ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই ম্যাচের সিরিজে অভিষেকেই ১৯ উইকেট নিয়ে রেকর্ডবুকে এই অফস্পিনার

মিরাজের বিরল রেকর্ড

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

মিরাজের বিরল রেকর্ড

মোঃ মামুন রশীদ ॥ বিশ্বের আর কোন অফস্পিনার এমন বিস্ময়কর নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি। সেই বিরল ইতিহাস রচনা করলেন বাংলাদেশের তরুণ ডানহাতি অফস্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ। সফরকারী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও তিনি ৬ উইকেট শিকার করলেন। তার ঘূর্ণি ছোবলে গুঁড়িয়ে গেল ইংল্যান্ডের ইনিংস। আর বাংলাদেশ দলেরও ঐতিহাসিক টেস্ট বিজয়ের মহানায়ক হয়ে গেলেন তিনি। কারণ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় সারির ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুইয়ে ছাড়া আর কোন দলের বিরুদ্ধে জেতেনি এর আগে বাংলাদেশ। এবার সবেমাত্র ১৯ বছরে পা দেয়া মিরাজের দুর্ধর্ষ বোলিংয়ে আতঙ্কিত ইংল্যান্ড দলের ব্যাটসম্যানরা অসহায় আত্মসমর্পণ করল। প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসে ৮০ রানে ৬ ও ৫৮ রানে ১ উইকেট নিয়েছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনিসহ মাত্র ৬ বোলার ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টে তিন ইনিংসে ৫ উইকেট বা তার বেশি শিকার করেছেন। তবে এর মধ্যে মিরাজের আগে আর দু’জন স্পিনার পেরেছেন। আর অফস্পিনার হিসেবে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন তিনি। কারণ ১৩৯ বছরের বেশি টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে যত অফস্পিনার এসেছেন কেউ ক্যারিয়ারের অভিষেক ও দ্বিতীয় টেস্টে এমন নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি। আরও অনেক রেকর্ড গড়েছেন তিনি। সিরিজে ১৯ উইকেট নিয়ে সিরিজেরও সেরা হয়েছেন মিরাজ। এর আগে এক সিরিজে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক ১৮ উইকেট শিকার করেছিলেন এনামুল হক জুনিয়র। সফরকারী জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে দুই টেস্টের সিরিজে তিনি ওই কীর্তি দেখান। একই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রথম ইনিংসে ৯৫ রানে ৭ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৫ রানে ৫ উইকেট নেন তিনি। ম্যাচটায় এই এনামুল হকেরই ২০০ রান দিয়ে ১২ উইকেট ছিল এতদিন এক টেস্টে কোন বাংলাদেশীর সেরা নৈপুণ্য। সেটাকেও ছাড়িয়ে গিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছেন মিরাজ। তিনি ইংলিশদের বিরুদ্ধে মিরপুর টেস্টে জয়ের ম্যাচে নিয়েছেন ১৫৯ রানে ১২ উইকেট। এক্ষেত্রে নতুন আরেকটি বিশ্বরেকর্ডও গড়েছেন মিরাজ। দুই ম্যাচের অভিষেক টেস্ট সিরিজে এর আগে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৮ উইকেট শিকার করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার জন জেমস ফেরিস। তাকেও ছাড়িয়ে গিয়ে নতুন ইতিহাস গড়েছেন মিরাজ। হঠাৎ করেই টেস্ট দলে ডাক পেয়ে গেছেন। যদিও তরুণ মিরাজকে নিয়ে সবাই আশা করেছিলেন যে কোনদিন ওয়ানডে দলে সুযোগ করে নেবেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড এবং ডানহাতি অফস্পিনে দারুণ সক্ষমতা থাকার কারণেই ডাক পেয়ে গেলেন মিরাজ টেস্ট দলে। প্রথম ম্যাচেই চমকে দিলেন বিশ্বকে। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৮০ রানে ৬ উইকেট নিয়ে বয়স বিবেচনায় দেশসেরা নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। আর ৬ বোলার বাংলাদেশের পক্ষে অভিষেকে ৫ বা তার বেশি উইকেট শিকার করলেও তারা মিরাজের চেয়ে বেশি বয়সী ছিলেন। সার্বিকভাবে সেটা ছিল অভিষেকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেরা অভিষেক বোলিং নৈপুণ্য। আর বিশ্বে স্পিনারদের মধ্যে দ্বিতীয় সেরা অভিষেক নৈপুণ্য বয়স বিবেচনায়। দ্বিতীয় ইনিংসে আর ৪ উইকেট নিতে পারলে নতুন এক রেকর্ড হতো, পারেননিÑ মাত্র ১ উইকেট নিতে পেরেছিলেন। তবে দ্বিতীয় টেস্টে আবার নির্মম-নির্দয় হয়ে উঠলেন বল হাতে। ইংলিশদের শক্ত ব্যাটিং লাইনআপ ভিরমি খেয়ে গেল তার অফস্পিনের ক্যারিশমায়। ৮২ রানে ৬ উইকেট নিলেন এবার। বিশ্বের প্রথম অফস্পিনার হিসেবে ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ম্যাচেই এক ইনিংসে ৫ উইকেট শিকারের নজির গড়ে বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করেন। স্পিনারদের মধ্যেও ঘটনাটা ছিল বিরল। মিরাজ সবেমাত্র চতুর্থ স্পিনার হিসেবে ওই কীর্তি দেখান লেগব্রেক গুগলি বোলার ক্ল্যারেন্স গ্রিমেট, বাঁহাতি অর্থোডক্স নিকোলাস কুক ও লেগব্রেক গুগলি বোলার নরেন্দ্র হিরওয়ানির পর। চট্টগ্রাম টেস্টে স্পিন দাপটের কাছে উভয় দলের ব্যাটসম্যানদের নতি স্বীকারের পর মনেই হচ্ছিল মিরপুরে একই পরিস্থিতির উদয় হবে। সেটাই হয়েছে। স্পিনাররাই পৈশাচিক উল্লাসে মেতেছেন বারবার ব্যাটসম্যানদের পর্যুদস্ত করে। তিনটা ইনিংস যাওয়ার পরও সেটাই মনে হয়েছে। বাংলাদেশ ইংলিশদের ২৭৩ রানের জয়ের লক্ষ্য বেঁধে দেয়। তবে দ্বিতীয়দিন শেষে মিরাজ বলেছিলেন, ‘আমরা যে স্কোরই করি না কেন লড়াই করব।’ তবে সেটার ছিঁটেফোঁটা দেখা যায়নি অধিনায়ক এ্যালিস্টার কুক ও বেন ডাকেট যখন ১০০ রানের উদ্বোধনী জুটি গড়েন। তবে ডাকেটকে ফিরিয়ে শুরুটা করে দেন মিরাজ। জো রুটকেও শিকার করেন বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান। পরের গল্পটার কেন্দ্রীয় চরিত্রে মহানায়ক হয়ে গেলেন মিরাজ। মিরপুর টেস্টের প্রথম ইনিংসেও ৮২ রানে ৬ উইকেট নেয়ার পর তিনি ইংলিশ শিবিরের জন্য হয়ে উঠেছিলেন বিভীষিকার নামান্তর। সেটাকে পুঁজি করে দুর্দান্ত বোলিং করে ঝলসে উঠলেন মিরাজ। আতঙ্কের নীল বীজ বুনে দিলেন ব্যাটসম্যানদের বুকে। একে একে মিরাজের ঘূর্ণিতে কুপোকাত হলেন গ্যারি ব্যালান্স, মঈন আলী, কুক, জনি বেয়ারস্টো ও স্টিভেন ফিন। সাকিবকে সঙ্গে নিয়ে ধসিয়ে দিলেন চলতি সিরিজে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বিরক্তিকর টেলএন্ডটাকেও। সব প্রতিরোধ ধসিয়ে দিয়ে এভাবেই দলের ঐতিহাসিক এক বিজয় রচনার মহানায়ক হয়ে গেলেন তিনি। এবার নিলেন ৭৭ রানে ৬ উইকেট। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টের তিনটি ইনিংসে ৫ উইকেট করে শিকারের ঘটনা মাত্র এর আগে আর ৫টি। প্রথমটি করেছিলেন ইংল্যান্ডের ফাস্ট বোলার টম রিচার্ডসন। ১৮৯৩ সালের আগস্টে অভিষেকে ৪৯ রানে ৫ ও ১০৭ রানে ৫ উইকেট শিকারের পরবর্তী বছর নিজের দ্বিতীয় টেস্টে নেন ১৮১ রানে ৫ ও ২৭ রানে ১ উইকেট। ১৯০১ সালে আরেক ইংলিশ পেসার সিডনি বার্নস, ১৯২৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার লেগব্রেক গুগলি বোলার গ্রিমেট, ১৯৭৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান পেসার রডনি হগ ও ১৯৮৮ সালে ভারতের লেগস্পিনার নরেন্দ্র হিরওয়ানি এই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তবে কোন অফস্পিনারের এমন কীর্তি গড়ার ঘটনা টেস্ট ইতিহাসে এটিই প্রথম। ক্যারিয়ারের দুই টেস্ট খেলেই দেশসেরা হয়ে যাওয়া মিরাজ তাই অফস্পিনার হিসেবে বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী।
×