ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

উপমহাদেশের প্রখ্যাত রূপসজ্জা শিল্পী বঙ্গজিৎ দত্তর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১ নভেম্বর ২০১৬

উপমহাদেশের প্রখ্যাত রূপসজ্জা শিল্পী বঙ্গজিৎ দত্তর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাজু আহমেদ ॥ উপমহাদেশের প্রখ্যাত রূপসজ্জা শিল্পী, রূপসজ্জাকরদের গুরু, প্রথিতযশা নাট্যজন বঙ্গজিৎ দত্তর ১৬তম প্রয়াণ দিবস আজ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ দেশের রূপসজ্জা জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন বঙ্গজিৎ দত্ত। যার অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশের রূপসজ্জাশিল্পে নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়। শিল্পের এই নিরন্তর সমঝদার ছোট বেলা থেকেই সাংস্কৃতিক আবহে বড় হয়েছেন। স্কুলে কবিতা আবৃত্তি ও নাটকে অভিনয় করতেন। তাঁর বাবা সুরেশ দত্তও এক সময়ের জাঁদরেল অভিনেতা, নিদের্শক, সংগঠক এবং একজন রূপসজ্জা শিল্পী ছিলেন। তার ছোট বোন গীতা দত্ত তৎকালীন সময়ের অভিনেত্রী হিসেবে দাপটের সঙ্গে নিয়মিত অভিনয় করতেন। বঙ্গজিৎ দত্তর জন্ম ১৯৩৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার ঠাটারী বাজার এলাকায়। নবাবপুর প্রিয়নাথ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক, কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ইংরেজীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর রূপসজ্জায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি কলকাতায় একটি কলেজ থেকে হোমিওপ্যাথিতে ডিগ্রী লাভ করেন। এতদসত্ত্বে¡ও সংশ্লিষ্ট পেশায় না গিয়ে এন্টিকরাপশন ডিপার্টমেন্টে চাকরিতে নিযুক্ত হন। কিন্তু আপদমস্তক সংস্কৃতিপ্রাণ এ মানুষটির কাছে সেই পেশাটি ভাল না লাগায় চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসেন। তিনি রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়, পোগজ স্কুল এবং ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হিসেবে ১৯৫৫ থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কাল পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শাঁখারীবাজারের বাড়িটা বেদখল হয়ে যায়। পরিবারের সবাইকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ভারতে। বিপর্যস্ত হয়ে তখনই মৃত্যুবরণ করেন বঙ্গঁজিতের বাবা সুরেশ দত্ত। সেই কঠিনতম অবস্থায় বঙ্গজিৎকে পরিবারে হাল ধরতে হয়। পাকিস্তান এন্টিকরাপশন ডিপার্টমেন্টে কর্মরত থাকাকালীন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য আদান প্রদান করতেন বঙ্গজিৎ। স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর যুদ্ধবিদ্ধস্ত নবজাত এ ভূখ-ে থেমে থাকেনি নাট্যচর্চা। তরুণ নাট্যকর্মীরা তখন দেশ গঠনের হাতিয়ার হিসেবে নাটককে বেছে নেয়। সে দলে সঙ্গী হন বঙ্গজিৎ। রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল ও নবকুমার ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার পাশাপাশিও তিনি নাটকের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। নাটক লিখছেন, অভিনয় করছেন, সংগঠনের সক্রিয় কর্মী থেকে নিয়মিত রূপসজ্জার কাজ একাধারে সবই করতেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পরোক্ষভাবে যুক্ত এ মানুষটি দেশ ও দেশের সংস্কৃতিকে পরম মমতায় বুকে আকড়ে ধরেছিলেন। তার বিদগ্ধ অভিজ্ঞতা, অনবদ্য শিল্পপ্রেম, কঠোর মেধা-শ্রম এবং শিল্পের প্রতি অমৃত আন্তরিকতা সংস্কৃতিচর্চাকে করেছে গতিময়। বিশেষ করে রূপসজ্জাশিল্পকে নিয়ে গেছে ভিন্ন এক উচ্চতায়। পেশা হিসেবে রূপসজ্জাকে বেছে নেন তিনি। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশের থিয়েটারের গোড়াপত্তনে একজন এমন উচ্চ শিক্ষিত দক্ষ রূপসজ্জাকর পাওয়া জাতীর জন্য সত্যি সৌভাগ্যের। পাশাপাশি তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও চালিয়ে যান তবে তা ছিল মূলত জনসেবা বা দাতব্য সেবা হিসেবে। ইতিহাসের এই বাহক নাটকের মানুষের কাছে বঙ্গঁজিৎ দা, বঙ্গঁ দা বা শুধু দাদা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রায় সব অভিনয় শিল্পীই তার হাতের স্পর্শ পেয়েছেন। নাটকের এই নির্মল মানুষটির হাতের স্পর্শ পেয়েই যেন সত্যিকার অর্থে চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠত এবং শিল্পী তার অভিনয়শৈলী দিয়ে চরিত্রটি যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। আর সে কারণেই সমকালীন নাট্যাঙ্গনের মানুষের কাছে তিনি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসার মানুষ ছিলেন। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন নাট্যচক্র সম্মাননা, লোকনাট্য দল সম্মাননা, বহুরূপী সম্মাননা, চতুরঙ্গ সম্মাননা, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় সম্মাননা, ঢাকা ড্রামা সম্মাননা, বাচসাস পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি। আমৃত্যু তিনি থিয়েটারের সঙ্গে থেকে রূপসজ্জাকার হিসেবে বাঁচতে চেয়েছিলেন। আর তাই তো মৃত্যুর এক ঘণ্টা পূর্বেও তার প্রিয় রূপসজ্জা পেশার সঙ্গে ছিলেন এবং তার আত্মার আত্মীয় নাটকের মানুষদের সঙ্গে কাটিয়ে গেছেন। ২০০০ সলের আজকের দিনে রাত ১১-১৫ মিনিটে তার জীবন নাটকের যবনিকাপাত ঘটে। পৃথিবীর এই রঙ্গশালা থেকে তিনি বিদায় নেন। তার সুযোগ্য পুত্র শুভাশিষ দত্ত তন্ময় দাদা ও বাবার আদর্শকে মাথায় নিয়ে একই পেশায় নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন। প্রয়াণ দিবসে শিল্পী বঙ্গজিৎ দত্তর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। এদিকে শিল্পী বঙ্গজিৎ দত্ত স্মরণে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে ‘বঙ্গজিৎ দত্ত প্রয়াণ দিবস উদযাপন পর্ষদ।’ গত ২৮-২৯ অক্টোবর থিয়েটার ডিজাইনারর্স ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয় দুই দিনব্যাপী হাতে-কলমে রূপসজ্জা কর্মশালা। এই কর্মশালায় প্রয়াত বঙ্গজিৎ দত্তর সুযোগ্য সন্তান বর্তমান সময়ের সম্ভাবনাময় রূপসজ্জা শিল্পী শুভাশিষ দত্ত তন্ময় বাবার শেখানো জ্ঞানই তিনি পৌঁছে দেন এ প্রজন্মের তরুণ নাট্যকর্মীদের মাঝে। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সমাপনী দিনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে থাকবে নানা আয়োজন। এ আয়োজনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, নাট্যসারথী আতাউর রহমান, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিম-লীর সদস্য নাট্যজন ঝুনা চৌধুরী এবং নাট্যজন দেবপ্রসাদ দেবনাথ। থাকবে রূপসজ্জা কর্মশালার সনদপত্র বিতরণ এবং স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালায় থাকবে কাদামাটি, গানের দল সর্বনাম, মাইম আর্ট এবং বঙ্গলোকের পরিবেশনা। সবশেষে থাকবে তরুণ থিয়েটার কর্মীদের একটি বিশেষ পরিবেশনা।
×