ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বজিত রায়

অভিমত ॥ এবার ব্রিটিশ বধ

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ২ নভেম্বর ২০১৬

অভিমত ॥ এবার ব্রিটিশ বধ

প্রথমবারের মতো সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ইংলিশদের হারাল টাইগার বাহিনী। মাঠের সবুজ চাদরে দাঁড়িয়ে জয়টা উদযাপন করল মেহেদী-সাকিব, সাব্বির-রিয়াদ, তামিম-মুশফিকরা। গ্যালারির দর্শকও মাতল সেই ছন্দে। সঙ্গে সঙ্গে ধবল সুরে সুর মেলাল পুরো বাংলাদেশ। ক্রিকেট অধিকর্তা পূর্ণশক্তির ইংল্যান্ডকে হারিয়ে টাইগাররা জানিয়ে দিল টেস্ট ক্রিকেটে তারা কতটা সক্ষম। এই সিরিজের প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ যদি তীরে এসে তরী না ডোবাত তাহলে ফলাফলটা হতো আরও ছন্দময়। ধবল ধুলাইয়ের শেষ প্রান্ত থেকে ফিরে আসা ইংল্যান্ড হারে হারে টের পেল বাঙালী শুধু বীরত্বেই নয়, সুযোগ পেলে মাঠেও দেখাতে পারে সেই তেজোদীপ্ত ভঙ্গি। এ সফরে ওয়ানডে সিরিজের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ তিন ম্যাচ ইংলিশদের ক্রিকেট অস্তিত্বে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় টিম টাইগার্স। শুধু নিজেদের ক্রিকেট সামর্থ্যই নয়, নিরাপত্তার হুমকিতে থাকা বাংলাদেশ দেখিয়ে দিল ক্রিকেটের জন্য এ দেশ কতটুকু নিরাপদ ও যোগ্য। টাইগারদের অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক টেস্ট জয়। পরদিন ৩১ অক্টোবরের সংবাদপত্রগুলো ছিল মেহেদী-সাকিবময়। বিশ্বমিডিয়াও প্রশংসায় ভাসিয়েছে বাংলাদেশকে। অনন্য অসাধারণ এ জয়কে নানা অভিধায় অভিহিত করেছে নিউজ পোর্টারগুলো। কিভাবে এক অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়ল বাংলাদেশ সেই মহড়া দেখেছে ক্রিকেটবিশ্ব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও চলছে প্রশংসার প্রতিধ্বনি। চট্টগ্রাম টেস্টের সামান্য ব্যবধানে হারের তিক্ত বেদনা সামাল দিয়ে নতুন উদ্যোমী বাংলাদেশ নামে মিরপুরের ক্রিকেট ময়দানে। কে জানত পাঁচদিনের টেস্ট তিনদিনেই হবে অবসান। ২৭৩ রানের জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নেমে চা বিরতির মধ্যেই বিনা উইকেটে ১০০ রানের ইংলিশ স্কোর দেখে সবাই তখন আরেকটা হারের হিসাব কষতে ব্যস্ত। কিন্তু ব্রিটিশদের পক্ষে দাঁড়ানো ক্রিকেটের ভাগ্যদেবী মেহেদী-সাকিবের স্পিন ঘূর্ণিতে নিজেকে নিলেন সরিয়ে। কিছু সময়ের মধ্যেই ইতিহাসের সফলতম মঞ্চায়ন ঘটতে শুরু করে। মেহেদী রাঙ্গা ম্যাচে সাকিবের ডানা ঝাপটানো ইংলিশদের পরাজয় বরণে বাধ্য করে। ক্রিকেট জনক ইংল্যান্ডের এমন পরাজয় ১১ বছর পূর্ব ২০০৫ সালের ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের প্রথম সফরের কথা মনে করিয়ে দেয়। লর্ডসে অনুষ্ঠিত সেই টেস্টটাও শেষ হয়েছিল তিন দিনে। তবে সে পরাজয়টা ছিল বাংলাদেশের। পরদিন ইংল্যান্ডের কোন এক পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘ভবিষ্যতে এই বিতিকিচ্ছিরি বাংলাদেশ দল যেন লর্ডসের ১০০ মাইলের মধ্যে পা রাখতে না পারে।’ কিন্তু আজকে কি বলব। এ বিষয়ে কিছু আর বলতে চাচ্ছি না। সময়টা শুধুই আনন্দের। তাই মেহেদী-সাকিবদের প্রাণঢালা অভিনন্দন। ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ড। তবে তা কতটা সঠিক। ইংল্যান্ড যে ক্রিকেটের আবিষ্কারক তা ঐতিহাসিকভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। জানা যায়, পনেরো শতকের শুরুর দিকে বা তারও আগে স্যাক্সন অথবা নরম্যান যুগে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ক্রিকেট খেলা যাত্রা শুরু করে। ক্রিকেট খেলার প্রথম দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় ১৫৯৭ সালে। এই বছর একটি জমি বিষয়ক মামলার নথিতে পাওয়া যায় ‘ক্রেকেট’ খেলার কথা। সেই মামলায় জমির মালিক জন ডেরিকের জবানবন্দীতে লিপিবদ্ধ হয় যে, তিনি পঞ্চাশ বছর ধরে এই জমিটিতে ‘ক্রিকেট’ খেলা দেখে ও আয়োজন করে আসছেন! এরপর ১৬৬০ সাল থেকে ক্রিকেট বিষয়ক অনেক খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ১১ জনের থেকে শুরু করে ২ জনের ক্রিকেটও দেখা যায়; ইনডোরেও ক্রিকেট হয়েছে। এই সবকিছুই হচ্ছিল তখন বাজির জন্য। ১৬৯৭ সালের এক নথিতে দেখা যায়, এই সময় পেশাদার ক্রিকেটের কিছু কাঠামো গড়ে উঠতে শুরু করে। এই বছর সাসেক্স অন্য একটি কাউন্টির সঙ্গে একাধিক ইনিংসের ম্যাচ খেলে। বলা যায়, এখান থেকে ‘ভদ্রলোকের খেলা’ যাত্রা শুরু করে। ১৭ শতকে এসে একের পর এক ব্রিটিশ উপনিবেশ-আমেরিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারতে ছড়াতে থাকে ক্রিকেট। ছড়িয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডেও। এককালে উপমহাদেশীয় ক্রিকেটেও ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্থান। তারাই নির্ধারণ করে দিত এ উপমহাদেশের কোন দল কীভাবে খেলবে না খেলবে। ব্রিটিশ আমলের ক্রিকেট অধিপতি ইংরেজ বাবুরা বর্তমান বাস্তবতায় অতটা একগুঁয়েমি না হলেও ত্রি-মোড়লের তিন নম্বর অধিপতি হিসেবে কলকাঠি নেড়ে ভারতের সব অনাপত্তিমূলক কর্মকা-ে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ক্রিকেটে মানুষের আস্থা-অনাস্থার একটা বড় পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে ত্রিশক্তি প্রধান ভারত। মনে অতৃপ্তির ঢেঁকুর আটকে তিন মোড়লের এক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলো। আর আইসিসির সদস্য দেশভুক্ত ছোটখাটো দলগুলো অনবরত ফেলেই যাচ্ছে নীরব চোখের জল। নিয়মনীতির কোন তোয়াক্কা না করে নিত্যনতুন নীতি তুলে ধরছে আইসিসি। ত্রুটি-বিচ্যুতি যত আছে সব বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুইয়ান খেলোয়াড়দের ভেতর। এর বাইরে অন্য দলগুলো ডানাভাঙ্গা পাখি, তাই ওদের বেলায় লালচক্ষু প্রদর্শনের দরকার নেই। আইসিসি মহারাজের তিন অনুজ ছাড়া টেস্ট প্লেয়িং যে কোন দলের ওপর যখন তখন চালানো হয় ক্ষমতার কঠিন বাবুগিরি। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে ক্ষতিটা ক্রিকেটের হবে। আশা করছি আইসিসি এগোবে সঠিক পথে। খেলাধুলা একটি জাতি, একটি দেশ, একটি পতাকা ও একটি সঙ্গীতের নেতৃত্ব দেয়। পরিচয়হীন একটি ভূখ-কে বিশ্ববাসীর কাছে মাথা তুলে দাঁড়াতেও সহায়তা করে। ক্রিকেট তেমনি একটি খেলা যা বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে খ্যাতির সুউচ্চ চূড়ায় আরোহণের সর্বোচ্চ সুযোগ। এক সময় বাংলাদেশের ক্রিকেট অভিধানে শুধু হারের কথাটিই বড় অক্ষরে লেখা থাকত। জয়ের স্বাদ বা গন্ধ পাওয়াটা ছিল আকাশকুসুম বিষয়। দর্শক যারা খেলা দেখত তারা জয়ের পরিবর্তে সম্মানজনক হারকেই নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি হিসেবে ধরে নিত। কিন্তু আজ শুধু জয় আর জয়। ক্রিকেট বাঙালী ও বাংলাদেশকে দিয়েছে পরিচয়ের নতুন মাত্রা। ফুটবলের বিশ্ব আসরে বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তা করা যেমন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো গল্প তখন ক্রিকেটে টাইগাররা কাঁপাচ্ছে বিশ্বমঞ্চ। আমরা পূর্ণ আশাবাদী এ দেশের ক্রিকেট একদিন জয় করবে বিশ্বকাপের মতো বড় ট্রফিটি। বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নতি তার ইঙ্গিত বহন করছে বলেই প্রতীয়মান হয়।
×