ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল

ঘাড়ের বাত ॥ সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ১ নভেম্বর ২০১৬

ঘাড়ের বাত ॥ সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস

হাসনাত সাহেবের বয়স ৫০। কয়েক দিন ধরে ঘাড়ে বেশ ব্যথা অনুভব করছেন তিনি। প্রথমে ভেবেছিলেন উল্টোপাল্টাভাবে শোয়ার কারণে বুঝি এমনটি হচ্ছে। স্ত্রীকে জানালে স্ত্রী বললেন, বালিশ রোদে গরম করলে ঘাড়ের ব্যথা সেরে যায়। স্ত্রীর কথামতো রোদে গরম করা বালিশে শুয়ে প্রথম দু-একদিন কিছুটা আরামবোধ করলেও কয়েক দিন পর ব্যথা তীব্র হয়ে উঠল। বালিশ রোদে গরম করেও আর কোন লাভ হলো না। ঘাড়ের তীব্র ব্যথার সঙ্গে যুক্ত হলো হাতের আঙ্গুলে ঝিনঝিন অনুভূতি। অস্বস্তিকর এই সমস্যা সহ্য করতে না পেরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন তিনি। চিকিৎসক রোগের বর্ণনা শুনে এবং কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরিশেষে বললেন, রোগটি হলো সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস। সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস কী সাধারণ বাংলায় এটাকে বলে ঘাড়ের বাত। এটা হলো মেরুদে র ঘাড়ের অংশের কশেরুকাগুলোর মধ্যকার ডিস্ক বা চাকতিসদৃশ তরুণাস্থির ক্ষয়প্রাপ্তি। মানুষের মেরুদ ৩৩টি ছোট ছোট হাড় বা কশেরুকা (ভার্টি ব্রা) দিয়ে তৈরি। ঘাড়ের অংশে থাকে সাতটি কশেরুকা। এই কশেরুকাগুলো একটি অপরটির সঙ্গে ডিস্ক ও লিগামেন্ট দ্বারা সংযুক্ত থাকে। মেরুদে র ঘাড়ের অংশ সামনের দিকে উত্তলভাবে বাঁকানো। সবচেয়ে বেশি বাঁকানো থাকে পঞ্চ ও ষষ্ঠ কশেরুকার মধ্যকার ডিস্ক বরাবর। এই ডিস্কে স্পনডাইলোসিস বেশি ঘটে কারণ এই পয়েন্টে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে। ক্ষয়প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় ডিস্ক তার পানি হারিয়ে ফেলে এবং শুষ্ক হয়ে ওঠে। সুস্থ অবস্থায় ডিস্কগুলো নরম, স্থিতিস্থাপক এবং বেশি মজবুত। ডিস্কে যখন ক্ষয় শুরু হয় তখন তার নমনীয় তন্তুগুলো শক্ত হয়ে ওঠে এবং চাপের ফলে ভেঙ্গে যায়। দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিস্ক ক্ষয়ে যায় এবং পাতলা হয়ে যায়। এর ফলে কশেরুকাগুলোর প্রান্তগুলো পরস্পরের সঙ্গে ঘষা খেতে থাকে এবং বিভিন্ন মাপের নতুন হাড়ের দানা দেখা দেয়। এই হাড়ের দানাগুলো সূচালো ও ধারালো। এক্সরে পরীক্ষায় এগুলো ধরা পড়ে। যদি এই তীক্ষè হাড়ের দানাগুলোর কোনটি স্নায়ুমূলকে খোঁচা মারে তাহলে হাতে তীব্র ব্যথার উদ্রেক হয়। হাড়ের দানাগুলো মাঝে মাঝে স্নাযুরজ্জুকেও চাপ দিতে পারে এবং পাঁয়ে অসাড়তা ঘটাতে পারে। ক্ষয়প্রাপ্ত ডিস্ক তার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে সরে যেতে পারে, সেটাকে বলে ‘স্লিপড ডিস্ক’। সেক্ষেত্রে ডিস্ক স্নায়ুমূলের ওপর চাপ দিয়ে ব্যথা সৃষ্টি করে। স্লিপড ডিস্ক সাধারণত হয় দুর্ঘটনা, হঠাৎ পড়ে যাওয়া কিংবা ঘাড়ে আঘাতের কারণে। যা হোক, ডিস্কের স্থিতিস্থাপকতা হারিয়ে গেলে ক্ষয়প্রাপ্ত মেরুদে র নড়াচড়া সহজ হয় না। স্পনডাইলোসিস সাধারণত ঘটে থাকে ঘাড়ের নিচের চারটি কশেরুকাতে অর্থাৎ চতুর্থ থেকে সপ্তম কশেরুকাতে। ওপরের তিনটি কশেরুকাতে স্পনডাইলোসিস খুব কম হয় কারণ ওখানটায় খুব একটা চাপ পড়ে না। সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের ব্যথা সর্বদা ঘাড়ের পেছন দিকে অনুভূত হয়, কখনোই ঘাড়ের সামনের দিকে অনুভূত হবে না। ব্যথা তীব্র হলে তা কাঁধে এবং বাহুর পেছনের দিকে কনুই পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। কখনো কখনো ব্যথা হাতে এবং আঙ্গুলেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে করোনারী হৃদরোগ বা এনজিনার ব্যথা বাহুর ভেতরের পাশে অনুভূত হয় এবং সচরাচর তা আঙ্গুলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ঘাড়ের নড়াচড়াতে এই ব্যথা বাড়ে না। কিন্তু সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের ক্ষেত্রে ঘাড় নড়াচড়া করলে ব্যথা বেড়ে যায়। এ ছাড়া হৃৎপিে র ব্যথা সাধারণত বাঁ দিকে অনুভূত হয়। রোগ নির্ণয় স্পনডাইলোসিস হয়েছি কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এক্সরে পরীক্ষা করা হয়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান অথবা এমআরআই করা হয়ে থাকে। এক্সরেতে বিশেষ ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডিস্কের ক্ষয়। কশেরুকাতে বিভিন্ন মাপের নতুন হাড়ের দানা দেখা দিতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী অংশের ফাঁক কমে যায়। সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসে স্নায়ুমূল আক্রান্ত হলে কিছু উপসর্গ প্রকাশ পায়- - ব্যথা - অসাড়তা - শক্ত হওয়া। যদি ডিস্ক সরে যায় এবং স্নাযুরজ্জুর ওপর চাপ পড়ে তাহলে হাত অবশ হয়ে যেতে পারে। নতুন হাড় গজানোর জন্যও স্নায়ুরজ্জুতে চাপ পড়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। চিকিৎসা পদ্ধতি সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের কারণে ঘাড়ে তীব্র ব্যথা হলে সাধারণত নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়- ১. ঘাড়ের নড়াচড়া বন্ধ রাখা যেসব কাজকর্ম ঘাড়ে নড়াচড়া ঘটায় অবিলম্বে সেসব কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। ভ্রমণের সময় ঘাড়ে ঝাঁকি লাগে বলে ভ্রমণও বন্ধ রাখতে হবে। যারা অফিস করেন, কিছু দিন তাদের অফিস করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ঘাড়ের অসঙ্গত নড়াচড়া রোধ করতে সার্ভাইক্যাল কলার ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথম কিছু দিন ঘুমের সময়ও সার্ভাইক্যাল কলার পরে থাকা ভাল- এতে ঘুমের মধ্যে অসাবধনতাবশত ঘাড়ের নড়াচড়া প্রতিহত হয়। ঘুমানোর সময় ঘাড়টাকে চিৎ হয়ে কিংবা স্বাভাবিক অবস্থানের চেয়ে ১০-১৫ ডিগ্রী সামনের দিকে বাঁকিয়ে ঘুমান উচিত। একটি স্বাভাবিক আকৃতির বালিশে ঘাড় সামনের দিকে বেশি বাঁকিয়ে থাকে। সুতরাং ঘুমানোর সময় এসব বালিশ পরিহার করতে হবে। ঘাড়ের মেরুদ কে সাপোর্ট দেয়ার জন্য শোয়ার সময় খুব নিচু বালিশ কিংবা সার্ভাইক্যাল পিলো ব্যবহার করতে হবে। মূলত এই বালিশ থাকবে ঘাড়ের নিচে। ২. ব্যথানাশক ওষুধ ব্যথা থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তির জন্য ব্যথানাশক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। কখনো কখনো ব্যথা নিবারণের জন্য ইনজেকশনের প্রয়োজন হয়। ব্যথা কমানোর পর প্রকৃত চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ৩. গরম সেক যখনই অস্তিসন্ধি বা হাড়ের গিরাতে ব্যথা হয়, গিরার চারপাশের মাংসপেশিগুলো শক্ত হয়ে ওঠে এবং প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে গিরার সচলতা কমিয়ে দেয়। মূলত পেশির সংকোচনের দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে শরীর প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়Ñ এটাই আমরা করে থাকি সার্ভাইক্যাল কলার পরে। কিন্তু মাংসপেশীর সংকোচন বা টান যখন বেশি হয় তখন ব্যথা সৃষ্টি হয়। তাপ হলো মাংসপেশীকে শিথিল করতে সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা। এ কারণে পেশীতে গরম সেক দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে হট ওয়াটার ব্যাগ, ইলেকট্রিক্যাল হিটিং প্যাড কিংবা ইনফ্রারেড ল্যাম্প ব্যবহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে ভাল হয় গোসলের সময় ঘাড়ে গরম পানি ঢাললে। অধিক পছন্দনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা শর্ট ওয়েভ ডায়াথার্মি ও আল্ট্রাসাউন্ড হিট। এগুলো ফিজিও থেরাপিস্টরা দিয়ে থাকেন। ৪. ট্রাকশন ডিস্ক সরে গিয়ে স্নায়ুমূলে চাপ সৃষ্টি করলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ট্রাকশন সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা। ট্রাকশনের ফলে দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী স্থানসমূহ বৃদ্ধি পায় এবং এ কারণে স্নায়ুমূলের ওপর ডিস্কের চাপ শুরু হয়। ট্রাকশনের ওজন বাড়ানো কিংবা কমানো নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। বসে ট্রাকশন দেয়া যেতে পারে কিংবা শুয়েও দেয়া যেতে পারে। শোয়া অবস্থায় ট্রাকশন দিলে মাথার দিকের খাট ব্লক দিয়ে ৬-৯ ইঞ্চি উঁচু করে রাখতে হবে। ট্রাকশনের ফলে ব্যথা বেড়ে গেলে ট্রাকশন বন্ধ করে দিয়ে পদ্ধতিতে কোন ত্রুটি আছে কি না তা পরীক্ষা করে সংশোধন করতে হবে। ৫. মালিশ বা ম্যাসাজ ঘাড়ের টানটান পেশীগুলোকে শিথিল করতে মালিশ অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা। তবে ম্যাসাজ বা মালিশ করার সময় খেয়াল রাখতে হবে এসব যেন উল্টাপাল্টা করা না হয়। দুই কাঁধে এবং ঘাড়ের মালিশ করতে হবে ধীরে ধীরে। মাংসপেশীকে জোরে মুচড়ে দেয়া যাবে না, তাতে ক্ষতি হবে। ৬. ঘাড়ের মাংসপেশী শক্তিশালী করে তোলে ঘাড়ের মাংসপেশী দুর্বল হয়ে পড়লে মেরুদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পেশীগুলো যদি শক্তিশালী থাকে তাহলে মেরুদে র ওপর বাড়তি চাপ পড়ে না, ফলে মেরুদ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিছু ব্যায়ামের মাধ্যমে ঘাড়ের মাংসপেশীকে শক্তিশালী করা যায়। তবে এসব ব্যায়াম করতে হবে প্রাথমিক ব্যথা মিলিয়ে যাওয়ার পর। - হাত দুটো একসঙ্গে করে মাথার সামনে ঠেকিয়ে মাথাটাকে সামনের দিকে চাপ দিতে হয়। হাতের ওপর মাথার চাপ বাড়বে, তবে হাত দুটোও মাথার ওপর সমান চাপ দেবে। - হাত দুটো মাথার পেছনে নিয়ে মাথাটাকে পেছন দিকে চাপ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে হাত দুটো যেন মাথার সামনে চাপ দেয় - একইভাবে ডান হাত দিয়ে মাথার ডান দিকে ও বাম হাত দিয়ে মাথার দিকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। মাথাও সমানভাবে হাতের ওপর চাপ দেবে। মূলত হাত ও মাথার পরস্পরের দিকে চাপ এমন হতে হবে যেন মাথা বাঁচিয়ে যেতে না পারে। অর্থাৎ হাত যত জোরে মাথার দিকে চাপ দেবে, মাথাটাকে তত জোরে বিপরীত দিকে ঠেলতে হবে। ৭. শক্ত পেশি মিথিল করতে ব্যায়াম প্রাথমিক ব্যথা সেরে যাওয়ার পর সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের রোগীরা শক্ত ঘাড়, পিঠের উপরি অংশ ও কাঁধের পেশী শিথিল করতে কিছু ব্যায়াম করতে পারে- - মাথাটাকে বামে ও ডানে ঘুরান। - মাথাটাকে বাঁচিয়ে সামনের দিকে আনবেন। অতপর পেছনের দিকে নেবেন। - মাথাটাকে ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘুরাবেন। - কাঁধ দুটো ওপরের দিকে তুলবেন ও নামাবেন। তারপর কাঁধ দুটোকে ঘুরাবেন। - হাত দু’টিকে নিজের দুই কাঁধের ওপর স্থাপন করে কনুই দুটো বৃত্তাকারে ঘুরাবেন। লেখক : হাড়-জোড়া, বাত-ব্যথা ও আঘাতজনিত রোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন। মোবাইল : ০১৫৫২৩৪৫৭৫৪
×