ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অস্ত্র ও অর্থের উৎস!

প্রকাশিত: ০৪:০১, ১ নভেম্বর ২০১৬

অস্ত্র ও অর্থের উৎস!

জল্পনা-কল্পনা ছিল প্রায় শুরু থেকেই। গোয়েন্দাদের প্রাথমিক তদন্তে আভাসও মিলেছে। এবার মিলেছে প্রমাণ। ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ভয়াবহ জঙ্গী সন্ত্রাসী হামলার অস্ত্র এসেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ থেকে। আর অর্থ এসেছে দুবাই থেকে হুন্ডির মাধ্যমে। প্রেরক এক পাকিস্তানী নাগরিক। গোটা প্রক্রিয়াটির তদারকি ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছে কুখ্যাত পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএর বরাতে চাঞ্চল্যকর ও আন্তঃদেশীয় এসব তথ্য-উপাত্ত জানা গেছে। তার আগে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর পালিয়ে যাওয়া ৬ জঙ্গীকে গ্রেফতার করে। ধৃত জঙ্গীদের মধ্যে ৩ জন বাংলাদেশী। একজন ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে তিন জেএমবি সদস্যকে ছিনিয়ে নেয়ার মূল পাণ্ডা। ২০১৪ সালের পর থেকেই এসব জঙ্গী পলাতক ছিল পশ্চিমেবঙ্গ, অসম ও অন্যত্র। অতঃপর আটক ছয় জঙ্গীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার অস্ত্র ও অর্থ সংক্রান্ত প্রাপ্ত তথ্যাদি যাচাই-বাছাই করে দেখছেন এনআইএর কর্মকর্তারা। ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থাও তাদের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সন্ত্রাসী জঙ্গী গোষ্ঠীদের আন্তঃদেশীয় যোগাযোগটি বিশাল ও সমৃদ্ধ। তারা খুব সহজেই সীমান্ত পেরিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করতে সক্ষম। দীর্ঘদিন একে অন্যের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পালিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। জঙ্গীদের নেটওয়ার্ক এতই শক্তিশালী যে, তারা ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষী লোকজনের সহায়তা নিয়ে সঙ্গোপনে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, বোমা বানাতেও পারঙ্গম। সর্বোপরি তাদের অর্থেরও আদৌ কোন অভাব নেই। এখানে মনে রাখতে হবে যে, গোটা কার্যক্রমই পরিচালিত হচ্ছে একেবারে অবৈধ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে। নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নাকের ডগায়। সর্বোপরি বিজিবি-বিএসএফ সমৃদ্ধ দুর্ভেদ্য কাঁটাতার ও কঠোর সীমান্ত নজরদারি এড়িয়ে। খুব ক্ষমতাশালী এবং প্রভাব বিস্তারকারী মহল থেকে সরাসরি অর্থ সহায়তাসহ পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এই ধরনের জঙ্গী কার্যক্রমের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এবং হামলা চালানো এক কথায় দুরূহ ও অসম্ভব। আর এ কারণেই এসব ক্ষেত্রে বার বার উচ্চারিত হয়ে থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নাম। আটককৃত জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, গুলশান হামলায় ব্যবহৃত একে-২২ রাইফেল তৈরি হয় মালদহের একটি কারখানায়। সেখানে বিহারের মুঙ্গের থেকে আগত অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের প্রশিক্ষণ দিতে আসেন পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী পশতুভাষী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আদম খেলের অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা। এই গোষ্ঠীর কাছ থেকে তালেবান, দাওয়াতুল ইসলাম, জামা’আতুল ইসলামসহ সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠনগুলো চোরাই অস্ত্র ও গোলাবারুদ পেয়ে থাকে নিয়মিত। মালদহে জেএমবির একটি ঘাঁটিতে এসব অস্ত্র তৈরির পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তপথে প্রবেশ করে বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তান বিভিন্ন সময়ে হীন প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তৎকালীন সরকারের ছত্রছায়ায় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এ দেশে ঘাঁটি গেড়ে বসে এবং বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও হামলা চালাতে উৎসাহিত করে। এরই চূড়ান্ত বহির্প্রকাশ ঘটে গুলশানে হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ায় হামলার মাধ্যমে। এর পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধীদের বিচার ও দ- কার্যকরের প্রক্রিয়ায়ও তারা অহেতুক নাক গলাতে থাকে। ফলে দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে শুরু হয় টানাপোড়েন। সর্বশেষ, বাংলাদেশ ইসলামাবাদে প্রস্তাবিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করে। একই সময়ে ভারতও কাশ্মীরে উরি হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদদ দানের অভিযোগে বর্জন করে সার্ক সম্মেলন। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দানের অভিযোগ উঠেছে পাকিস্তান সরকারের ভেতর থেকেই। সম্প্রতি সে দেশের মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে সরাসরি সেনাবাহিনীর দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে বলা হয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই পাকিস্তান ‘একঘরে’ হয়ে পড়বে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। গণমাধ্যমে এগুলো ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বরখাস্ত করা হয়েছে সে দেশের তথ্যমন্ত্রীকে। এক টিভি সাক্ষাতকারে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারও বলেছেন, ‘সেনা শিবির হয়ে উঠেছে জঙ্গীদের আঁতুড়ঘর।’ এ অবস্থায় পাকিস্তান যদি অবিলম্বে জঙ্গী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা বন্ধ না করে তাহলে আগামীতে আরও বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। সার্কের সদস্য হিসেবে পাকিস্তান প্রতিবেশী দেশগুলোতে জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দেয়া বন্ধ করবে বলেই প্রত্যাশা। পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও আরও সতর্ক ও তৎপর হতে হবে।
×