ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেজওয়ানা আলী তনিমা

রিক্সা পেইন্টিং

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

রিক্সা পেইন্টিং

মনে করুন তো আপনার বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা। প্রযুক্তির এত আয়োজন কিন্তু সেদিন ছিল না। সববয়সী মানুষের বিনোদন ছিল বাংলা সিনেমাগুলো। ওই সিনেমা প্রতিফলিত হতো ফ্যাশন, রীতি ও জীবনমানে। অন্য সবস্তরে তো বটেই উঠে আসত গণমানুষের আর্টে তথা রিক্সায়। হ্যাঁ, আমাদের দেশে একেবারে অকুলীন গোত্রে সাধারণের যে আর্ট, তার মধ্যে প্রথম সারিতে উঠে আসবে এটি। ব্যাকরণহীন ইচ্ছাস্বাধীন তুলিতে ছবিগুলোতে শিল্পীর কল্পনার রঙে এসেছেন জসিম , শাবানা আর ববিতারা। তাতে তাদের চোখ হয়ত হয়েছে নীল, গায়ের রং উজ্জ্বল সাদা, চুলের সোনালি কিংবা লাল বাদামি। কারণ আমাদের সৌন্দর্যচেতনা মূলত দীর্ঘ সময়ের ঔপনিবেশিক সাহেব-মেমদের অনুকরণে গড়ে উঠেছে। রিক্সা আর্টের মধ্যে তাই সেই সাধারণ জনতার সৌন্দর্যআকাক্সক্ষা ও শিল্পবোধ ধরা পড়েছে যারা বড় মঞ্চে ঠাঁই পান না, শিল্পী সমাজের ব্রাত্য। শুধু কি তাই? বাঙালী রং ভালোবাসে, নকশা ও কারুকাজ। তাই আসবাবে, আটপৌরে তৈজসে, দোকানে আর প্রতিদিনের সবচেয়ে সহজলভ্য পরিবহন রিক্সাও রঙের মাধুরীতে রাঙিয়ে নিয়েছে। ট্রাক, বাস, বেবিট্যাক্সিও এর ছোঁয়া পেলেও শিল্পটি বৈচিত্রের বিস্তারে যথাযথ বিকশিত হয়েছে রিক্সাতেই। ছোট যানটির কোথায় শিল্প স্থান পায়নি? তার বেলের বাহার, ঝালর, পা-দানির একটুখানি জায়গা, হুড, মেটালিক বডি ও পাত সবখানেই রঙিন চিত্রকলা অথবা প্লাস্টিকের ওপর এ্যাপ্লিক কাজ। তাতে আছে ফুলপাতা, নকশা, প্রকৃতি, পশুপাখি, লোকগল্প কথার চিত্রায়ণ। আমাদের সমাজে রিক্সাচালকেরা মর্যাদায় প্রান্তিক। রিক্সা ভাড়াও সব বাহনের মধ্যে সবচেয়ে কম। তবু সীমিত সামর্থ্যে হাজারকয়েক টাকা ব্যয় করেও রিক্সার আপাদমস্তক মুড়িয়ে তাদের শিল্পপিপাসা মিটিয়ে তৈরি হয় রিক্সা আর্ট। রিক্সা পেইন্টিংয়ের গুরুত্ব বহুমাত্রিক। জনমানসের চিন্তাধারা ও বিবর্তন বুঝতে এটি সাহায্য করে। বাংলাদেশের রিক্সা আর্টের উদ্ভব অন্তত চল্লিশের দশক থেকে অর্থাৎ যখন আলাদা দেশটির সৃষ্টিই হয়নি। তখনকার বিকাশমান শিল্প চলচ্চিত্র ও এ অঞ্চলের চিরায়ত ফুলেল মোটিফ ছিল ত্রিচক্রযানের অংশ। রিক্সা ছবি জনচেতনার প্রতিফলক। তাই ঢাকা, রাজশাহীর নাগরিক পরিবেশে- মানুষ, পশুপাখি দেখা গেলেও সিলেট চট্টগ্রামের খানিকটা রক্ষণশীল পরিবেশে রিক্সা থেকেছে ছবিবর্জিত বা ‘আল্লাহ্’, ইসলামিক চাঁদতারা খচিত। ধর্মভীরু একই সঙ্গে সৌন্দর্যসচেতন জাতির মানসিকতার স্বাক্ষর, ‘মায়ের দোয়া, নামাজ কায়েম করুন’, ইত্যাদি লেখা যান খোদ ঢাকা শহরেও এখনও প্রচুর। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে পাক বর্বরতা ও একই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সাহসিকতা উঠে এসেছে দেশপ্রেমিক মুক্তিকামী মনের পরিচায়ক হিসেবে, খানিকটা ধর্মঘেঁষা সামরিক শাসনের সময় এসেছে মানুষের ছবির বদলে পশুপাখির ছবি- উন্মুক্ত গাড়িতে পাগড়ি পরিহিত ভিআইপি। হাতে ফুলের মালা নিয়ে স্যালুটরত পশু, তীর্যক স্যাটায়ারের ইঙ্গিতবাহী। সিনেমাস্টারের মুখ বদলের সঙ্গে তাজমহল, দস্যু ফুলনদেবী কি সাদ্দাম হোসেন সবই রিক্সার গায়ে সময়ে সময়ে উঠে এসে প্রমাণ করেছে যেই কম শিক্ষিত জনতা মূলধারার আলোচনায় খুব একটা আসেননা, স্র্রেফ একটা জনসংখ্যা হয়েই রয়ে যান তাদের সমাজ, সাংস্কৃতিক কিংবা রাজনৈতিক সচেতনতা কারোর চেয়ে কম না। নিজের মতো করে তারা বিশ্ব ও দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে নিজস্ব অভিমত রাখেন ও তা চমৎকার ব্যক্তও করতে পারেন। এসব কারণে রিক্সাচিত্রের আলাদা মূল্য আছে। কিন্তু হাজার হোক ‘রিক্সাওয়ালা’ তাই ‘অমার্জিত’ খানিকটা তাচ্ছিল্যের ব্রাকেটে তাদের নান্দনিকতা আটকে গেছে। পাশ্চাত্যে ধোঁয়া ওঠা কফির ওপর আঁকাআঁকি থেকে শুরু করে দেয়াল লিখনও শিল্পমর্যাদা পেয়েছে। এগুলো জনতার মানসিক চাহিদা, সময় ইত্যাদি বুঝতেও ভূমিকা রাখে। আয়ারল্যান্ডে ভ্রমণকালে দেখেছি টুরিস্ট বাসগুলো ম্যুরাল বা দেয়ালচিত্রকে অবশ্য দ্রষ্টব্য তালিকায় রেখেছে। এসব তাদের কাছে ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ। রিক্সাচিত্রও আমদের অঞ্চলকে বুঝতে এমনই অবদান রাখতে পারে। অভাব আমাদের চর্চার আর উপলব্ধির। উদাহরণস্বরূপ বলি, স্বাধীনতাযুদ্ধের রিক্সা পেইন্টিংগুলো মোটেই সংরক্ষণ তো করাই হয়নি কোন এক বিচিত্র কারণে একপর্যায়ে কারিগরদের ওগুলো আঁকায়ও বারণ করা হয়। মাঝখানে একটি সময় রিকশার গা থেকে চিত্রকলা হারিয়ে যেতে বসেছিল। ফ্যাশন শুধু পোশাকেই না, তৈজসে, অন্দরসজ্জায় এমনকি যানবাহনেও চিরআবর্তনশীল। তাই আবার ফিরে এসেছে রিক্সা অঙ্কন এবং আরও ব্যাপক আকারে ধীরে ধীরে আমাদের এই অনাদৃত শিল্পটি তার ব্যতিক্রমী রং-চঙে বৈশিষ্ট্যের কারণেই বৈচিত্রপ্রেমী মানুষের বেশ আদর পাচ্ছে। রীতিমতো প্রদর্শনী হয়েছে, উঠে এসেছে আড়ং ও অঞ্জনস ব্র্যান্ড পোশাকে, খ্যাতনামা বিবি রাসেলের চুড়ি, জুতা, ব্যাগে, গামছা থেকে দেয়ালচিত্র, আসবাবে, কোথায় নয়? বিদেশীদের মুগ্ধ করেছে, এর সব সম্ভাবনা ব্র্যান্ডভ্যালুকে আমরা আবিষ্কার করছি নতুনতর উপায়ে। রিক্সাচিত্র এখনও খুব জাতে না উঠলেও আমাদের নাগরিক চিত্তকে আকর্ষণ করে বৈকি। কোন পুরনো ধূসর রিক্সায় রোজিনা, রাজ্জাকেরা আমাদের নস্টালজিয়ায় ভাসান, দারুণ হিউমারে লেখা ‘জন্মে থেকেই চলছি, আমাকে মারবেন না, টাইম নাই, ধাক্কা লাগলে খবর আছে, খাইছি তোরে’ শত নাগরিক জ্যামেঝঞ্জাটে আমাদের মুখে ফুটিয়ে তোলে অনাবিল একচিলতে হাসি। যদিও রিক্সা আর্ট এখনও আমাদের অনেকের কাছেই নাগরিক পরিভাষায় কিঞ্চিত ‘ক্ষ্যাত’ তবু একসারি রিক্সা দাঁড়িয়ে থাকলে মন টেনে নেয় প্রথাগত শিক্ষার শিকলহীন হাতখুলে সাজানো রঙিন ছবিওয়ালা চমৎকার রিক্সাটিই। হাত উঁচু করে ওকেই ডাকি আমরা, ‘এই রিক্সা যাবে?’
×