাধারণ লোকের জন্য তো বটেই, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের জন্যও। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কর্মকর্তাদের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের ফরৎবপঃরড়হ বা মঁরফধহপব দেয়ার ক্ষমতার নিদারুণ অভাব আমি লক্ষ্য করেছি। বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে একদিন সন্ধ্যাবেলায় তার পধহঃড়হসবহঃ-এর বাসায় একটি সভায় উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেই সভায় আমি ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হাসান আহম্মদ ও প্রধানমন্ত্রীর সচিব ড. কামাল সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন। এক পর্যায়ে আমি একটি বিষয় ব্যাখ্যা করছিলাম। তার মধ্যখানে কামাল সিদ্দিকী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাত-পা নেড়ে কথা বলতে শুরু করলেন। প্রধানমন্ত্রী কিছুই বললেন না। আমি তখন বাধ্য হয়ে কামাল সিদ্দিকীকে ধমক দিয়ে বললাম, কধসধষ, ুড়ঁ শববঢ় য়ঁরবঃ, ও ধস ঃধষশরহম, সেই ধমকটা প্রধানমন্ত্রীরই দেয়া উচিত ছিল। পরদিন সকালে অফিসে এসে আমি হাসান আহম্মদ সাহেবকে ফোন করে প্রধানমন্ত্রীর এই ঢ়ধংংরাব ব্যবহার সম্বন্ধে জানতে চাইলাম। তিনি শুধু বিব্রত বোধ করলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত জীবনাচরণ ও কাজকর্ম ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক। তাঁর আলস্য, কর্মবিমুখতা, সাজসম্ভার প্রতি অতিমাত্রায় মনোযোগ, সময়ানুবর্তিতার দৃষ্টিকটু অভাব, প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়াদি সম্পর্কে জ্ঞান ও মনোযোগের অভাব, সিনিয়র কর্মকর্তাদের সম্পর্কে জ্ঞান ও তথ্যের অভাব, অতি মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া সিনিয়র কর্মকর্তাদের সম্পর্কে পরিচিতি ও তাদের দক্ষতা, সততা ও ঢ়বৎভড়ৎসধহপব সম্পর্কে আগ্রহের অভাব ছিল প্রকট। প্রশাসনের উপর তাঁর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে মনে হতো না। কর্মকর্তাদের কোনরূপ ফরৎবপঃরড়হ বা মঁরফধহপব দেয়ার ক্ষমতা বা মেধা তার ছিল না বললেই চলে। আমি তো তার অধীনে পর পর চারটি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। কোন দিন তাঁর কাছ থেকে কোন পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। বেগম জিয়া তো ফাইলে কিছু লিখতেই পারতেন না। কোন ফাইলে তাঁর হাতে লেখা একটি লাইনও আমি দেখিনি। এমনকি ফাইলে তাঁর নাম সই করার ক্ষেত্রে একটি মজার বিষয় লক্ষ্য করেছি। প্রথম প্রথম তিনি পুরা নাম অর্থাৎ খালেদা জিয়া সই করতেন। পুরা নাম লিখতে বোধহয় তাঁর কষ্ট হতো। কিছুদিন পর লেখা শুরু করলেন ‘খা. জি’। ‘খা. জি’টা বোধহয় শুনতে ভাল শোনাচ্ছিল না। তাই শেষমেশ তিনি শুধু ‘খ’ লিখেই স্বাক্ষর করার দায়িত্ব শেষ করতেন । প্রধানমন্ত্রীর কতকগুলো নিয়মিত দায়িত্ব থাকে, যেমন সরকারী কাজে বিদেশ ভ্রমণে যাওয়ার পূর্বে এবং দেশে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রপতিকে ব্রিফ করতে হয়। বেগম জিয়া কোন দিন সেই কাজটি করেছেন বলে দেখিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতীয় জীবনে বেগম জিয়ার উল্লেখযোগ্য কোন অবদান নেই। কোন গুরুত্বপূর্ণ বা জটিল সমস্যার সমাধান তিনি করতে পারেননি, দেশের উন্নয়ন এবং অর্থনীতির স্বার্থে কোন বড় প্রকল্প বা কার্যক্রম তিনি হাতে নিতে পারেননি। বিদ্যুত উৎপাদন, স্বাস্থ্য-পুষ্টি, শিক্ষা (শুধু স্কুলগামী মেয়েদের উপবৃত্তি ছাড়া), যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি খাতে যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন বা প্রয়োজনীয় প্রকল্প / কার্যক্রম গ্রহণ কোন ক্ষেত্রেই তার কোন উদ্যোগ বা নেতৃত্বের চিহ্ন নেই বরং উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণ নেতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। তাঁর সময়ে উন্নয়নের গতিধারা থমকে গেছে এবং দেশ অনেক পিছিয়ে পড়েছে। তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে ইতিবাচক বা প্রয়োজনীয় কিছু করবেন দূরের কথা, বরং আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে গৃহীত অনেক নীতিমালা এবং উন্নয়ন কর্মসূচী তিনি বাতিল বা স্থগিত করেছেন। তার নেতিবাচক, ঈর্ষাপরায়ণ এবং সঙ্কীর্ণ মনোভাবের কারণে দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে এবং উন্নয়নের গতিধারা অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক। শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৬-৯৮ সময়কালে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী নীতিমালা গৃহীত হয়, যেমন- স্বাস্থ্য নীতি, জনসংখ্যা নীতি, পুষ্টি ও খাদ্য নীতি ইত্যাদি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া এসব নীতিমালা অকার্যকর করে রাখেন। স্বাস্থ্য নীতিকে পরিবর্তন বা আরও উন্নত করবেন বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বেগম জিয়ার শাসনামলের ৫ বছরে সেই স্বাস্থ্য নীতির ৫টি শব্দও পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। বেগম জিয়া মারাত্মক ক্ষতিকর কাজ করেছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প বাতিল, স্থগিত বা বিলম্বিত করে দিয়ে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ কমিউনিটি ক্লিনিক। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য এই প্রকল্পটি যে কত অপরিহার্য ছিল এবং বর্তমানে এই প্রকল্পের মাধ্যমে যে কত কোটি কোটি মানুষ গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। এই প্রকল্পটি চালু থাকলে মানুষ সেবা পাবে এবং শেখ হাসিনার প্রশংসা করবে, তাকে ধন্যবাদ দেবে শুধু এই কারণে তিনি প্রকল্পটি বন্ধ করে দেন, তাছাড়া এর পেছনে আর কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছিল না। এই প্রকল্পটি বন্ধ করে দিয়ে বেগম জিয়া জাতির কাছে ক্ষমার অযোগ্য একটি বড় অপরাধ করেছেন। কোটি কোটি মানুষকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করেছেন। আরেকটি অতি প্রয়োজনীয়, অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প তিনি বন্ধ করে দেন। সেটি হলো খুলনায় শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল। খুলনা-যশোর অঞ্চলের অনেক মানুষ বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য ঢাকার পরিবর্তে কলকাতা যাওয়া সহজ মনে করত। এই প্রবণতা রোধকল্পে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় মানুষের উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য আলোচ্য হাসপাতালটি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল এবং প্রকল্পের কাজ অনেকদূর অগ্রসর হয়েছিল। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া এই প্রকল্পটিও বন্ধ করে দেন এবং দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে দেশের অভ্যন্তরে উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত রাখেন, শুধুই ঈর্ষাকাতর হয়ে, কোন যৌক্তিক কারণে নয়। বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, শহীদ মইজুদ্দিন ঘোড়াশাল সেতু, খিলগাঁও ফ্লাইওভার, গড়াই নদীর ড্রেজিং এই প্রকল্পগুলোও তিনি স্থগিত করে দেন। তিন চার বছর পর যখন আবার প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রকল্প ব্যয় অনেকগুণ বেড়ে যায়। ইতোপূর্বে এরশাদের আমলের বনানী মহাখালী ফ্লাইওভারের কাজও তিনি বন্ধ করে দেন। ঠিকাদারের সঙ্গে মামলা মোকদ্দমায় সরকারের অনেক টাকা গচ্চা যায়। অনেক বছর পরে আবার অনেক বেশি ব্যয় বরাদ্দের মাধ্যমে প্রকল্পটি নতুন করে বাস্তবায়িত হয়। জেলা পর্যায়েও অনেক প্রকল্প তার আমলে বন্ধ হয়ে যায়, যেগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়িত হলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ উপকৃত হতো। দেশে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার কল্পে ফাইবার অপটিকস সাবমেরিন কেবল প্রকল্পে যুক্ত হওয়া যে কত প্রয়োজনীয় ছিল তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। অত্যন্ত ভ্রান্ত ও সঙ্কীর্ণ চিন্তাভাবনার বশবর্তী হয়ে খালেদা সরকার এই প্রকল্প থেকে সরে আসেন এবং ফলে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়ি। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বেগম জিয়ার কোন ঠরংরড়হ নেই, কোন দিকনির্দেশনা নেই। বিভিন্ন সময়ে তার বক্তব্যে এসবের কোন উল্লেখ দেখা যায় না। শেখ হাসিনা (তিনি শেখ হাসিনাও বলেন না শুধু তাচ্ছিল্য সহকারে বলেন হাসিনা) ও আওয়ামী লীগের অর্থহীন সমালোচনা ছাড়া আর কোন সারবস্তু থাকে না তাঁর বক্তব্যে। আমরা যদি কতকগুলো বিষয় নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে এটাই প্রতীয়মান হবে যে, খালেদা জিয়ার কাছ থেকে দেশের নিরাপত্তা, স্বার্থ, উন্নতি-অগ্রগতি কোনটাই আশা করা যায় না। তিনি বাংলাদেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তার চেয়ে পাকিস্তানের স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দেন। তার আমলে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ওঝও এদেশে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, টখঋঅ-র মতো সংগঠন এদেশে ংধহপঃঁধৎু পায় এবং আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার খোলামেলা সুযোগ পায়। খঋঅ-র ব্যবহারের জন্য ১০ ট্রাক অস্ত্র আমদানি হয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ংবপড়হফ ভৎড়হঃ; এই ফ্রন্টে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে নাশকতামূলক কার্যকলাপ পরিচালনার অবাধ সুযোগ পায় ওঝও শুধু খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় থাকেন। এসব কার্যকলাপ কি বাংলাদেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর নয়? বিষয়টিতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কারণ খালেদা জিয়া সব সময়ই সন্দেহাতীতভাবে পাকিস্তানপন্থী এবং পাকিস্তানের স্বার্থের প্রতি নমনীয়, এমনকি বাংলাদেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ পছন্দ করেননি, তার স্বামীর কাছে যেতে অস্বীকৃতি জানান, যেসব মুক্তিযোদ্ধা তাকে নিতে এসেছিল তাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন এবং তারা যাতে আর তার কাছে না আসে সে জন্য তাদের শাসিয়ে দেন। তিনি এক পাকিস্তানী কর্নেলের বাসায় আরামে অবস্থান করতেই পছন্দ করলেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর তার এই পাকিস্তানপন্থী মনোভাব প্রকটভাবে ধরা পড়ে। তিনি যুদ্ধাপরাধী, পাকিস্তানপন্থী, চরম সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন, বাংলাদেশবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতিবিদদের মন্ত্রিত্বের গদিতে বসান। নিজামী, মুজাহিদ ছাড়াও তিনি আবদুর রহমান বিশ্বাস, মতিন চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমানের মতো চিহ্নিত পাকিস্তানপন্থীদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত করেন। তার হিংস্র, পাকিস্তানপন্থী, সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মনোভাব নগ্নভাবে ধরা পড়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, গণজাগরণ মঞ্চ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি তার ব্যবহার ও বিভিন্ন মন্তব্যের মধ্য দিয়ে। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় মহীয়সী নারী, শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক, শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে অসুস্থ অবস্থায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হলো। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের নাস্তিক বলে যথেচ্ছ গালিগালাজ করলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইবু্যূনাল ভেঙ্গে দেয়ার হুমকি দিলেন। এসব কি প্রমাণ করে না যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের প্রতি তার কোন শ্রদ্ধাবোধই নেই। সম্প্রতি একাত্তরের শহীদের সংখ্যা নিয়ে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, যে একটি ংধপৎড়ংধহপঃ বিষয়ে তিনি মারাত্মক আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধের অভাব আবারও প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। বেগম জিয়ার মধ্যে মহানুভবতা বা উদারতার কোন লক্ষণ দেখা যায় না, বরং হিংস্রতা এবং প্রতিহিংসাই তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী নিষ্ঠুর, মানবতাবিরোধী ঘটনাবলী, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের মারাত্মক ঘটনা, প্রথম বেসরকারী টিভি চ্যানেল ঊঞঠ বন্ধ করে দেয়া, আওয়ামী লীগের জবংবধৎপয ঈবষষটি বন্ধ করে দেয়া, সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণের অজুহাতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবিরের ওপর নির্যাতন ইত্যাদি বিভিন্ন ঘটনায় তার চরিত্রের এই হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতাই প্রকাশ পায়। তিনি দেশের স্বার্থ, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি সম্পর্ক, সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সৌজন্যবোধ, রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের প্রতি মর্যাদা এসবের চেয়ে জামায়াতকে খুশি করাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তাছাড়া শ্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে তার সাক্ষাতকার একতরফাভাবে বাতিল করার আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে? বেগম জিয়ার সৌজন্যবোধের বালাই নেই এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে আরও দুটি ঘটনায়। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পূর্বে শেখ হাসিনার টেলিফোনের জবাবে খালেদা জিয়ার চরম অসৌজন্যমূলক কথাবার্তা এবং কোকোর মৃত্যুর পর দুঃখ প্রকাশের জন্য শেখ হাসিনা যখন খালেদা জিয়ার অফিসে যান তখন তার সঙ্গে দেখা না করার ঘটনা কেউ ভুলে যায়নি। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি বিদেশীদের কাছে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নালিশ জানাতে ছুটে যান। এটা যে দেশের জন্য কত অসম্মানজনক এবং তার নিজের আত্মসম্মানের জন্য হানিকর এটুকু বোধ মনে হয় তার নেই। চলবে... লেখক : সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
×