ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাহী থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ৯ বছর আজ

রায়ের ১২ দফা নির্দেশনার অনেক বিষয় এখনও বাস্তবায়ন হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১ নভেম্বর ২০১৬

রায়ের ১২ দফা নির্দেশনার অনেক বিষয় এখনও বাস্তবায়ন হয়নি

আরাফাত মুন্না ॥ আজ ১ নবেম্বর। ২০০৭ সালের এই দিনে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ কার্যকর হয়। যুগান্তকারী এই পদক্ষেপের ৯ বছর পার হয়েছে। এর মধ্যে রায়ে দেয়া ১২ দফা নির্দেশনার আলোকে কিছু বিষয় বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু বিষয় এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। আলোচিত মাজদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগসংক্রান্ত যে কয়টি বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা করতে বলা হয়েছিল, তার মধ্যে স্বতন্ত্র জুডিশিয়াল সার্ভিস অন্যতম। রায় বাস্তবায়নে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অগ্রগতি সেই স্বতন্ত্র জুডিশিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠায়। এর আগে ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে মাজদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। স্বতন্ত্র জুডিশিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন করা হয়; এই কমিশনের অধীনে এ পর্যন্ত এক হাজার ২৩১ সহকারী জজ বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। ২০০৭ সালের ১৬ জানুয়ারি মাজদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠনসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবে একই বছর ১ নবেম্বর ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন কার্যকরের মাধ্যমে তা স্বতন্ত্র রূপ লাভ করে। স্বতন্ত্র এই সার্ভিস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তখন ফৌজদারি কার্যবিধির বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হয়। বিশেষ করে ম্যাজিস্ট্রেটের স্থলে ‘জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট’ কথাটি সংযোজন কার্যকরের মধ্য দিয়ে এটি স্বতন্ত্র একটি সার্ভিস হিসেবে রূপ লাভ করে। সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সে সময়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা বাস্তবায়ন করে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র একটি সার্ভিস হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সক্ষম হয়। যদিও এই সার্ভিসের শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ও রয়েছে। যা আলাদা একটি বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুপ্রীমকোর্টের অধীনে পরিচালিত হওয়ার কথা বলা হয়েছিল মাজদার হোসেন মামলার রায়ে। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠনের পূর্বে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) অধীনে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হতো। তখন পিএসসির অধীনে বিসিএস প্রশাসন (বিচার) হিসেবে এই নিয়োগ দেয়া হতো। তবে সে সময় বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাজের সুনির্দিষ্ট কোন সীমা ছিল না। যে কারণে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তরাও তখন বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। আবার বিচার প্রশাসন থেকে সরকারের অন্য পদে পাঠানোর সুযোগ ছিল। তবে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের এক বিচারপতিকে এই কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়। বর্তমানে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই কমিশনের সদস্য হিসেবে আরও রয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের দুজন বিচারপতি, এ্যাটর্নি জেনারেল, জনপ্রশাসন সচিব, অর্থ সচিব, আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাষ্ট্রপতি মনোনীত যে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের একজন ডিন বা অধ্যাপক, সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং ঢাকা জেলা জজ। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের দায়িত্ব হলো বিচার বিভাগের প্রারম্ভিক পদে (সহকারী জজ/জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট) নিয়োগদানের যোগ্য প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করা। কমিশন এ উদ্দেশ্যে পরীক্ষা নিয়ে প্রার্থীদের নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্যদের নিয়োগের সুপারিশ করে। অধিকন্তু বিচার বিভাগের যে কোন পদে নিয়োগ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে কোন প্রশ্নের উদ্ভব হলে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপতিকে উপদেশ দেয়া উক্ত কমিশনের দায়িত্ব। সংবিধানের ১১৫ এবং ১৩৩ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত অন্যান্য দায়িত্ব সম্পন্ন করাও এ কমিশনের কাজ। ২০০৭ সালে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠনের পর ৯ বার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) নিয়োগ প্রদানের সুপারিশ করেছে। যার মধ্যে প্রথম দুবার প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত পিএসসি করেছে, পরে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন নিয়োগের সুপারিশ করেছে। আর তৃতীয় বিজেএসের ক্ষেত্রে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে নিয়োগের সুপারিশ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া কমিশনের অধীনে বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিজেএসসিতে যথাক্রমে ৫০ ও ১৬০ জনকে জুডিশিয়াল সার্ভিসের প্রক্রিয়া পিএসসি সমাপ্ত করলেও জেএসসির সুপারিশে তারা নিয়োগ পান। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে কমিশন প্রতিষ্ঠার পরই তৃতীয় বিজেএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১ নবেম্বর পৃথকীকরণ কার্যকরের পর কয়েক মাসের মধ্যেই সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়। এরপর থেকে নবম বিজেএস পর্যন্ত ৭ বার জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সুপারিশে সহকারী জজ নিয়োগ করা হয়েছে। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন ২০০৮ সালে তৃতীয় বিজেএস পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে ৪০০, চতুর্থ পরীক্ষার মাধ্যমে ২১১, ৫ম বিজেএস পরীক্ষায় ১২০, ৬ষ্ঠ বিজেএস পরীক্ষায় ১২৫, সপ্তম বিজেএস ৮০, অষ্টম বিজেএসে ৫৩ ও নবম বিজেএস পরীক্ষার মাধ্যমে ১০০টি শূন্য পদে নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে ১০ম বিজেএস পরীক্ষার মাধ্যমে ১১৫ জন সহকারী জজ নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনকে শক্তিশালী করতে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ৭ম, ৮ম, ৯ম ও ১০ম তলায় নিজস্ব কার্যালয় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এর আগে ওই ইনস্টিটিউটের চতুর্থ তলাটি শুধু কমিশন কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তাছাড়া জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন সচিবালয় (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা-২০১২ অনুযায়ী সহকারী জজের বাইরেও অন্যান্য জনবল নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়। পে কমিশন ॥ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের জন্য বেতন ভাতা পর্যালোচনা ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এখন জুডিশিয়াল সার্ভিসের (পে কমিশন) সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জুডিশিয়াল সার্ভিসের বিচারকদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (পে কমিশন) বিধিমালা জারি করে। ২০০৭ সালের ১ নবেম্বর বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ কার্যকরের মধ্য দিয়ে এ বিধিমালা অনুসরণ করে একটি পে কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিশন ২০০৮ সালের ২ জুন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল ও ভাতার বিষয়ে সুপারিশ করে। ২০১৩ সালে কমিশনের সুপারিশ আংশিক বাস্তবায়ন করা হয়। তখন ২০০৯ সাল থেকে পে কমিশন কার্যকর দেখানো হলেও কার্যকর হওয়ার আগের সময়ে মূল স্কেলের বাইরে অন্যান্য সার্ভিস বেনিফিট পাননি বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আপীল বিভাগের বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে চেয়ারম্যান করে জুডিশিয়াল সার্ভিসের জন্য নতুন পে কমিশন গঠন করে সরকার। হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ নুরুজ্জামান নোনী, আইন কমিশনের সদস্য ড. এম শাহ আলম এবং ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আবদুল মজিদ, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, অর্থসচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন সচিব ও সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে কমিশনের সদস্য করা হয়। এ কমিশন ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে। সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সুপারিশ দিতে ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি একটি মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পে কমিশনের সুপারিশের আলোকেই একটু পুনর্বিন্যাস করে জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ এর আলোকে জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের জন্য বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে।
×